সময় ১৮৪৬ সাল, ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর গিলবার্ট অ্যাবোটের ঘাড়ে টিউমার রয়েছে। বাঁচতে হলে অপারেশন করা প্রয়োজন। প্রধান সার্জন জন কলিন্স ওয়ারেন। সে সময়ে অপারেশন মানেই অসম্ভব এক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়া। বর্তমানে অপারেশনের সময় একজন রোগীকে যেভাবে অজ্ঞান করে নেয়া হয় সেই চল তখনো শুরু হয়নি। মানুষ সহজে অপারেশনের ভেতর দিয়ে যেতে চাইতো না। যেটা না করলেই নয়, বাঁচতে হলে করতেই হবে সেটিতেই কেবল রাজী হতো মানুষ।
গিলবার্টের অপারেশনের আগেরদিন এক ডেন্টিস্ট এসে জন কলিন্স ওয়ারেনের সঙ্গে দেখা করলেন। ডেন্টিস্টের নাম থমাস গ্রিন মর্টন। মর্টনের দাবি, তিনি এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন ইথার ব্যবহারের মাধ্যমে, যার দ্বারা একজন মানুষকে অচেতন করে রাখা সম্ভব। তার শরীরের কোথাও কাটাকুটি করা হলে সে আর টের পাবে না।
মর্টন আরো বললেন, মানুষের দাঁত তুলতে সবসময়ই তাকে বাজে এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হতো। তাই তিনি এ নিয়ে কাজ শুরু করেন, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন যে, ইথার ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে অচেতন রেখে যেকোনো ধরনের সার্জিক্যাল পদ্ধতি প্রয়োগ সম্ভব। তিনি এমন এক যন্ত্র নির্মাণ করেছেন যার ভেতরে ইথার রাখা হলে একজন মানুষ যন্ত্রটি থেকে প্রশ্বাসের মাধ্যমে ইথার টেনে নিতে পারবে। এতে মানুষটি ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়বে।
গিলবার্টের প্রধান সার্জন ওয়ারেন মর্টনের কথায় আশার আলো দেখতে পেয়ে সুযোগ করে দেন গিলবার্টের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালানোর জন্য। মর্টন আগেও এই যন্ত্রটি ব্যবহার করেছেন নিজের রোগীদের উপর। কিন্তু সেটি কেবল দাঁত তুলতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তাই তিনি চেয়েছিলেন আরো বড় ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম। সত্যিকার অর্থেই শরীরের কাঁটাছেঁড়ায় ব্যবহার করে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।
১৭৭৩ সালে জোসেফ প্রিস্টলি আগেও একবার নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড প্রয়োগে মানুষকে অচেতন করে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে ব্যবস্থাটি তেমন আশাজনক হয়নি। কিন্তু মর্টন একজন রসায়নের অধ্যাপকের সাথে আলোচনা করে সালফিউরিক ইথার ব্যবহার করে যে যন্ত্রটি নির্মাণ করেন, তার ফলাফল আশাজনক ছিল। শুধু বাকি ছিল পরীক্ষা করে দেখা।
১৮৪৬ সালে প্রথমবারের মতো ওয়ারেনের অধীনে গিলবার্টের অপারেশনে ইথার ব্যবস্থাটি প্রয়োগ করেন মর্টন। গিলবার্টের ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়া এবং অপারেশন শেষে তার মতামতকে কেন্দ্র করে মানব ইতিহাসের প্রথম সফল অপারেশনটি সম্পন্ন হয়েছে বলে রায় দেন ওয়ারেন। সেই সাথে মর্টন ব্যাপক পরিচিতি পান নিজের আবিষ্কৃত অচেতন করবার যন্ত্রটির জন্য।
এই অ্যানেস্থেশিয়া অর্থাৎ অচেতন করবার পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্বে একজন মানুষের হাত-পা, শরীরের যেকোনো স্থানে কাঁটাছেঁড়া করা হতো সম্পূর্ণ চেতন অবস্থায়। ব্যথা দূর করার কোনো ব্যবস্থা তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। চিৎকার আর কাতরানোর মধ্য দিয়েই অপারেশন সম্পন্ন করা হতো। আফিম কিংবা মদের নেশা তৈরি করার রীতি প্রচলিত ছিলো, তবে সেটা ততটা কার্যকর ছিলো না। ব্যথা কিংবা অপারেশনের সেই স্মৃতিকে একজন রোগী আর কখনো ভুলতে পারতো না।
মর্টনের যন্ত্রটি সেই সময়ে ছিলো যুগান্তকারী। ধীরে ধীরে হাজারো পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে অপারেশনের পূর্বে মানুষকে অচেতন করা নিয়ে, গড়ে উঠেছে অ্যানেস্থেশিয়ার সম্পূর্ণ পৃথক এক বিভাগ। অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের ফলে মাংসপেশিগুলো শিথীল হয়ে আসে। রোগী একধরনের ঘোরের মাঝে চলে যায়, ফলে সে আর ব্যথা কিংবা কোনোরূপ স্পর্শানুভূতি টের পায় না।
বর্তমানে দুই ধরনের অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের বিধান রয়েছে; লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া ও জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া।
শরীরের নির্ধারিত কোনো অংশকে যখন অচেতন করা হয় তখন তাকে বলে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া। এক্ষেত্রে পুরো শরীর অচেতন করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া যে স্থানে প্রয়োগ করা হয়, তাকে যে স্নায়ু স্পর্শানুভূতি দিয়ে থাকে, অ্যানেস্থেশিয়ার মাধ্যমে সেই স্নায়ুকে সাময়িক অকেজো করে দেয়া হয়। ফলে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগকৃত স্থান থেকে কোনোরূপ স্পর্শানুভূতি নিয়ে মস্তিষ্কে যেতে পারে না নার্ভটি। ডেন্টিস্টগণ হরহামেশাই রুট ক্যানেলের সময় নোভোকেইন ব্যবহার করে থাকেন, এই নোভোকেইন মুখ গহ্বরের নার্ভগুলোকে সাময়িক অকেজো করে রাখে। ফলে রুট ক্যানেল করার সময় একজন রোগী আর ব্যথা পায় না।
অপরদিকে যখন কোনো অপারেশনে পুরো শরীর অচেতন করার প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন যে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয় সেটি হলো জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া। এই অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে রোগীর অপারেশনের ব্যাপারে কোনো স্মৃতি মনে থাকে না। এক্ষেত্রে আবার জটিলতাও রয়েছে, জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে অপারেশন করা হলে একজন সার্জনকে খেয়াল রাখতে হবে রোগীর রক্তচাপ, স্ট্রেস হরমোন তৈরি এবং হৃৎপিন্ডে রক্ত প্রবাহের গতি সবকিছু যাতে ধ্রুবক থাকে।
শুরুর দিকে যদিও অ্যানেস্থেশিয়া হিসেবে ইথার কিংবা ক্লোরোফর্ম ব্যবহৃত হতো, বর্তমানে তা আর হয় না। ক্লোরোফর্ম কিংবা ইথার ব্যবহার অনেক সহজ ছিল, বিশেষ করে ক্লোরোফর্ম। কাপড়ে সামান্য নিয়ে নাকে চেপে ধরো তাহলেই হবে। কিন্তু এর সমস্যা হলো ডোসেজ নিয়ন্ত্রণ করা যেতো না। একজন মানুষকে কতক্ষণ অচেতন রাখতে হবে সেটিও নিয়ন্ত্রণ করা যেতো না।
অ্যানেস্থেশিয়াগুলো বর্তমানে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তিনভাবে। ১. নির্ধারিত অঙ্গের অনুভূতি দানকারী নার্ভে; ২. শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে; ও ৩. শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে।
মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের অসংখ্য নার্ভের মাধ্যমে পুরো শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সেই সাথে পুরো শরীরে স্পর্শানুভূতি প্রদান করে থাকে মস্তিষ্ক। কোথাও আঘাত পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানের স্নায়ু অনুভূতি পৌঁছে দেয় মস্তিষ্কের পেইন রিসেপ্টরে। এভাবেই আমরা বুঝতে পারি ব্যথার অনুভূতি। ত্বকের প্রতিটি অংশে এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ সমস্ত অঙ্গের সাথেই মস্তিষ্ক যুক্ত রয়েছে।
সকল অনুভূতি নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে যাতায়াত করে ইলেক্ট্রিক সিগন্যাল হিসেবে। শরীরের যে অংশটি অচেতন করার প্রয়োজন হবে, সেখানকার নার্ভে যদি এমন কোনো ব্যারিকেডের ব্যবস্থা করা যায় যার দরুন স্নায়ুটি সাময়িকভাবে মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগে অক্ষম হয়ে পড়ে। তাহলেই সেই স্থানের অনুভূতি আর মস্তিষ্কে পৌঁছাবে না।
এভাবে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া করা হয়, কিন্তু যদি শরীরের পুরো স্নায়ুতন্ত্রকে সাময়িকভাবে বিরত রাখতে হয় তখন আর এই পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ধ্রুব হারে অচেতনকারী গ্যাসীয় পদার্থের চালনার মাধ্যমে এমনটি করা হয়ে থাকে।
সালফিউরিক ইথারের ব্যবহার দিয়ে সফল যাত্রা শুরু করেছিলো অ্যানেস্থেশিয়া। বর্তমানে ইথার শ্রেণির ডাইইথাইল ইথার ব্যবহৃত হয় সরাসরি প্রশ্বাসের সঙ্গে। এক দশক পরেই মানুষ নাইট্রাস অক্সাইড নামক একধরণের গ্যাসীয় পদার্থের ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করে যা মানুষের হাসির উদ্রেক তৈরি করে। এই গ্যাসটি ‘লাফিং গ্যাস’ নামে পরিচিত। এই লাফিং গ্যাস এখনো ব্যবহৃত হয়ে থাকে প্রয়োজন অনুসারে। সেই সাথে ইথার থেকে তৈরিকৃত ‘সেভুফ্লুরেন’ ব্যবহৃত হয় জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়ায়।
শ্বাস-প্রশ্বাসে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের পাশাপাশি জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়ায় শিরায় দুই ধরনের তরল পদার্থ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। একটি হলো প্রোপোফল, অপরটি ফেন্টেনিল। প্রোপোফল রোগীকে অচেতন করে তোলে আর সেই সাথে ফেন্টেনিল প্রয়োগে অচেতন অবস্থায় রোগীর অনুভূতি যাতে মস্তিষ্কে না পৌঁছাতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়।
আমাদের জাগ্রত অবস্থায় মস্তিষ্কে বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে। মস্তিষ্কের সবগুলো অংশ পরস্পরের সাথে হ-য-ব-র-ল ভাবে যোগাযোগ করতে থাকে। কিন্তু আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি কিংবা অজ্ঞান থাকি, তখন সেই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেমে যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটে তার সুষ্ঠু ধারণা যদিও নেই, তবে বেশ কিছু হাইপোথিসিস রয়েছে এর পেছনে।
অপারেশন করা হয়ে থাকে যদি আপনার, অপারেশনের শুরুতেই অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় রয়েছে। লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে আপনি পুরোপুরি অচেতন হবেন না, কেবলমাত্র শরীরের নির্দিষ্ট অংশ অবশ হয়ে থাকে। আর যদি জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয়, তাহলে আপনার স্মৃতি ঘেঁটে দেখুন, দশ থেকে উল্টো গণনা করার স্মৃতিটুকুই মনে আছে, আর কিছু মনে থাকবে না। বিশাল এক ঘুম দিয়ে জেগে উঠেছেন আপনি, আনন্দের ব্যাপার হলো আপনার অপারেশন শেষ।
অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ শুরুর প্রথম দিকে কোনো মাপজোখ করা হতো না ডোসেজের ব্যাপারে। বর্তমানে সবকিছুই পরিমাপ দেখা হয়, আপনার কোনো অ্যালার্জি কিংবা অতীত রোগ রয়েছে কিনা। আপনার বয়স, জীবনযাপন রীতি সবকিছু বিবেচনা করে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয়। সুতরাং সচেতন হন, চিকিৎসকের কাছে নিজের অতীত রোগের ইতিহাস কিংবা কোনো শারীরিক ব্যাপার যা যা জানতে চাওয়া হবে, কোনোকিছুই লুকাবেন না। আপনার সামান্য ভুলের দরুণ অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে গোলমাল লেগেও যেতে পারে। তাই আপনি নিজে সাবধান হন, পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সাবধান করুন।
ফিচার ইমেজ- medicalnewstoday.com