হাইস যখন কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউলে প্রবেশ করলেন, তার কাছে মনে হচ্ছিল দুনিয়া উল্টে যাচ্ছে। এর একটা কারণ ছিল কমান্ড মডিউল আর লুনার মডিউল যেভাবে যুক্ত ছিল, তাতে কমান্ড মডিউলের মেঝে ছিল লুনার মডিউলের ছাদের সাথে যুক্ত। সেখানে কোনো বাতি ছিল না। শুধুমাত্র তার সাথে নিয়ে যাওয়া কিছু ফ্ল্যাশলাইট ছিল। কমান্ড মডিউলের অভ্যন্তরীণ অংশ ছিল কোণকাকৃতির। অন্যদিকে লুনার মডিউল ছিল বেলনাকৃতির। যদিও সেটা বোঝার উপায় ছিল না। কারণ দেয়াল থেকে বিভিন্ন ক্যাবিনেট আর কনসোল ঝাঁকুনি দিয়ে ঝুলছিল।
লুনার মডিউলে শুধুমাত্র দুইজন নভোচারীর ধারণক্ষমতা থাকায় তৃতীয় ব্যক্তির জন্য সেখানে জায়গা করা কঠিন কাজ ছিল। এটার কেবিন ছিল কমান্ড মডিউলের চেয়ে ছোট। ড্যাশবোর্ড প্যানেল ছিল কমান্ড মডিউলের চেয়ে ছোট। কিছু কিছু যন্ত্রপাতি কমান্ড মডিউলের মতোই ছিল। সেখানে বসার কোনো আসন ছিল না। নভোচারীদের তাই থ্রাস্টার রকেটের হ্যান্ড কন্ট্রোল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পাশের দেয়ালের নিচের দিকে দুটি ত্রিভুজাকৃতির জানালা ছিল চাঁদে অবতরণের পর নভোচারীরা সেখানের ভূপৃষ্ঠ দেখার জন্য। কিন্তু এই জানালা দিয়ে হাইস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সার্ভিস মডিউলের অবস্থা দেখতে পারছিলেন না।
হাইসকে তখন লুনার মডিউল সচল করতে হচ্ছিল। তিনি তিনটা নির্দেশনা খুঁজে পেলেন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে লুনার মডিউল চালু করা বিষয়ে। কিন্তু কোনোটাই সে মুহূর্তের পরিস্থিতির সাথে মিলছিল না। কারণ তিনটি বিষয়ই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউলে বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত থাকা অবস্থায়। ফ্লাইট ডিরেক্টর তখন টেলমুকে জিজ্ঞেস করেন তার কাছে কোনো নির্দেশনা আছে কিনা এ ব্যাপারে। কয়েক মিনিট ঘাঁটাঘাঁটি করার পর টেলমু কিছু নির্দেশনা নিয়ে আসেন, যেখানে লুনার মডিউলকে সচল করতে হতো এর নিজস্ব ব্যাটারি দিয়ে।
এদিকে কিছু রুটিন নির্দেশনা ছিল যেগুলো করা হয়েছিল লুনার মডিউল চাঁদে অবতরণে অনেক সময় লাগবে বিবেচনা করে। ফলে সকল ধাপের কাজ সবচেয়ে সরল উপায়ে শেষ করে লুনার মডিউল সচল করতে প্রয়োজনীয় সময় দাঁড়ালো দুই ঘণ্টায়। এদিকে ক্যাপকম থেকে অশুভ খবর আসলো কমান্ড মডিউলে আর মাত্র ১৫ মিনিট চলার মতো বিদ্যুৎ অবশিষ্ট আছে।
বিশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা না থাকায় হাইস আর টেলমুকে নতুন করে একটা নির্দেশনা বানাতে হলো। তারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে কিছু করার জন্য প্রশিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু তারা স্পেসক্রাফট সম্পর্কে ভালোভাবে জানতেন। তাই একটা পদ্ধতির কথা ভাবলেন যেটা তারা সহজেই করতে পারবেন। এই সুবিধার ওপরই তাদেরকে পরবর্তী কিছুদিন নির্ভর করতে হবে। টেলমু তার সামনে থাকা নির্দেশনাগুলো আগে পেছনে নিয়ে বিভিন্নভাবে সাজাতে থাকলেন।
তিনি হাইসকে তখনই লুনার মডিউলের মূল রকেট চালু করতে নিষেধ করেন। এটা কিছুক্ষণ পর করতে বলেন। কিন্তু তাকে তাড়া দেন লুনার মডিউলের গাইডেন্স সিস্টেম চালু করতে। এতে যখন পথনির্দেশিকা সংক্রান্ত নাম্বারগুলো কমান্ড মডিউল থেকে স্থানান্তরিত করা হবে, তখন এটি প্রস্তুত থাকবে। টেলমুর মনে যখন এ সংক্রান্ত চিন্তার ঝড় বইছিল, তখন তিনি ইইকম থেকে ফোন পান হাইসকে দ্রুত বলার জন্য লুনার মডিউলের অক্সিজেন চালু করতে। কারণ কমান্ড মডিউলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিকে মাথায় নিয়ে প্রস্তুতির পরেও ফ্লাইট ডিরেক্টর শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধান আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলেন। ক্রাঞ্জ যেভাবে লিবারগটের কাছ থেকে উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু শুনতে চাচ্ছিলেন, লানিও তার ইইকমের কাছ থেকে এমন কিছুর পরামর্শই চাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনিও লিবারগটের মতো নিরাশ করতে থাকেন। ফ্লাইট ডিরেক্টর দুই নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের তাপমাত্রা ও চাপের হিসাবে সচল থাকার লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন, যেটা বিস্ফোরিত হয়েছিল। তিনি ইইকমকে তখন জিজ্ঞেস করেন, এতে এখনো অক্সিজেন থাকার সম্ভাবনা আছে কিনা।
ইইকম উত্তর দেন, “সেরকম সম্ভাবনা নেই, ফ্লাইট।”
কয়েক মিনিট পর ফ্লাইট ডিরেক্টর নতুন উপায় খোঁজার চেষ্টা করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ইইকম, দুটি অক্সিজেন ট্যাঙ্কই নিষ্ক্রিয় হতে চলেছে, কিন্তু আমরা কোনো সাহায্য করতে পারছি না। আপনি কি ব্যাপারটাতে সন্তুষ্ট? আমরা যদি মেইন বি বাসের শক্তি দিয়ে দুই নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপ বাড়াতে পারি?”
ইইকম জবাব দেন, “আমরা সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না, ফ্লাইট।”
তবুও ইইকম নভোচারীদের পরামর্শ দিলেন অক্সিজেন ট্যাঙ্কের পাখাগুলো চালু করতে। একই কাজ আগের ইইকমও করতে বলেছিলেন, যা বিস্ফোরণকে ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু এতেও কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।
ইইকম তখন বলেন, “তাদেরকে (নভোচারীদের) এখন লুনার মডিউলে পাঠাতে হবে, ফ্লাইট।”
ফ্লাইট ডিরেক্টর তখন ক্যাপকমকে বলেন, “তাদেরকে লুনার মডিউলে যেতে বলুন। লুনার মডিউলে তাদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে।”
লাভেল তখন কমান্ড মডিউলে সুইগার্টকে একা রেখে লুনার মডিউলে হাইসের সাথে যোগ দিলেন। সুইগার্ট তখন কমান্ড মডিউলে থাকা জ্বালানি কোষের বেশিরভাগ থ্রাস্টার আর পাম্প বন্ধ করে দিলেন। শুধুমাত্র কেবিনের বাতি, রেডিও, গাইডেন্স সিস্টেম, আর অক্সিজেন ট্যাঙ্কে থাকা পাখা আর হিটারগুলো সচল রাখা হয়েছিল। কন্ট্রোল রুমে থাকা গাইডো ফ্লাইট ডিরেক্টরকে বলছিলেন কমান্ড মডিউলের সবকিছু বন্ধ করে ফেললেও গাইডেন্স সিস্টেমে থাকা হিটারগুলো যেন বন্ধ না করা হয়।
কোনো অভিযানের সময় এই হিটারগুলোকে কখনো বন্ধ করা হয়নি। যদি গাইডেন্স সিস্টেমে থাকা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি অত্যাধিক ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে, তাহলে এগুলো চার দিন কাজ করার মতো অবস্থায় থাকার নিশ্চয়তা ছিল না। এগুলো বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় কমান্ড মডিউলকে দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। ফ্লাইট ডিরেক্টর তখন জানান, তিনি দেখছেন কী করা যায়। তবে তিনি এতটুকো নিশ্চয়তা দিলেন যে, টেলমু এখানের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিতে চাইবে না।
গাইডেন্স কম্পিউটার তখনো চালু ছিল। কারণ কমান্ড মডিউল নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার আগে এটা আরেকটা কাজ করতে সক্ষম ছিল। সেটা হচ্ছে লুনার মডিউলের গাইডেন্স সিস্টেমের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে কাজ করা। কমান্ড মডিউল থেকে দিক নির্দেশনা সম্পর্কিত তথ্য লুনার মডিউলে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন ছিল। কমান্ড মডিউল আর লুনার মডিউলের অবস্থান একই সমতলে ছিল না। তাই লুনার মডিউলের কৌণিক অবস্থান নতুন করে হিসাব করতে হচ্ছিল।
এদিকে লাভেল তখন চোখে স্পষ্ট দেখতে না পাওয়ায় কন্ট্রোল রুমে জিএনসি’কে অনুরোধ করেন হিসাব করে দিতে। যখন তিনি লুনার মডিউলের গাইডেন্স কম্পিউটারে সর্বশেষ সঠিক নাম্বার চাপলেন, অনুভব করেন বাড়ি ফিরে আসার প্রথম মাইলফলক অর্জন করার। গাইডেন্স সম্পর্কিত তথ্য স্থানান্তরের মাধ্যমে লুনার মডিউল প্রাণ ফিরে পেল অনেকটা ঠাণ্ডা ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলে উঠার মতো।
এদিকে সুইগার্টের মাথার ওপরে থাকা সতর্ক বার্তা দেওয়া হলুদ বাতি জ্বলে উঠল। এটা নির্দেশ করছিল মেইন বাস এ এর ভোল্টেজ কমে যাচ্ছে। সুইগার্ট দ্রুত থ্রাস্টার আর গাইডেন্স কম্পিউটার বন্ধ করলেন। এমনকি তিনি হিটারগুলোও বন্ধ করে দিলেন। জিএনসি এ সম্পর্কে ফ্লাইট ডিরেক্টরকে বলেন, সুইগার্ট এখানে ঠাণ্ডার কারণে কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ক্ষতি না হওয়ার জুয়া খেলতে চাচ্ছেন।
এরপর বাকি ছিল অবশিষ্ট জ্বালানি কোষের রিয়েকট্যান্ট ভালভ। এই ভালভটিও বন্ধ করে দেওয়ার পর কমান্ড মডিউলের পাইলট সুইগার্ট বাকি দুই নভোচারীদের বলেন, এখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার দায়িত্ব তাদের ওপর। কমান্ড মডিউল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। আমেরিকান প্রযুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন চূড়ান্তভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল। বাকি ছিল একটা স্পেসক্রাফট যার জটিলতার কারণে একে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। সাথে ছিলেন ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের দল আর তিন নভোচারী, যারা পরিণত হয়েছিলেন ত্রুটিপূর্ণ স্পেসক্রাফট তৈরি করা বিশাল আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রের পণ্যে। স্পষ্টভাবেই এটা তাদেরকে এই বিপর্যয় থেকে বের হওয়ার পথ আরো কঠিন করে তুলছিল। একগুঁয়ে স্পেসক্রাফটের প্রতি তাদের ইচ্ছাশক্তি ধরে রাখাও কঠিন ছিল।
সেই দুর্ঘটনা কিছু প্রযুক্তিগত আনুষঙ্গিক বস্তুও ধ্বংস করে দিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল কিছু চেকলিস্ট, ফ্লাইট পরিকল্পনা, স্পেসক্রাফটের কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালনা করার মতো যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। ফলে তাদের কার্যক্রম হয়ে পড়ছিল ধীর গতির। তখন ফ্লাইট কন্ট্রোলার আর নভোচারীদের মধ্যে সমুদ্রের ঝড়ের সম্মুখীন হওয়া নাবিকদের সাথে কোনো পার্থক্য ছিল না।
বিস্ফোরণের পর তিন ঘণ্টা পেড়িয়ে গেছে তখন।
(এরপর দেখুন পর্ব ১০ এ)