র্যাটেল স্নেক মানুষদের জন্য একটি বিভীষিকার নাম। এর মারাত্মক বিষের জন্য এটি সবার কাছে পরিচিত। নিজের মারাত্মক বিষের কারণে বাংলা সাহিত্যেও এই সাপ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের বাদশাহি আংটির ক্লাইম্যাক্সে র্যাটেল স্নেকের দেখা পাওয়া যায়। জাতে আমেরিকান এই সাপকে আগে বাসাবাড়িতে ভিড়তে দেখা যেত। বাসাবাড়িতে এই সাপ যখন দেখা দেয়া শুরু হলো তখন স্বাভাবিকভাবেই একে মেরে ফেলা হতো এবং মেরে ফেলার পরে একে ধরে বাইরে ফেলে দেয়া হতো। এই হাত দিয়ে ধরে বাইরে ফেলে দেয়ার সময়টাই অনেক মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ মেরে ফেলার পর মনে হতে থাকে যে সাপটি মরে গিয়েছে, কিন্তু আদতে সাপটি মরে তখনও মরে যায় না। তাই যখন কেউ সাপটি মরে গিয়েছে বলে মনে করে সেটাকে ধরতে যায় ঠিক তখনই তা ওই মানুষকে আক্রমণ করে এবং কামড় দিয়ে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়।
র্যাটেল স্নেককে মেরে ফেললেই এর থেকে আর বিপদ হবে না সেটা মনে করা ভুল। যদি কেউ ভেবে নেয় যে সাপটি ত্রিশ মিনিট কিংবা এক ঘণ্টা ধরে মরে পড়ে আছে তাই এখন ফেলে দেয়া যেতে পারে, তবুও এটা ভাবা ভয়ংকর, কারণ এরপরও সাপটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করতে পারে। কীভাবে একটি মৃত র্যাটেল স্নেক তাকে ধরতে আসা হাতে নিজের বিষদাঁত বসিয়ে দিতে পারে? মারা যাবার অনেক্ষণ সময় পার হয়ে যাবার পরও কীভাবে সাপটি তার নিকট আসতে থাকা হাতের উপস্থিতি বুঝতে পারে? বাস্তবে এটা অস্বাভাবিক মনে হলেও ঠিক এরকমটিই ঘটেছে কিছু মানুষের কপালে। এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়েছে [১]।
গবেষণা করার জন্য এই ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছে এমন কিছু রোগীর সাথে যোগাযোগ করে ডাটা সংগ্রহ করা হয়। প্রথম যখন এই নিয়ে গবেষণা শুরু হয় তখন প্রায় ৩৪ জন রোগী পাওয়া যায় যারা র্যাটেল স্নেকের কামড়ে শয্যাশায়ী হয়েছিলো। এসব রোগীর বয়স ছিল বিশ থেকে চল্লিশের মাঝামাঝি। এই প্রত্যেকটি রোগী মৃত মনে করে সাপটিকে ধরে ফেলে দেয়ার সময় সেই সাপের কামড় খেয়ে হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছিলো। তাদের কয়েকজনের বর্ণনাতে এসেছে যে, একজন র্যাটেল স্নেক দেখে তাকে কাঠ দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে। মেরে ফেলার পরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাথায় আরও তিনবার আঘাত করে। সাপটি কোনো নড়াচড়া করছে না দেখে যেই তাকে হাতে নিয়েছে সাথে সাথে সাপটি তাকে কামড় দেয় এবং বিষ ঢুকিয়ে দেয়। সেই জরিপে দেখা যায় প্রত্যেকে রোগীই তাদের আঙুলে সাপের কামড় খেয়েছিল [২]।
র্যাটেল স্নেকের নাক এবং চোখের আশেপাশে অনেকগুলো গর্ত সদৃশ বস্তু দেখতে পাওয়া যায়। এই গর্ত বা পিটগুলো একেকটি সেন্সর বা ইন্দ্রিয় যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। এই ইন্দ্রিয়গুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়। এগুলো তাপ শনাক্ত করতে পারে। র্যাটেল স্নেকের মতো পিট-ভাইপার সদৃশ সর্প পরিবার খুব সহজেই তাদের মেমব্রেনের সাহায্যে তাপীয় বিকিরণ শনাক্ত করতে পারে। এই সাপের পিট বা গর্তগুলো থেকে একটি স্নায়ু সাপটির পেছনের দিকের স্পাইনাল কর্ড এবং হিন্ড ব্রেইনের সাথে যুক্ত থাকে। একটি র্যাটেল স্নেক তার বাম কিংবা ডান পাশ থেকে আসা তাপমাত্রার সিগন্যাল খুব সহজেই বুঝে নিতে পারে এবং যেকোনো এঙ্গেলে আক্রমণ করে বসতে পারে [৩]।
খুব সহজ একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করা যাক। একটি র্যাটেল স্নেকের মাথার কাছাকাছি দিয়ে একটি ইঁদুর যাচ্ছে। ইঁদুরটি যাওয়ার সময় ইঁদুরটি থেকে একটি তাপীয় বিকিরণ নিশ্চয় বের হবে। ইঁদুর থেকে আসা এই তাপীয় বিকিরণের কারণে র্যাটেল স্নেকের মাথার কাছের সেই সেন্সর যুক্ত পিট সক্রিয় হয়ে যাবে। সক্রিয় হবার সাথে সাথে সাপটির মধ্যে একটি উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে। এই স্নায়বিক উদ্দীপনা সৃষ্টির কারণে সাপটি তার কাছাকাছি বিপদ আছে মনে করে ইঁদুরটিকে আক্রমণ করে বসবে এবং কামড় দিয়ে নিজের বিষাক্ত বিষ ইঁদুরের শরীরে ঢুকিয়ে দিবে। এমনকি একটি র্যাটেল স্নেক এরকম আক্রমণ রাতের বেলা অমাবস্যার সময়ও করতে পারে। কারণ শুধু মাত্র তাপ বিকিরণের মাধ্যমেই এর স্নায়ু সক্রিয় হয়। তার জন্য দিনের বেলার আলোর প্রয়োজন হবে এমনটি নয়।
যখন এই জাতীয় একটি সাপকে মেরে ফেলা হয় তখন সাপটিকে বাইরে ফেলে দেয়ার জন্য কোনো মানুষ যখন মৃত সাপটির দিকে হাত বাড়ায় তখনও ঠিক এই ধরনের রিফ্লেক্সই সাপটি থেকে পাওয়া যায়। এখানে মনে হতে পারে যে সাপটি মরে যাওয়ার পর এরকম স্নায়বিক ক্রিয়া হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে র্যাটেল স্নেককে মেরে ফেললেও বেশ কিছু সময়ের জন্য এর স্নায়ুর ক্রিয়া চলতে থাকে। যখন এরকম ভাবে সাপের আক্রমণ শুরু হলো তখন অনেক সাপ বিশেষজ্ঞ লম্বা লাঠি হাতে নিয়ে সাপটিকে ফেলে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে, বিশেষ করে যে সাপ কিছুক্ষণ আগে মরে গিয়েছে তার বেলায় সতর্কতার সাথে এই কাজ করতে বলা হয়েছে।
প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দানই বলতে হবে এই স্নায়বিক প্রক্রিয়া। বর্তমানে দেখা যায় যে অনেক ধরনের কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের ডিটেক্টর বা সেন্সর তৈরি হয়েছে যেগুলো বিভিন্ন ইলেক্ট্রিক্যাল কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে এসবকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির মেধার ধারেকাছেও এখনও কেউ যেতে পারেনি। প্রকৃতি অনেক সূক্ষ্মভাবে জীবের স্নায়ু তৈরি করেছে। র্যাটেল স্নেকের কথাই ধরা যাক। এর পিটগুলোতে যে সেন্সরের দেখা গিয়েছে সেগুলো অনেক বেশি পরিমাণে তাপীয় সংবেদনশীল। এই পিটের মধ্যে অনেকগুলো থার্মো রিসেপ্টর থাকে, যেগুলো বাইরের পৃষ্ঠের এপিথেলিয়ামে অবস্থান করে। যেকোনো ইনফ্রারেড বা অবলোহিত বিকিরণ এর উপর পড়লেই সাপের এই অংশের তাপমাত্রা অনেকখানি বেড়ে যায়। এই বেড়ে যাওয়ার কারণেই সাপের জন্য সুবিধা হয় আগে থেকে আশেপাশের পরিস্থিতি বুঝতে পারা। শুধুমাত্র সাপের ক্ষেত্রেই নয়, এই ধরনের সেন্সর আরও বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়। তবে নিজের শত্রুকে বোঝার জন্য কোনো প্রাণী তাপীয় বিকিরণ ব্যবহার করে, কোন কোন প্রাণী শব্দ কিংবা ঘ্রাণ কিংবা স্পর্শ ব্যবহার করে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যকর বিষয় হচ্ছে এসব ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে শত্রুকে বুঝে এবং চিহ্নিত করে প্রাণীগুলো খুব নিখুঁতভাবে শত্রুর অবস্থান ঠিক রেখে আক্রমণ করতে পারে যেটা অনেক সময় মানুষও পারে না, এমনকি মানুষের তৈরি যন্ত্রও না [৪]।
তথ্যসূত্র:
[১] Walker, J. (2007). Flying Circus of Physics. John Wiley & Sons, Inc.
[২] Suchard, J. R., and F. LoVecchio (1999). Envenomations by rattlesnakes thought to be dead, New England Journal of Medicine, 340, No. 24, 1930
[৩] Newman, E. A., and P. H. Hartline (1982) The infrared ‘vision’ of snakes, Scientific American, 246, No. 3, 116-127
[৪] Bleckmann, H., H. Schmitz, and G. von der Emde (2004) Nature as a model for technical sensors, Journal of Comparative Physiology A, 190, 971-981
ফিচার ইমেজ সোর্স: AZCentral.com