জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমশ বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। তাপমাত্রার উর্ধ্বগতি দেশে দেশে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে। পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টায় তারা নতুন জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে শিখছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজেদের শারীরিক গঠনই পরিবর্তন করে ফেলার মতো নতুন করে একটি তথ্য এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। বলা হচ্ছে, প্রাণী প্রজাতি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের কান, লেজ, ঠোঁট এবং অন্যান্য উপাঙ্গের আকার পরিবর্তন করছে।
গত একশ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.৪ থেকে ০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, গাছ কেটে বন উজাড় করা, কৃষিকাজ এবং অন্যান্য মানবিক কর্মকাণ্ডের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের বর্ধিত পরিমাণকে গেল পাঁচ দশকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রাথমিক উৎস বলে মনে করা হয়। জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) সম্প্রতি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, ২১০০ সালের মধ্যে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৪-৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। গলতে শুরু করেছে মেরু অঞ্চলের বরফ। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে আছে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো। সেই সাথে ঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধিও চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। শুধু প্রকৃতি ও পরিবেশই নয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকাও সংকটে ফেলছে। পরিবর্তিত তাপমাত্রার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রাণীদের।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা ড. লিওন হারম্যানসন বলছেন, “আমাদের সাম্প্রতিক জলবায়ু ভবিষ্যদ্বাণীগুলো দেখায় যে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।” এমনকি ২০২২-২৬ সালের মধ্যে কোনো একটি একটি বছর প্রাক-শিল্প স্তরের থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে। এই চ্যালেঞ্জ শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার ভারসাম্য রাখার। প্রাণীরা বিভিন্ন উপায়ে বৈশ্বিক উষ্ণতার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। কেউ কেউ শীতল এলাকায় চলে যায়। কেউ কেউ প্রজনন বা স্থানান্তরের মতো নিজেদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর সময় পরিবর্তন করে ঠান্ডা আবহাওয়ার উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো প্রাণী নিজেদের দ্রুত শীতল করতে শরীরের আকার পরিবর্তন করে ফেলছে।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণী প্রজাতি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের কান, লেজ, ঠোঁট এবং অন্যান্য উপাঙ্গের আকার পরিবর্তন করে। অষ্ট্রেলিয়ার ডিকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই গবেষণা কাজটি করেছেন। গবেষণা দলটির প্রধান সারা রাইডিং বলছেন,
আমরা অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী প্রজাতিসহ ‘আকৃতি পরিবর্তনকারী’ প্রাণীর একাধিক উদাহরণ শনাক্ত করেছি। এই ধারার ব্যাপ্তি অনেক, এবং এটি পরামর্শ দেয় যে জলবায়ু উষ্ণায়নের ফলে প্রাণীর আকারে মৌলিক পরিবর্তন হতে পারে।
প্রাণীরা যে তাদের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেদের অঙ্গগুলো ব্যবহার করে- এটা প্রচলিত অনেক আগে থেকেই। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান হাতিরা তাদের বৃহৎ আকৃতির কানে উষ্ণ রক্তের স্রোত প্রবাহিত করে। এরপর কান ঝাড়া দেওয়ার ফলে গরম তাপমাত্রা শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। পাখির ঠোঁট একই কাজ করে। পাখির অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তারা রক্তের প্রবাহ নিজেদের চঞ্চুর দিকে ঠেলে দেয়। থার্মাল ইমেজ বিশ্লেষণে এমন প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।
উষ্ণ স্থানগুলোতে বৃহদাকৃতির উপাঙ্গগুলো প্রাণীদের সুবিধা দেয়। ১৮৭০ এর দশকে আমেরিকান প্রাণীবিজ্ঞানী জোয়েল অ্যালেনের পর্যবেক্ষণেও এসেছে এমন চিত্র। তিনি দেখেছেন, এন্ডোথার্ম বলে পরিচিত উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের ঠান্ডা আবহাওয়ায় উপাঙ্গগুলো ক্ষুদ্র আকৃতিতে রাখার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু উষ্ণ আবহাওয়ায় এই পরিস্থিতি বদলে যায়, প্রাণীরা উপাঙ্গগুলোর আকার বৃদ্ধিতে মনোযোগী থাকে। এই প্রবণতা পরিচিতি পেয়েছে অ্যালেন নীতি নামে। এই প্রবণতা পক্ষীকূল এবং স্তন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
পাখির চঞ্চুতে কোনো পালক থাকে না। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে অনেকেরই কান, লেজ এবং পায়ের দিকে পশম দ্বারা আবৃত থাকে না। এগুলো সবই তাই তাপ বিনিময়ের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এই সুবিধাই কাজে লাগাচ্ছে প্রাণীরা। গবেষকরা পাখিদের আকৃতি পরিবর্তনের বেশিরভাগ নথিভুক্ত উদাহরণ খুঁজে পেয়েছেন। এর মধ্যে পাখির ঠোঁট বা চঞ্চুর আকার বৃদ্ধি ছিল অন্যতম। গবেষকরা অস্ট্রেলিয়ান তোতাপাখির বেশ কয়েকটি প্রজাতির উদাহরণ সামনে এনেছেন। তারা গবেষণায় দেখেছেন, ১৮৭১ সাল থেকে গ্যাং-গ্যাং ককাটু এবং রেড রাম্পড এই দুই প্রজাতির তোতা পাখির ঠোঁটের আকার ৪-১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উপাঙ্গগুলোও আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ গবেষকরা বলছেন, ১৯৫০ সাল থেকে মুখোশযুক্ত শ্রুর লেজ এবং পায়ের দৈর্ঘ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে গ্রেট রাউন্ডলিফ বাদুড়ের ডানার আকার ১.৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের উদাহরণ ইঙ্গিত করে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে প্রাণীদের বিভিন্ন ধরনের উপাঙ্গ এবং আকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু কোন ধরনের প্রাণী সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় তা নির্ধারণ করতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
সারা রাইডিংয়ের মতে, আকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে এর অর্থ এই নয় যে, প্রাণীরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, বরং ব্যাপারটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ নয়। এই ঘটনাগুলো প্রাণীদের বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার চেষ্টারই বহিঃপ্রকাশ।
এই পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, “এখন যেসব পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা সব মিলিয়ে ১০ শতাংশেরও কম হবে। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পরিবর্তন চোখে পড়ে না। কিন্তু এভাবে যদি প্রাণীদের কান বড় হতে থাকে, তাহলে সামনের দিনগুলোতে বাস্তবেই হয়তো ডাম্বোর মতো প্রাণীদের দেখতে পাওয়াটা অস্বাভাবিক হবে না।” ডাম্বো ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশনের একটি কাল্পনিক/এনিমেটেড চরিত্র।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় মানুষের করণীয় নিয়ে সকলকেই চিন্তা করতে দেখা যায়। কিন্তু মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর বিষয়ে তেমন কোনো ভাবনা দেখা যায় না সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। আমরা নানাভাবে যে জলবায়ুগত সংকট তৈরি করেছি তা প্রাণীদের উপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করছে, এবং কিছু প্রজাতি এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেও অন্যরা সেটা পারবে না। অনেক প্রাণীকে ক্ষুদ্রাকৃতির ঠোঁট দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু খাবারই খেতে হয়। এক্ষেত্রে ঠোঁটের আকৃতি পরিবর্তন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে তাদের জন্য। রাইডিং বলছেন, এসব পরিবর্তন অন্য কোনো উপায়ে প্রাণীদের প্রভাবিত করবে কিনা তা-ও এখনও স্পষ্ট নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শারীরিক গঠনে পরিবর্তন এনে প্রাণীরা নিজেদের জীবন হুমকির মুখে ফেলছে কিনা সেটাও বলা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা তাই ভবিষ্যতে এসব নিয়ে আরো গবেষণার পরিকল্পনা করছেন।