বিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, আকাশপথে জার্মানির গর্ব ছিল জেপেলিন হাইডেনবার্গ নামক একটি এয়ারশিপ। কারিগরি দিক দিয়ে এই বায়ু জাহাজ তখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক আধুনিক ছিল। এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় তিনটি ফুটবল মাঠের সমান। এক বিস্ময়কর আবিষ্কার ছিল এই হাইডেনবার্গ। তখনকার সময়ে সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘ উড়ন্ত যান ছিল এই শিপটি। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই অনেকবার আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল এই আকাশযান। ক্রু মেম্বার এবং যাত্রীদের নিয়ে প্রায়ই আকাশে পাড়ি জমিয়ে আমেরিকায় যেত এই হাইডেনবার্গ।
জার্মান জেপেলিনগুলো হাইড্রোজেন গ্যাসের উপর নির্ভরশীল ছিল। হাইডেনবার্গের ভিতরে ১৬টি হাইড্রোজেন গ্যাসের সেল ছিল যা একে আকাশে উড়তে সাহায্য করতো। এই গ্যাসগুলো দাহ্যতার (Flammability) কারণে অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল। এর আগে অনেকগুলো সফল যাত্রা করলেও ১৯৩৭ সালের মে মাসের ৬ তারিখ ছিল অন্যরকম। সেদিন হাইডেনবার্গ লেকহারস্টে ইউ এস নেভাল এয়ার স্টেশনে ল্যান্ড করার জন্য প্রস্তুত ছিল। ল্যান্ড করার আগমুহূর্তে হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়ে এতে আগুন ধরে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো আকাশযানটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আকাশযানটি পুড়ে মাটিতে পতিত হয়। এর ফলে ৩৬ জন সেখানেই নিহত হয় এবং অনেক লোকজন আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিল ১৩ জন যাত্রী, ২২ জন শিপের ক্রু এবং একজন গ্রাউন্ড ক্রু মেম্বার। কিন্তু এমন বিস্ফোরণের কারণ কী ছিল? [১]
এয়ারশিপটি ল্যান্ড করার সময় আমেরিকার নেভাল এয়ার স্টেশনে প্রচুর ঝড় বৃষ্টি আর বজ্রপাত হচ্ছিলো। সেজন্য এয়ারশিপের ক্রুরা বৃষ্টি কমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। সকালের দিকে বৃষ্টি একটুখানি কমার পর শিপ থেকে ক্রুরা গ্রাউন্ড ক্রুদের কাছে দড়ি নামিয়ে দেয়। গ্রাউন্ড ক্রুরা দড়িগুলো ভূমিতে পুঁতে দেয়ার পরপরই এয়ারশিপটির পেছন থেকে তিন ভাগের এক ভাগ দূরত্বে বিরাট এক বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের কারণে শিপের বাইরের ফেব্রিক নির্মিত আবরণে আগুন ধরে যায় এবং ভিতরের দিকে সেই আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে এবং পুরো আকাশযান নিমিষেই ভূপতিত হয়।
অন্তত ৩৪ বার হাইডেনবার্গ জার্মানি থেকে আমেরিকায় গিয়েছিল, এর মধ্যে ২,৭৯৮ জন যাত্রী এতে যাওয়া-আসা করে। প্রত্যেক যাত্রায় প্রায় ৫০ জন করে যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করা যেত এই এয়ারশিপটিতে। এতবার যাতায়াত করার পর কেন মে মাসের এই তারিখে এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটলো? কী এমন হয়েছিলো সেই মুহূর্তে? পরবর্তীতে অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, এয়ারশিপ থেকে নামিয়ে দেয়া সেই দড়িগুলোর জন্যই এমনটা হয়েছে এবং এর পেছনে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের একটি ছোট্ট ধারণা। [২]
সেদিন সকালবেলাতে গ্রাউন্ড ক্রুরা শিপের দড়িগুলো ভূমির সাথে আটকাচ্ছিল যাতে করে এয়ারশিপটি এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, এ সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। তাই দড়িগুলো ভূমিতে পুঁতে রাখার সময় ভিজে গিয়েছিলো। এই দড়িগুলোকে ভূমিতে আটকে রাখার জন্য ধাতব ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়েছিলো।
দড়িগুলো যখনই বৃষ্টির পানির সংস্পর্শে আসলো তখনই তা বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থে পরিণত হয়ে পড়ল। আবার ধাতব বস্তুর সাথে দড়িগুলো ভূমিতে লাগানোর ফলে ধাতব বস্তু এবং ভূমির (পৃথিবীর মাটি) মধ্যে একধরনের পরিবাহী পথ তৈরি হলো। এখানে পৃথিবীর নিজস্ব বৈদ্যুতিক বিভব এবং ধাতব ফ্রেমওয়ার্কের বিভব অভিন্ন হয়ে পড়লো।
যেহেতু আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না এবং বজ্রপাতের কারণে বায়ুমণ্ডলও বৈদ্যুতিক বিভব আক্রান্ত হয়েছিলো, তাই এয়ারশিপের বাইরের আবরণও এই বিভবের প্রভাব মুক্ত ছিল না। আবার, এই আবরণগুলো লেয়ারে বিভক্ত ছিল, যেগুলো বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রতিরোধ করে। যেহেতু বজ্রপাতের কারণে বৈদ্যুতিক বিভব সৃষ্টি হয়েছিল, সে কারণে ৪৩ মিটার উচ্চতায় এয়ারশিপটির মধ্যে এই বৈদ্যুতিক বিভবের সৃষ্টি হয়। এখানে উল্লেখ্য, বাইরের আবরণকেও ভূমির সাথে সংযোগ করে দেয়া উচিত ছিল। [৩, ৪]
প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হবার কারণে এই বিভব পার্থক্য ভূমির তুলনায় অনেক গুণ বেশী ছিল। এরকম হওয়াটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এয়ারশিপের আবরণে অর্থাৎ ফেব্রিকের মধ্যে ভূমির ধাতব ফ্রেমওয়ার্ক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈদ্যুতিক বিভবের সৃষ্টি হয়েছিলো। এরকম অবস্থায় বৈদ্যুতিক চার্জ বা ইলেকট্রনগুলো ভেজা দড়ি দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকবে। যেহেতু এয়ারশিপের বাইরের আবরণও ভেজা, তাই সেই ফেব্রিক দিয়েও চার্জ প্রবাহিত হতে থাকবে। আসল ঘটনাটিও এরকমই ঘটেছিলো। এই চার্জ প্রবাহিত হতে হতে এয়ারশিপের ফেব্রিক আবরণের ভিতরের দিকে শিপের নিজস্ব যে ধাতব গঠন আছে সেখানে এক বিরাট স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করে এবং এই স্ফুলিঙ্গ থেকেই পুরো এয়ারশিপে আগুন ধরে যায়। এই আগুন ধরা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুটি সম্ভাবনার কথা স্বীকার করা হয়েছে।
১। স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হবার পর সেটা এয়ারশিপের ফেব্রিকের সিলের আবরণগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়।
২। কোনো একটি দড়ি, যেগুলো নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছিলো, সেগুলোর কারণে এয়ারশিপের ভিতরে থাকা কোনো একটি হাইড্রোজেন গ্যাস সমৃদ্ধ সেল ফেটে (Rupture) যায়। ফলে গ্যাস বের হয়ে ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। [১]
অনুসন্ধান করার পর দ্বিতীয় সম্ভাবনাকেই সবাই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছিল। কারণ প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এবং রিপোর্টে আসে যে, ল্যান্ডিং এর সময় দড়িগুলো যখন এয়ারশিপের ক্রুরা নিচে নামিয়ে দেয় তখন এয়ারশিপের যেখানে আগুন ধরে সেখানকার বাইরের আবরণে এক ধরণের মৃদু তরঙ্গ (Rippling) সৃষ্টি হয়েছিলো। এখান থেকে সবার ধারণা হয় যে, কোনো একটি সেল থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস বের হয়ে আসে। এই কারণে বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্য, ভেজা দড়ি ও আবরণের কারণে প্রবাহিত চার্জ যখন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করে তখন সেটা লিক হয়ে যাওয়া হাইড্রোজেন গ্যাসকে জ্বালিয়ে দেয় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণের পরপরই পুরো এয়ারশিপ পুড়ে গিয়ে নিচে নেমে আসে। অনেক গবেষণায় এরকম প্রস্তাবনা এসেছে যে, যদি হাইডেনবার্গ এর বাইরের ফেব্রিক আবরণগুলো বৈদ্যুতিক পরিবাহী হতো (যা এখনকার জেপেলিনগুলোতে দেখা যায়) তাহলে এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটতো না। [১]
এই দুর্ঘটনার অনুসন্ধান কমিটিতে জার্মানির পক্ষ থেকে ছিলেন প্রোফেসর ডিকম্যান, যিনি বায়ুমণ্ডলীয় বিদ্যুৎ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। তিনি প্রথমে এরকম দুর্ঘটনা যেভাবে ঘটতে পারে সেরকম ৫টি কারণ উল্লেখ করেন।
প্রথমত, এয়ারশিপের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস এবং বায়ুর মিশ্রণের ফলে দাহ্যতা সৃষ্টি হওয়া।
দ্বিতীয়ত, বাইরের ভেজা আবরণ।
তৃতীয়ত, বায়ুমণ্ডলের চার্জিত হওয়া।
চতুর্থত, এয়ারশিপ থেকে নেমে আসা ভেজা দড়ি।
পঞ্চমত, এয়ারশিপের ল্যান্ডিং উচ্চতা।
পরবর্তীতে তার কারণগুলো নিয়ে তিনি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তার দেয়া কারণগুলোর উপযুক্ত ব্যাখ্যা ছিল। তাই কমিটি তার ব্যাখ্যাগুলোকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়নি। পরবর্তীতে এই কারণগুলোই রিপোর্ট হিসেবে আসে। জার্মান জেপেলিন পরিবার অবশ্য এই ব্যাখ্যার পুরোটুকু মানতে চায়নি, কারণ তাদের কাছে একবারের জন্যও মনে হয়নি এয়ারশিপের ভিতরের কোনো কারণে এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে বাইরের পরিবেশের কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।[১]
যা-ই হোক, এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে নির্মিত এয়ারশিপের বডিগুলো একটু ভিন্নভাবে নির্মিত হয়েছিলো। যে কারণে দুর্ঘটনার কথা তেমন শোনা যায় না। তাছাড়া এয়ারশিপ কোম্পানিগুলোও এখন অনেক সতর্ক থাকে তাদের শিপগুলোকে নিয়ে। তবুও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, হাইডেনবার্গ যে সময় তৈরি হয়েছিলো এবং যতটুকু যাত্রী সেবা দিয়েছিলো, তা ছিল সময়ের থেকে অনেক বেশী আধুনিক।
তথ্যসূত্র
১] Vaeth, J. G. (1990) What happened to the Hindenburg? Weatherwise, 43, 315-322
[২] Martin, L. C. (1998) Another pop at the Hindenburg disaster, Chemical Engineering, 105, No. 10, 8
[৩] Bain, A., and W. D. Van Vorst. (1998) The Hindenburg tragedy revisited: the fatal flaw found, International Journal of Hydrogen Energy, 24, 399-403
[৪] Potter, S. (2007) May 6, 1937: The Hindenburg disaster, Weatherwise, 60, No. 3, 16-17
ফিচার ইমেজ- airships.net