১৯৯৭ সালের জুন মাস। ফ্রান্স ও ব্রাজিলের মধ্যে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সে সময় ব্রাজিল দলে টগবগে তরুণ খেলোয়াড় ছিলেন রবার্তো কার্লোস। একপর্যায়ে ফ্রি কিক পেয়ে বসে ব্রাজিল দল এবং সেই কিকটি রবার্তো করবে বলে ঠিক হয়। বল থেকে গোল পোস্টের দূরত্ব ১১৫ ফুট। মাঝে সাড়ি বেধে গোল পোস্টকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে চারজন ফ্রেঞ্চ খেলোয়াড়। এদেরকে ডিঙিয়ে সোজাসোজি গোলপোস্টে বল পাঠানোর কোনো উপায় নেই।
এমন পরিস্থিতিতে রবার্তো সবচেয়ে কৌশলী কাজটি করলেন। গোল পোস্ট আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা চার খেলোয়াড়ের পাশ দিয়ে বলটিকে পাঠিয়ে দিলেন কোনাকোনি। এরপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কোনাকোনি পাঠিয়ে দেয়া সত্ত্বেও বলটি কোথাও ড্রপ না করে বাতাসের মাঝেই বড় এক গোত্তা খেয়ে ঠিক গোল পোস্টের ভেতরে প্রবেশ করল। ব্যাপারটা এতই আকস্মিকভাবে ঘটল যে গোলরক্ষকের কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল কী ঘটেছে তা অনুধাবন করতে। বলটি যে এদিকে আসবে তা অনুমানই করতে পারেনি। বল সামনে আসলে যে তাকে ঠেকাতে হবে এই মানসিক সিদ্ধান্তটা নেবার আগেই গোল সম্পন্ন হয়ে গেছে। আর রচিত হয়েছে ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোলের ঘটনা।
এই ঘটনার পর দীর্ঘদিন ধরে পত্র পত্রিকায় এটি নিয়ে নানা মতামত প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই দাবি করেছেন এটি একটি দৈবাৎ ঘটনা। কোনো এক আকস্মিক কারণে এটি ঘটে গেছে। আসলে এর পেছনে কোনো দৈবিকতা কিংবা আকস্মিকতা নেই। এখানে আছে নিখাদ পদার্থবিজ্ঞান।
এমনিতে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করলে বলকে যেদিকে কিক করা হয়েছে সেটি সেদিকেই যাবে। কোনাকোনিভাবে মারলে সেটি কোনাকোনিই যাবার কথা। নিউটনের গতির প্রথম সূত্র অন্তত সে কথাই বলে। কোনো বস্তুর উপর বল (Force, খেলার বল নয়) প্রয়োগ করলে সেটি বলের দিকেই গতিশীল থাকবে। গতিপথে কোনো বাধা এসে না পড়লে এই গতি ও গতির দিক অব্যাহত থাকবে।
উপরের ঘটনায় বলকে কিক করা হয়েছে বাতাসে। সেখানে তো কোনো বাধা এসে বলের গতি পালটে দেয়নি। তাহলে? এর জন্য একটু ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। এই ঘটনায় লুকিয়ে থাকা কৌশলটি হলো বলের ঘূর্ণন।
বায়ুমণ্ডলকে শূন্য মনে হলেও এটি নানা অণু-পরমাণুতে ঠাসা। সেসব অণু-পরমাণুর বাধা যথেষ্ট প্রবল। বল যখন বায়ুর মধ্য দিয়ে চলে তখন তার গতিবেগ ও গতির দিক বায়ুর দ্বারা প্রভাবিত হয়। বল যখন কোনোপ্রকার ঘূর্ণন ছাড়া বায়ুতে অবস্থান করে তখন তার দুই পাশে বায়ুর চাপ সমান থাকে। দুই পাশে যখন বায়ুর চাপ সমান থাকে তখন তার গতির দিকও স্বাভাবিক থাকে। বল চলার সময় যদি তার মধ্যে ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয় তাহলে দুই পাশে বায়ুর চাপে তারতম্য তৈরি হয়। সেই তারতম্যের প্রভাবে স্বাভাবিক গতি থেকে বিচ্যুত হয়ে কিছুটা বেকে যায়। বেকে যাবার এই ঘটনা বাতাসের মধ্যেই ঘটে বলে ব্যাপারটিকে বেশ জাদুকরী বলে মনে হয়।
উপরের চিত্রটি লক্ষ্য করুন। বলটি বায়ুর মাধ্য দিয়ে বাম দিক থেকে ডান দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অগ্রসর হবার পাশাপাশি এর একটি ঘূর্ণনও আছে। ঘূর্ণন হচ্ছে ঘড়ির কাটা যে অনুসারে ঘুরে সে অনুসারে। ফলে নীচের দিকে বায়ুর প্রবাহের দিক হবে বলের ঘূর্ণনের দিকে। আর উপরের দিকের বায়ুর প্রবাহের দিক হবে বলের ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে। বিপরীত হওয়ায় উপরের দিক থেকে বেশি বাধা আসবে এবং অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। সেই চাপ বলটিকে সামান্য নীচে নামিয়ে দেবে। সামান্য নীচে নামলে আবারো এই ঘটনা ঘটবে এবং বল আরো একটু নীচে নামবে। এভাবে ঘূর্ণন থামা পর্যন্ত চলতেই থাকবে। বলটি যেহেতু ঘূর্ণনের পাশাপাশি সামনের দিকেও চলমান তাই নীচে নামার এই ঘটনাও হবে চলমান। অর্থাৎ সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে নীচে নামবে। ঘটনাটিকে সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে বলটি বক্রপথে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বলের ঘূর্ণন যদি ঘড়ির কাটার উলটো দিকে হয় তাহলে এখানেও উলটো ঘটনা ঘটবে। বল নীচের দিকে বেকে না গিয়ে উপরের দিকে বেকে যাবে। ব্যাপারটিকে যদি বাস্তবজীবনের বলের সাথে তুলনা করা হয় তাহলেও ঘটনা একই থাকবে। ঘূর্ণন অনুসারে উপরে-নীচে যাবার স্থলে হয়তো উত্তর-দক্ষিণ কিংবা পূর্ব-পশ্চিম দিকে যাবে।
বায়ুর মধ্যে বলের গতিপথ বেকে যাবার এই ঘটনাকে বলা হয় ম্যাগনাস ইফেক্ট। ফুটবলের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে একে ব্যানানা কিক-ও বলা হয়। ফুটবলের গতিপথ অনেকটা কলার বক্রতার মতো বলে এরকম নামকরণ। ম্যাগনাস ইফেক্ট নামকরণ করা হয়েছে জার্মান পদার্থবিদ হাইনরিখ গুস্তাভ ম্যাগনাসের নাম অনুসারে। ১৮৫২ সালে তিনি এই ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। অবশ্য তারও আগে ১৬৭২ সালে আইজ্যাক নিউটন এই ঘটনার ব্যাখ্যা করেছিলেন।
ফুটবলের গতিপথ বেকে যাবার ঘটনাটিকে বারনৌলির সূত্র দ্বারাও ব্যাখ্যা করা যায়। বারনৌলির সূত্র অনেকটা এরকম। ধরা যাক একটি পাইপের মধ্য দিয়ে পানি চলাচল করতে পারে। তাহলে পাইপের মধ্যে পানি স্থির থাকলে যে চাপ তৈরি করবে এবং পানি চলমান থাকলে যে চাপ তৈরি করবে এই দুইয়ের মান সমান হবে না। বারনৌলির সূত্র বলছে পানি চলাচল করলে পাইপের মধ্যে চাপ পড়বে কম। পানির প্রবাহের গতি যত বেশি হবে চাপের পরিমাণ তত কম হবে।
পাইপে মধ্যে পানি ছাড়াও অন্য যেকোনো তরল কিংবা গ্যাসীয় পদার্থ প্রবাহমান থাকলেও বারনৌলির বারনৌলির সূত্র কাজ করবে। একটি সিস্টেমের ভেতর চলমান যেকোনো প্রবাহী (Fluid) এর বেলাতেই এই সূত্র প্রযোজ্য।
ছোট একটি কাগজের টুকরো দিয়ে ব্যপারটির হাতেনাতে পরীক্ষা করা যায়। একটি কাগজের পাতা নিয়ে ঠোটের কাছে রেখে কাগজের উপরের পৃষ্ঠ ছুঁয়ে ফুঁ দিলে দেখা যাবে নেতিয়ে থাকা কাগজটি উপরে উঠে যাচ্ছে। উপরের দিক থেকে ফুঁ দিলে কাগজটি নীচে যাবার কথা, স্বাভাবিক হিসেবে উপরে উঠে আসার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এখানে হচ্ছেটা কী? এখানে মূলত কাজ করছে বারনৌলির প্রভাব। ফুঁ দেবার ফলে উপরের অংশের বায়ুর প্রবাহ বেড়ে গেছে। প্রবাহ বেড়ে যাওয়াতে বায়ুর চাপ কমে গেছে। উপরে চাপ কমে যাওয়া মানে নীচে চাপ বেড়ে যাওয়া। ফলে নীচের দিকের বাতাস কাগজটিকে ঠেলে উপরের দিকে উঠিয়ে দেবে।
ঘূর্ণায়মান ফুটবলের বেলাতেও পাইপে ঘটে যাওয়া ঘটনাই ঘটে। ফুটবল যখন বাতাসে ঘুরে তখন ঘূর্ণনের কারণে বলের একাংশে বাতাসের প্রবাহের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রবাহ বেড়ে গেলে সেখানে বাতাসের চাপ কমে যায়। ফলে অপর দিকে অধিক চাপের অবস্থা তৈরি হয়। অধিক চাপ বলকে ঠেলে দেবে স্বল্প চাপের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে বল তৈরি করবে একটি বক্র গতিপথ। যা প্রায় সময় ফুটবল খেলায় দেখা যায়।
তবে কিকের মাধ্যমে বলে ঘূর্ণন সৃষ্টি করলেই সেটি গোল পোস্টে গিয়ে ঠেকবে এমনটি ধারণা করা উচিত নয়। এর জন্য দরকার প্রবল অনুশীলন, অভিজ্ঞতা ও কৌশল। কিক দেবার সময় বেশি উঁচুতে দিলে সেটি গোল না হয়ে গোল পোস্টের উপর দিয়ে মাঠ পেরিয়ে যাবে, বেশি নীচে দিলে গোত্তা খাওয়ার আগেই ভূমিতে পড়ে যাবে, বেশি কোনাকোনি করে দিলে গোল পোস্টের ধারে কাছেও যাবে না, কম কোনাকোনি করে দিলে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের পায়ে ঠেকে যাবে, অল্প বেগে দিলে সময়ের আগে আগে আগেই বেকে যাবে, বেশি বেগে দিলে সময়ের পেরিয়ে যাবার পর বাকবে। সকল দিক মাথায় রেখে সবচেয়ে উপযুক্ত কিকটি যে করতে পারবে এবং গোল রক্ষকের চোখকে যে ধন্দে ফেলে দিতে পারবে সে-ই শুধু ম্যাজিক গোলের মালিক হতে পারবে।
মাঝেমধ্যে দেখা যায় খেলোয়াড় কর্নার থেকে কিক করলে সেটি কারো গায়ে না গেলে কোনো এক কৌশলে সোজা গোল পোস্টে ঢুকে গেছে। কর্নার এবং গোল পোস্ট একই রেখায় অবস্থিত, তাহলে বল কীভাবে গোল পোস্টের জালে ঢুকল? সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। শেট দেবার সময় কৌশল খাটিয়ে দেন। গোল পোস্টের সাথে একটু কোনাকোনি কিক করলেও সেটি বেকে এসে গোল পোস্টেই ঠেকে।
শুধু ফুটবলেই নয়; টেনিস বল, ভলিবল, গলফ বল, টেবিল টেনিস বল ইত্যাদি অনেক কিছুতেই ম্যাগনাস প্রভাব দেখা যায়।
এখান থেকে আরেক মজার প্রশ্নের জন্ম হয়। এমন কখনো সম্ভব হবে কি যেখানে বলকে কিক করলে সেটি অনেক বড় পরিমাণে গোত্তা খেয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসবে? অর্থাৎ ১৮০ ডিগ্রি কোণে উলটোদিকে ফিরে আসতে পারবে কিনা? উত্তর, না। ফুটবলের গতিকে বেশি বাকাতে হলে তার মধ্যে বেশি ঘূর্ণন সৃষ্টি করতে হবে। বেশি ঘূর্ণন সৃষ্টি করলে সেটি সময়ের সাথে সাথে ছোট থেকে আরো ছোট বৃত্তে বেকে যেতে থাকবে। অনেকটা মশার কয়েলের চক্রের মতো। যার কারণে কোনোভাবেই বল আগের অবস্থানে আসতে পারবে না।