জুন, ১৯৯৯; ভারতের নাগপুরে তখন গভীর রাত। নাগপুরের সবচেয়ে কর্মব্যস্ত লোকটিও সেদিনের মতো কাজ শেষ করে গভীর ঘুমে মগ্ন। কিন্তু কৃষক সাঞ্জু ভগতের চোখে ঘুম নেই। প্রচণ্ড পেট ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছে সে। তার বিশালাকার পেটের জন্য লোকমুখে কতই না কানাঘুষা শোনে সে। লোকে বলে, সে নাকি নয় মাসের গর্ভবতী পুরুষ!
তবে লোকলজ্জার ব্যথাকে যতটা না সহজে সে প্রশমিত করতে শিখেছে, তার তুলনায় আজকের ব্যথাটা ঢের বেশি। অবশেষে ডাক পড়ে অ্যাম্বুলেন্সের। ৩৬ বছর বয়সী এই কৃষককে নিয়ে ছুটে চলে অ্যাম্বুলেন্স। মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয় সাঞ্জুর। প্রাথমিকভাবে ডাক্তাররা একে পেটের বড়সড় একটা টিউমারজনিত ব্যথা হতে পারে বলে ধারণা করেন। সিদ্ধান্ত হয় সার্জারি করে টিউমার অপসারণের।
অবশেষে পেট কাটা হলো সাঞ্জুর। সাথে সাথেই বেরিয়ে এলো গ্যালনের পর গ্যালন তরল। অপারেশন করতে গিয়ে ডা. অজয় মেহতার তো চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা। সাঞ্জুর পেটে কার হাতের সাথে যেন ডা. মেহতার হ্যান্ডশেক হয়েছে বলে মনে হলো তার। ধীরে ধীরে পেট কেটে বের করে আনা হলো এক আশ্চর্য অবয়ব। যার আছে একটা হাত, একটা পা, হাত ও পায়ের আঙুল, যৌনাঙ্গের মতো একটা গঠন, আর কিছু চুল। তবে হাত-পাগুলো যতটা বিকশিত, সেই তুলনায় শরীরের অন্য অবয়বগুলো ততটা বিকশিত নয়। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে- সাঞ্জু যেন আস্ত এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে!
তাহলে কি সাঞ্জু সত্যি সত্যি অন্তঃসত্ত্বা ছিল? না, এ সন্তান সাঞ্জুর না। তবে কে সে? সাঞ্জুর পেটে পাওয়া এই অবিকশিত অবয়ব আসলে সাঞ্জুরই যমজ ভাই। অবাক হচ্ছেন পাঠক? এটাও কি ঘটা সম্ভব? হ্যাঁ, এটা সম্ভব। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দুর্লভ এই অবস্থাকে বলা হয় ‘ফিটাস ইন ফিটু’ (Fetus in Fetu)।
ফিটাস কী?
মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীতে শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনের ফলে তৈরি হয় জাইগোট। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর এরূপ মিলনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিষেক (Fertilization)।
এরপর ধীরে ধীরে জাইগোট বিভাজনের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর অবয়ব ধারণ করে। নিষেকের পর থেকে সন্তান প্রসবের আগপর্যন্ত ভ্রূণ মায়ের গর্ভেই লালিতপালিত হয়। মানুষের ক্ষেত্রে গর্ভকাল সাধারণত ৩৭-৪২ সপ্তাহ। নিষেকের ৯ সপ্তাহ পর থেকে শিশুর জন্ম হওয়া পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ফিটাল পিরিয়ড। আর এ ফিটাল পিরিয়ড চলাকালীন গর্ভস্থ মানবভ্রূণকে বলা হয় ফিটাস।
ফিটাস ইন ফিটু কী?
ফিটাস ইন ফিটু (Fetus in fetu) শিশুদের দুর্লভ জন্মগত সমস্যাগুলোর একটি। প্রতি পাঁচ লাখ জীবিত শিশুর মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ২০০ জনের ক্ষেত্রে এমন কেস রিপোর্ট পাওয়া গেছে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে জোহান ফ্রেডরিক মেকেল প্রথম ‘ফিটাস ইন ফিটু’ টার্মটি উল্লেখ করেন। ১৮০৭ সালে জর্জ উইলিয়াম ইয়াং প্রথম এমন একজন রোগীর বিস্তারিত কেস রিপোর্ট প্রকাশ করেন।
‘Fetus within fetus’ থেকেই মূলত ‘ফিটাস ইন ফিটু’ টার্মটি এসেছে। এটি এমন এক দুর্লভ জন্মগত সমস্যা, যেখানে গর্ভস্থ একটি ভ্রূণের মধ্যেই বেড়ে ওঠে অন্য এক ভ্রূণ। নিভৃতে বেড়ে ওঠা এ ভ্রূণ মূলত অপর ভ্রূণেরই যমজ ভাই বা বোন। মায়ের গর্ভে নীরবে বেড়ে ওঠা সেই যমজ ভাই বা বোনের কারণেই কখনো বা অতি অল্প বয়স্ক মেয়েকে সন্তানসম্ভবা কিংবা বয়স্ক পুরুষকে গর্ভবতী বলে মনে হয়!
কেন হয় ফিটাস ইন ফিটু?
মূলত একটি শুক্রাণু ও একটি ডিম্বাণুর মিলনের ফলেই তৈরি হয় একটি জাইগোট। গর্ভকালীন জাইগোটের ক্রমাগত বিভাজনের মাধ্যমে বেড়ে ওঠে একটি মানবভ্রূণ। শেষমেষ পূর্ণাঙ্গ গর্ভকাল শেষে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় একটি শিশু।
কিন্তু যমজ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে অনেক ভিন্নতা। যমজ বাচ্চা মূলত হয় দুই ধরনের: মনোজাইগোটিক বা আইডেন্টিক্যাল যমজ, ও ডাইজাইগোটিক যমজ। কখনও যদি দুটি শুক্রাণু ও দুটি ডিম্বাণুর মিলনে দুটি জাইগোট তৈরি হয়, তবে ঐ দুটি জাইগোটের বিভাজনে যে যমজ সন্তানদ্বয় ভূমিষ্ঠ হয়, তারা হলো ডাইজাইগোটিক যমজ।
অপরদিকে, মনোজাইগোটিক যমজে একটিমাত্র জাইগোটই তৈরি হয়। কিন্তু জাইগোটের বিভাজনের শুরুর দিকে জাইগোট বিভাজিত হয়ে দুটি ভ্রূণ তৈরি করে। ফলে এভাবে যে যমজ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তারা হলো মনোজাইগোটিক যমজ। ৭০ শতাংশ মনোজাইগোটিক যমজ একটিমাত্র অমরার মাধ্যমে মায়ের দেহের সাথে যুক্ত থেকে খাদ্য, পুষ্টি সংগ্রহ করে। এমন যমজদের বলা হয় মনোকোরিওনিক (একই অমরাবিশিষ্ট) মনোজাইগোটিক যমজ। এভাবে একই অমরার মাধ্যমে মায়ের দেহের সাথে যুক্ত থেকে বেড়ে ওঠে দুটি নতুন প্রাণ।
ফিটাস ইন ফিটু ঘটার জন্য দায়ী কারণ হিসেবে মূলত দুটি মত প্রচলিত রয়েছে- আইডেন্টিক্যাল বা মনোজাইগোটিক যমজ থিওরি, ও টেরাটোমা থিওরি। এর মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হলো মনোজাইগোটিক যমজ থিওরি। এই মত অনুযায়ী- মনোকোরিওনিক মনোজাইগোটিক যমজে যখন জাইগোটের বিভাজনের শুরুর দিকে তা বিভাজিত হয়ে দুটি ভ্রূণে পরিণত হয়, তখন টটিপোটেন্ট স্টেম কোষের অসম বিভাজনে একটি তুলনামূলক বড় ভ্রূণ ও একটি ছোটো ভ্রূণ তৈরি হয়।
তুলনামূলক বড় ভ্রূণটি অমরার মাধ্যমে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ পেয়ে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। কিন্তু ছোট ভ্রূণটি তেমন রক্ত সরবরাহ না পাওয়ায় তুলনামূলক অবিকশিত থেকে যায়। একপর্যায়ে বড় ভ্রূণটির অভ্যন্তরে তুলনামূলক ছোট এই ভ্রূণটি বিলীন হয়ে যায়। তখন মায়ের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থেকে ছোট ভ্রূণটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তা বড় ভ্রূণের রক্ত সঞ্চালনের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। ফলে বড় ভ্রূণের স্বাভাবিক বিকাশের সাথে একটু একটু করে ছোট ভ্রূণও বাড়তে থাকে। এই বৃদ্ধির হার পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য অপর্যাপ্ত হলেও ছোট ভ্রূণটি একটি জীবিত টিস্যু হিসেবেই বড় ভ্রূণের দেহে রয়ে যায়।
একসময় মানব অবয়বে অবিকশিত হাত, পা, দেহের অন্যান্য অঙ্গ, চুল প্রভৃতি দেখা দেয়। এভাবে একটি ভ্রূণে ২-৫টি পর্যন্ত ভ্রূণ বিলীন হয়ে যাওয়ারও প্রমাণ পাওয়া যায়। তুলনামূলক বড় ভ্রূণের উদর গহ্বর, অন্ত্র, মস্তিষ্ক গহ্বর, বৃক্ক প্রভৃতি স্থানে জায়গা করে নেয় তারা। অবশেষে তুলনামূলক বড় ভ্রূণ যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখনও এর মধ্যে জীবিত টিস্যু হিসেবে থেকে যায় ছোট সেই ভ্রূণ। সাধারণত শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় নানা জটিলতা। ধীরে ধীরে শিশুর দেহে ছোট ভ্রূণের বৃদ্ধির সাথে জটিলতাও বাড়তে থাকে। উদর গহ্বরে স্থান করে নেওয়া এসব ভ্রূণের বৃদ্ধির সাথে সাথে তা বক্ষ গহ্বর ও উদর গহ্বরকে পৃথককারী মধ্যচ্ছদাকে চাপ দিতে থাকে। ফলে একসময় শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। নাগপুরের সাঞ্জু ভগতের দেহে ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছিল।
অন্যদিকে, টেরাটোমা থিওরি অনুযায়ী সম্পূর্ণ বিকশিত ভ্রূণের অভ্যন্তরে অবিকশিত অবয়বকে একটি বিশেষায়িত টেরাটোমা হিসেবে মনে করা হয়। সহজ ভাষায়, টেরাটোমা হলো একধরনের টিউমার, যার মধ্যে অস্থি, চুল, দাঁত প্রভৃতি সংযুক্ত থাকে।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
গর্ভকালে মায়ের আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই পরীক্ষার মাধ্যমে একটি ভ্রূণের অভ্যন্তরে অন্য ভ্রূণের অস্তিত্ব নির্ণয় করা যেতে পারে। ভ্রূণের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডের হাড়, হাত, পা বা কোনো অঙ্গের উপস্থিতি দেখে ফিটাস ইন ফিটু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভকালীন ২২-৩২ সপ্তাহের মধ্যেই এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
ফিটাস ইন ফিটুর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়- এটি একটি বিনাইন (benign) অবস্থা। অর্থাৎ এটি আশেপাশের টিস্যুকে আক্রান্ত করবে না। তাই পূর্ণ বিকশিত শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সার্জারি করে শিশুর অভ্যন্তরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ভ্রূণকে কেটে ফেলা হয়। অপারেশনের পর শিশুর দেহের টিউমার মার্কারগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সার্জারির পর একটি শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনযাপনে সক্ষম হয়।
কাজাখস্তানের শিশু আলমজান নেমাতিলেভ কিংবা নাগপুরের সেই সাঞ্জু ভগতের মতো অনেকেই অপারেশনের পর সুস্থ জীবনযাপনে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশে ফিটাস ইন ফিটু
২০১১ সালে বগুড়ার শিবগঞ্জের আবদুল মালেক ক্রমাগত পেট ব্যথা ও পেট ফুলে যাওয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে ডাক্তাররা পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাকে দেশের দ্বিতীয় ফিটাস ইন ফিটুর কেস হিসেবে রোগনির্ণয় করেন। এর ঠিক তিন বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একজনের দেহে এমন জটিলতা খুঁজে পান। ২০১৭ সালের দিকেও পাঁচ মাসের এক ছেলের দেহে ফিটাস ইন ফিটুর জটিলতা খুঁজে পান চিকিৎসকরা। পরবর্তীতে Journal of Pediatrics & Neonatal Care-এ তার উপর একটি বিস্তারিত কেস রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
গর্ভকালে মায়ের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ‘ফিটাস ইন ফিটু’ নির্ণয় করা যেতে পারে। দ্রুততম সময়ে আক্রান্ত শিশুর সার্জারি করা সম্ভব হলে পরবর্তী জীবনে জটিলতা এড়িয়ে শিশুর পক্ষে সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। তাই ফিটাস ইন ফিটুর জটিলতা এড়াতে গর্ভকালে মায়ের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই।