পৃথিবীতে শক্তির মূল উৎস সূর্য। সূর্য থেকে আসা আলো এবং তাপশক্তিই পরবর্তীতে বিভিন্ন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আর এই শক্তির ধারায় জীবদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আমাদের চারপাশের বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ। এসকল উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্য থেকে পাওয়া শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে এবং সেই শক্তি তার মধ্যে জমা করে রাখে যেখান থেকে অন্যান্য প্রাণী উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে শক্তি পায়। এসব তো বিজ্ঞানের একদম প্রাথমিক জ্ঞান, কিন্তু তবুও একটু গভীরভাবে দেখলে আমাদের জীবনে অন্যান্য অনেক দিকের মতো উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এখান থেকে ফুটে ওঠে।
এই উদ্ভিদের যেহেতু জীবন আছে তাই অন্যান্য জীবের মতো উদ্ভিদকেও টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হয় নানা ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের সাথে। সেটা হতে পারে অনুজীবের আক্রমণে তৈরি রোগব্যাধি কিংবা পোকামাকড়ের বা আরও বড় কোনো প্রাণীর আক্রমণে তৈরি বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি। কিন্তু এমন যদি হয়- এসব পোকামাকড় আর জীবাণুরা উদ্ভিদকে ক্ষতিগ্রস্ত করায় একে অন্যকে সাহায্য করছে, তাহলে কিন্তু ক্ষতি বেড়ে যাবে বহুগুণে। এজন্যই এই দিক নিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানী আর কৃষিবিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন, যাতে গাছের ক্ষতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়, এবং সেই সাথে প্লান্ট প্যাথলজির গুরুত্বও প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে।
ই.সি. স্ট্যাকম্যানের ভাষায়,
প্লান্ট প্যাথলজি গভীর এবং প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আমাদের সামনে নিয়ে আসছে। এটি অণুজীবের বিশাল এবং পরিবর্তনশীল জগতকে প্রকাশ করার এবং তাদের মধ্যে মানুষের বন্ধু ও শত্রু সনাক্ত করার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে। এটা দেখিয়েছে কীভাবে অনেক খারাপ অণুজীবের সাথে লড়াই করা যায় এবং কীভাবে আমাদের কাজে ভালো অণুজীবদের লাগানো যায়।
অণুজীব বা প্যাথোজেন আর বিভিন্ন পোকার মধ্যে গড়ে ওঠা এই পারস্পরিক সম্পর্কের জন্যই গাছের ক্ষতির পরিমাণ এবং ক্ষতি হওয়ার আশংকা দুটিই বেড়ে যায়। বিভিন্ন উপায়ে পোকার সাহায্যে বিভিন্ন অণুজীব উদ্ভিদদেহে রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে:
- শুধুমাত্র পোকার দ্বারাই প্যাথোজেনের সাহায্য ছাড়া রোগ সৃষ্টি,
- প্যাথোজেন বা অণুজীবের বিস্তার,
- প্যাথোজেনকে উদ্ভিদের মধ্যে ইনোকুলেট করা,
- উদ্ভিদের মধ্যে অণুজীবের অনুপ্রবেশ ঘটানো,
- প্যাথোজেন দ্বারা উদ্ভিদকে সরাসরি আক্রম, এবং
- প্যাথোজেন বা অণুজীবকে সংরক্ষণ।
শুধুমাত্র পোকার দ্বারাই প্যাথোজেনের সাহায্য ছাড়া রোগ সৃষ্টি
আমরা জানি যে, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি উদ্ভিদের রোগ সৃষ্টি করে। এছাড়া পোকামাকড় দ্বারাও উদ্ভিদের রোগ হতে পারে। যদিও সমস্ত পোকামাকড় গাছে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না, তাদের মধ্যে কিছু কিছু গাছ রোগ ছড়াতে পারে। কিছু পোকামাকড় আছে যাদের ফাইটোটক্সিন নামক রাসায়নিক ক্ষরণ করার ক্ষমতা রয়েছে। এরাই পরে গাছপালায় রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এই ক্ষমতাসম্পন্ন পোকামাকড়কে টক্সিকোজেনিক পোকা বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, হেমিপ্টেরান বিভিন্ন পোকা উদ্ভিদের জন্য বিষাক্ত হয়। তাদের মূলত পিয়ার্সিং-সাকিং ধরনের মুখ থাকে যা ‘ডটপেন’ হিসেবে কাজ করে। প্রোবোসিস থেকে উদ্ভিদের শরীরে সূচ দিয়ে ছিদ্র করে এবং কোষের রস চুষে নেয়। চোষার সময়, তারা উদ্ভিদের শরীরে ফাইটোটক্সিক পদার্থ প্রবেশ করে। ফলে গাছের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং উদ্ভিদ বা উদ্ভিদের অংশ মরে যায়।
এই রোগগুলোকে অপ্যাথোজেনিক বা শারীরবৃত্তীয় রোগ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আলুর লিফহপার (ইম্পোয়াস্কা ফাবা) আলুতে হপার বার্ণ ঘটায়, স্কোয়াশ বাগ (আনাসা ট্রিসটিস) লাউ জাতীয় ফসলে আনাসা উইল্ট ঘটায়, আনারসের মিলিবাগ (সিউডোকক্কাস ব্রেভিপ্স) আনারসের মিলিবাগ উইল্ট ঘটায়। টক্সিকোজেনিক পোকা দ্বারা সৃষ্ট রোগকে ‘টক্সিকোসেস’, ‘টক্সেমিয়াস’ বা ‘ফাইটোটক্সেমিয়াস’ বলা হয়। কিছু বিষাক্ত পোকামাকড় শুধুমাত্র তাদের জীবনচক্রের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করতে পারে। টক্সিকোজেনিক পোকাদের সক্রিয় বিষাক্ত পর্যায়কে ‘টক্সিনিফেরাস’ বলা হয়। কিন্তু গ্রিন লিফহপার পোকাটি নিম্ফ এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয় পর্যায়ে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করতে পারে।
প্যাথোজেন বা অণুজীবের বিস্তার
রোগাক্রান্ত উদ্ভিদ (সংবেদনশীল হোস্ট প্ল্যান্ট) থেকে অন্য কোনো উদ্ভিদ/স্থানে প্যাথোজেন স্থানান্তরকে প্যাথোজেনের বিস্তার বলে। একটি প্যাথোজেন তার জীবনচক্রের সমস্ত পর্যায়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, একটি ছত্রাক শুধুমাত্র তার স্পোর গঠনের পর্যায়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে যা ইনোকুলেটিভ স্টেজ নামে পরিচিত। যদি সেই ইনোকুলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে না পড়ে, তবে রোগের উৎপাদন কম হবে বা সম্পূর্ণ হবে না। সেই ইনোকুলামের এমন কোনো অঙ্গ নেই যার দ্বারা তারা ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের বিস্তারের জন্য তারা কিছু এজেন্টের উপর নির্ভর করে, যাদের ডিসেমিনেটিং এজেন্ট বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাতাস, পানি, পোকামাকড়, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী। যদিও বায়ু স্পোর বিস্তারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান একটি মাধ্যম, তবে কিছু রোগ আছে যা পোকামাকড় দ্বারা ছড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আখের গুমোসিস (জ্যান্থোমোনাস অ্যাজোনোপোডিস পিভি. ভাস্কুলরাম) (একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ), গ্রিন লিফহপার (নেফোটেটিক্স ভিরেসেন্স) দ্বারা ধানের টুংরো রোগ, এফিড (অ্যাফিস গসিপি) দ্বারা কিউকারবিট মোজাইক রোগ।
প্যাথোজেনকে উদ্ভিদের মধ্যে ইনোকুলেট করা
ইনোকুলেশন মানে উদ্ভিদের একটি নির্দিষ্ট অংশে ইনোকুলাম পরিবহন করা যেখানে সংক্রমণ হতে পারে। ইনোকুলেশন অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট অংশে ঘটে থাকে। যেমন, পাউডারি মিলডিউ। যা-ই হোক, পোকামাকড় ইনোকুলেশনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, ফলের ব্লসম ব্লাইট রোগ এবং মৌমাছির মধ্যকার সম্পর্ক। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, যা ফুলের বিভিন্ন অংশকে সংক্রমিত করে। সংক্রমিত ফুল থেকে মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছিরাও ইনোকুলা সংগ্রহ করে এবং তারপর অন্য অসংক্রমিত ফুলে স্থানান্তর করে। এভাবে, এটি ব্লসম ব্লাইট রোগের ছড়াতে সাহায্য করে। আরেকটি উদাহরণ হলো বীজ ইনোকুলেশন। তুলার স্টিগমাটোমাইকোসিস রোগ এবং রেড কটন বাগের মধ্যকার সম্পর্ক। এটি অভ্যন্তরীণ বোল পচা নামেও পরিচিত। রেড কটন বাগ পোকার মুখের অংশের স্টাইলে এই রোগজীবাণুর স্পোর থাকে। এটি পোকার দ্বারা তুলার বোলে প্রবেশ করে। শক্ত পেরিকার্পের উপস্থিতির কারণে প্যাথোজেন নিজেই বোলে প্রবেশ করতে পারে না।
উদ্ভিদের মধ্যে অণুজীবের অনুপ্রবেশ ঘটানো
ইনগ্রেশন বা অনুপ্রবেশ হলো গাছের (হোস্ট) মধ্যে রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন প্রবেশের প্রক্রিয়া। বেশিরভাগ রোগজীবাণু উদ্ভিদের কিউটিকলের মাধ্যমে গাছের মধ্যে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়, কারণ এটি তাদের (উদ্ভিদ) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং কিউটিন, লিগনিন, সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ, মোমজাতীয় পদার্থ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত। তাই প্যাথোজেনরা ক্ষত বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উন্মুক্ত স্থানের মাধ্যমে হোস্টে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রিন লিফহপার এবং ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণ। এক্ষেত্রে, খাওয়া স্থানের এবং ওভিপজিশনাল চিহ্নযুক্ত ধান গাছে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সংক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি করে। আরেকটি উদাহরণ, হোয়াইট গ্রাব এবং ক্রাউন গল। সাদা গ্রাবগুলো মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড়। এগুলো কেটে কেটে শিকড় খেয়ে থাকে, যখন শিকড়ের কোনো অংশ উন্মুক্ত হয়, তখন তারা ক্রাউন গল প্যাথোজেনের সংস্পর্শে আসে।
প্যাথোজেন দ্বারা উদ্ভিদকে সরাসরি আক্রমণ
ইনভেশন বা আক্রমণ মানে উদ্ভিদের (হোস্ট) ভিতরের টিস্যুতে প্যাথোজেন ছড়িয়ে দেওয়া। উদ্ভিদে এভাবে প্যাথজেনের আক্রমণে পোকামাকড়ও সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিঞ্জাল শুট এন্ড ফ্রুট বোরার পোকা এবং সুটি মোল্ড ছত্রাক। পোকা ফলের মধ্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং ছত্রাক সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করে অভ্যন্তরীণ টিস্যুতে পচন ধরায়। আরেকটি উদাহরণ হলো উড বোরিং বিটেল এবং উড-রটিং ফাঙ্গাস। দুই প্রজাতির উড-বোরিং বিটল মূলত গাছের পিথ খেয়ে ফেলে: মনোকামাস স্কুটেলাটাস এবং মনোকামাস নোটালাস। গাছের কাষ্ঠল অংশ, উড-বোরিং ছত্রাক পাইরেনোফোরা গিগান্টিয়ান দ্বারা আক্রান্ত হয় বিটল দ্বারা তৈরি ক্ষতের মাধ্যমে, এবং পরবর্তীতে কাঠের ক্ষতি হয়।
প্যাথোজেন বা অণুজীবকে সংরক্ষণ
সমস্ত জীবন্ত প্রাণী বেঁচে থাকতে চায়, প্যাথোজেনও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিকূল আবহাওয়ার সময়, যেমন- শীতকালে, পোকামাকড়ও ডায়াপজের মাধ্যমে বেঁচে থাকে এবং রোগজীবাণুকে বাঁচতে বা সংরক্ষণ করতে সহায়তা করে। উদাহরণ হিসেবে কিউকাম্বার বিটল এবং কিউকারবিটের ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট কিংবা কর্ন ফ্লি বিটল এবং ভুট্টার ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট এর মধ্যকার সম্পর্কের কথা বলা যায়। অত্যধিক শীতকালীন আবহাওয়ায় কিউকাম্বার বিটল হলো শসা গাছের ব্যাকটেরিয়াল উইল্টের গৌণ সংক্রমণের প্রাথমিক উৎস।