যেকোনো ব্যাপারেই সফল মানুষদের অনুসরণ করা এবং তাদের থেকে শেখা একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, কিন্তু তা বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, যদি সারভাইভরশিপ বায়াস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকে। সহজ ভাষায়, যখন শুধুমাত্র ‘সারভাইভর’ অর্থাৎ যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েও সাফল্যকে স্পর্শ করতে পেরেছে, তাদের অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করে সম্পূর্ণ চিত্রটির ব্যাপারে ধারণা তৈরির চেষ্টা করা হয়, তখন একটি ভ্রান্ত ছবি ফুটে উঠে যা বাস্তব পৃথিবীর সাথে মেলে না। কারণ, সারভাইভরদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত আরো অনেক অংশগ্রহণকারী থাকতে পারে যারা একইরকম পরিস্থিতিতে একইরকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেও সাফল্য পায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে সারভাইভরশিপ বায়াসের সবচেয়ে বিখ্যাত একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। সে সময়ে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে গণিতবিদ আব্রাহাম ওয়াল্ডকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যুদ্ধবিমানগুলোর সর্বোচ্চ সুরক্ষা কৌশল বের করার জন্যে। মিলিটারি থেকে জানা ছিল যে, ধাতব আবরণ সুরক্ষা কৌশলে ভালো কাজ করবে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিমানকে এরকম আবরণে মুড়িয়ে ফেলা একইসাথে ব্যয়বহুল এবং এর ফলে বিমানও অনেক ভারি হয়ে উঠবে। প্রাথমিকভাবে তাদের পরিকল্পনা ছিল, যুদ্ধফেরত বিমানগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা। বিমানের যে অংশ সবচেয়ে বাজেভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, সেই অংশে আবরণ পরিয়ে দেওয়া প্রথম পরিকল্পনা ছিল।
কিন্তু ওয়াল্ড বুঝতে পেরেছিলেন, এটা একটা ভুল পরিকল্পনা হতে যাচ্ছে। কারণ, তাদের এই পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ ছবিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারাচ্ছে। আর তা হচ্ছে, যে বিমানগুলো যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরত আসতে পারেনি। অর্থাৎ, সেখানেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে রয়ে গিয়েছিল। এই বিমানগুলো যেখানে আঘাত পেয়েছে, সেই জায়গাগুলোতেই আবরণ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরত যেতে পারেনি দেখে পর্যবেক্ষক দল সেগুলোর কথা চিন্তাই করেনি। যে বুলেটের ছিদ্রগুলো পর্যবেক্ষণ করে পর্যবেক্ষক দল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল, তা আসলে এমন স্থান, যেখানে আঘাত পেয়েও বিমানগুলো ওড়া অব্যাহত রাখতে পারে। এবং এই জায়গাগুলোতে ধাতব আবরণের প্রয়োজন নেই।
সারভাইভরশিপ বায়াসের সাথে পরিচিত হওয়ার পরে সবধরনের পরিস্থিতিতেই এটার উপস্থিতি চিহ্নিত করা সম্ভব। এরকম একটি জায়গা হচ্ছে বাণিজ্যিক বিশ্ব। বিল গেটস ও মার্ক জাকারবার্গের মতো বিলিয়নেয়াররা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি সম্পন্ন না করেই সফল হয়েছিলেন। এই ব্যাপারটি মিডিয়ার পর্যাপ্ত নজর কেড়েছে এবং তা নিয়ে তারা বেশ রঙচঙে প্রবন্ধও প্রকাশ করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এরকম একটি প্রবন্ধে একটি কার্টুন ফিচার করা হয়েছিল যেখানে তারা “College is for suckers” লেখার সাহস পর্যন্ত দেখিয়েছিল। আবার, ২০১১ সালে সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তা পিটার থিইল ড্রপআউট হতে চাওয়া তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্যে এক লক্ষ ডলারের পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল। পাঠকমনে এইধরনের গল্পগুলোর আবেদন অনুভব করা বেশ সহজ। কারণ, এরকম সাফল্যের গল্পগুলো প্রতিকূলতাটাকেই উৎসাহদায়ক করে তোলে। এরকম আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় যে, তারা যদি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াই ধনী হতে পারে, এটা আমার দ্বারাও সম্ভব। এরকম ভাবনার ফলে মানুষ সহজেই সারভাইভরশিপ বায়াসের শিকার হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেই এমন কতোজন মানুষ ব্যর্থ, সেটি খুঁজতে গেলেই ভিন্ন একটি ছবি ধরা দেবে।
২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির হার ছিল ৮৮ শতাংশ এবং তাদের বার্ষিক বেতনের মধ্যক ছিল ৩৪,০০০ ইউরো। গ্র্যাজুয়েট নন এমনদের মধ্যে এই হার ছিল ৭২ শতাংশ এবং বেতনের মধ্যক ২৪,০০০ ইউরো। এই পরিসংখ্যান থেকে এতটুকু বুঝা যায় যে, ধনী হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান না হলেও এটা সাহায্য করে। সত্য বলতে, যারা প্রতিকূলতাকে জয় করেছে তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিরে পৃথিবীর প্রকৃতি নির্ণয় করতে গেলে সহজাতভাবেই আপনি সম্পূর্ণ চিত্রটি দেখতে পাবেন না। এরকম ব্যক্তিরা অবশ্যই সম্পূর্ণ ছবিটির প্রতিনিধিত্ব করেন না আর তাই তাদের অনুকরণ করতে সাবধানী হতে হবে। যদি বেশিরভাগ মানুষই এরকম বড় ঝুঁকির জায়গাগুলোতে সফল হতো, তাহলে এগুলোকে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিতই করা হতো না।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাফল্যের বিপরীতে হাজার হাজার ব্যর্থতার গল্প রয়েছে। কিন্তু এরকম ব্যর্থতার গল্পগুলো আকর্ষণীয় নয়, আর তাই এগুলো ঠিকঠাক প্রকাশ করা হয় না। এভাবে পর্যায়ক্রমে সাফল্যের গল্প পড়ার ফলে, আমাদের কাছে সফল হওয়ার হার বাস্তবের তুলনায় অনেক বেশি মনে হয়। এভাবে, একটি ভুল ধারণার তৈরি হয়।
ড্রপ আউটের গল্প তো আগেই বলা হয়েছে। এরকম আরো কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণ রয়েছে। বাতুলি লামিচ্ছানে নামের একজন ধূমপায়ী ১১৮ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। আবার, চারজন তরুণ মিউজিশিয়ান রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েও পরবর্তীতে তারা ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ব্যান্ড তৈরি করেছিলেন। হ্যাঁ, দ্যা বিটলসের কথা বলছি। সমস্যা হচ্ছে, আমরা যখন এরকম প্রত্যাখ্যাত বা নিয়মভাঙা গল্প বলতে যাই, আমাদের ফোকাস থাকে এই ব্যতিক্রমী সাফল্যগুলোর দিকেই। এর বিপরীতে যে বিশাল সংখ্যক ব্যর্থতার গল্প রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা চিন্তা করতে চাই না। এই কগনিটিভ শর্টকাটের ফলাফলই হচ্ছে সারভাইভরশিপ বায়াস।
সফলদের প্রতিই যদি শুধুমাত্র আমাদের নজর থাকে, তাহলে বেইজ রেটের ব্যাপারে আমাদের ভুল ধারণা তৈরি হবে। বেইজ রেট হচ্ছে একটি নমুনা থেকে নির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা এবং এটাকে শতকরায় প্রকাশ করা হয়। যেমন: রুলেট (Roulette) খেলায় ৩৮টি গেমের মধ্যে জেতার সম্ভাবনা থাকে একটিতে, যা ২.৬৩%। এই শতাংশটিই বেইজ রেট। সমস্যাটি তখনই তৈরি হয়, যখন আমরা জয়ীদেরকে গেমটির প্রতিনিধি মনে করি। আমাদের ভাবনায় তখন জেতার সম্ভাবনা আরো অনেক বেশি মনে হয়। বিল গেটস, দ্যা বিটলস এরকমই উদাহরণ। তবে এই উদাহরণগুলো থেকে অনেক কিছু শেখার থাকলেও, তা থেকে একইরকম ফলাফল প্রত্যাশা করা ভুল।
একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১১ সালে ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা স্টিভ জবসের জীবনী বেস্টসেলার হয়। এরপরে, কতোজন যে ড্রপআউট হয়ে নিজের গ্যারেজে নতুন কম্পিউটার কোম্পানি শুরু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কারণ, এই ব্যর্থ গল্পগুলো কখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। আমরা শুধু স্টিভ জবসের সাফল্য সম্পর্কেই জানি এবং সেটাই মহিমান্বিত রূপে বারবার আমাদের চোখে ধরা দেয়।
আমরা যদি যথেষ্ট চেষ্টা করি তাহলে কি যেকোনো কিছু অর্জন করতে পারব? এর উত্তর হচ্ছে, না। সারভাইভরশিপ বায়াস কারণ ও ফলাফলের (cause and effect) একটি ভুল ধারণা তৈরি করে। অনেকক্ষেত্রেই মানুষ নিছক কাকতালীয় বিভিন্ন ঘটনার মধ্যেও কজ অ্যান্ড ইফেক্টের প্যাটার্ন স্থাপন করে যেখানে আসলে এমন কোনোই প্যাটার্ন নেই। বিখ্যাত উদ্যোক্তারা বিশ্ববিদ্যালয় ড্রপআউট, এটা শুধুমাত্রই একটি কাকতাল, একটি সংগতি (correlation)। ড্রপআউট করা তাদের সাফল্যের পেছনে কোনো কারণ নয়। কিন্তু আমরা সবাই এটাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখার চেষ্টা করি। সারভাইভরশিপ বায়াস এভাবে সংগতিকে কার্যকারণ হিসেবে চিন্তা করার একটি ভ্রান্তি তৈরি করে। আমরা প্রবৃত্তিগতভাবেই সবসময় প্রতিকূলতাকে কারা জয় করেছে এবং সফল হয়েছে সে গল্পগুলো শুনতে চাই। সাফল্যের এই ন্যারেটিভের প্রতি তীব্র আগ্রহের কারণেই ব্যর্থতার গল্পগুলো আমরা উপেক্ষা করি।
খুব কম মানুষই এমন একজন ব্যবসায়ীর গল্প শুনতে চাইবে যিনি দেউলিয়া হয়ে তার বাকি জীবন ঋণের মধ্যে কাটাচ্ছেন। কিংবা এমন মিউজিশিয়ানের গল্প, যিনি বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও সাফল্য পাচ্ছেন না। সাফল্যের জন্যে আমাদের যে অনুপ্রেরণা প্রয়োজন, সারভাইভরশিপ বায়াস তার যোগান দেয়; এমনকি আমাদের নিজ সামর্থ্যের ব্যাপারে যে আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন সেটুকুও। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে সাফল্য কখনো গ্যারান্টিযুক্ত নয়। বেশিরভাগ ব্যবসাই ব্যর্থ হয়। বেশিরভাগ মানুষই ধনী কিংবা বিখ্যাত হতে পারে না। বেশিরভাগ ‘লিপ অব ফেইথ’ আশানুরূপ কাজ করে না। তার অর্থ এই না যে, আমাদেরকে চেষ্টা করা বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর ব্যাপারে আমাদের প্রত্যাশা ও ভাবনা বাস্তবসম্মত হতে হবে।
ব্যবসা জগতে এই ভ্রান্তিটির বেশ প্রকট প্রভাব রয়েছে। যেসব কোম্পানি প্রথমদিকেই ব্যর্থ হয়, তাদের সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা হয়। অন্যদিকে, বিরল সাফল্যগুলো বছরের পর বছর ধরে প্রশংসিত হতে থাকে। যেসব কোম্পানি ব্যর্থ হয়, মার্কেট পারফরম্যান্সের স্টাডিতে বেশিরভাগ সময়েই তাদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য রাখা হয় না, যেখান থেকে তাদের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করা সম্ভব। এভাবে সত্যিকারের পরিসংখ্যানটি বিকৃত হয় এবং সাফল্য অর্জন যতোটা নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি সম্ভাব্য মনে হয়।
ইতিহাস যেরকম বিজয়ীদের হাতে লিখিত, ব্যবসাক্ষেত্রের ব্যাপারেও অনেকটা তাই বলা চলে। যারা ব্যর্থ, তারা তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো কোনো প্ল্যাটফর্ম পায় না। ভাগ্য বা কাকতাল যে সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্যে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, সে ব্যাপারটিকে যারা উপেক্ষা করেন, তারা ব্যর্থকে শুধুমাত্র ব্যর্থতা দিয়েই বিবেচনা করে থাকে। এমনকি অনেক সফল ব্যক্তি তার সফলতার পেছনে শুধুমাত্র নিজের সক্ষমতাকেই বড় করে দেখেন। কিন্তু অনেকগুলো ব্যাপার যে তার পক্ষে কাজ করেছে, যেগুলোর উপরে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না, সে ব্যাপারগুলো তিনি বেমালুম ভুলে যান। এভাবে, সত্যিকারের পৃথিবীর ব্যাপারে তার মনে একটি বিকৃত ধারণা গড়ে ওঠে।
ব্যবসা ও উদ্যোক্তা সংক্রান্ত ম্যাগাজিনগুলোতে নিয়মভাঙা সাফল্য, অর্থাৎ যারা প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়েও সাফল্য পেয়েছে তাদেরকে অনেক মহিমান্বিত করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ উদ্যোক্তার ক্ষেত্রেই, অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া ও প্রচলিত পদ্ধতিগুলো পরিহার করা একটি বাজে জুয়ার মতো সিদ্ধান্ত। অনেক বিলিওনিয়ারকে শুধুমাত্র এরকম নিয়ম ভাঙার কারণেই উদযাপন করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ আলোচনাতেই তাদের ব্যবসায় টাইমিংয়ের ভূমিকা, ভাগ্য, গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে সম্পর্ক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। একটি ধনী পরিবারের সদস্যদের অনেক মূল্যবান মানুষের সাথে যোগাযোগ থাকে, যার সাথে টাইমিংকে একত্র করতে পারলে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়, এমনকি যদি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও সম্পন্ন না করে। কিন্তু অন্যরকম একটি পরিবার থেকে উঠে আসার জন্যে তা অনেকবেশি কষ্টসাধ্য।
সাধারণত অনেক স্টার্টআপ সংক্রান্ত আলোচনাই “৯০ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়” বাক্যটি দিয়ে শুরু করে। কিন্তু খুব কম মানুষই এই কথাটিতে মনোযোগ দেয় অথবা চিন্তা করার চেষ্টা করে যে কথাটি আসলে কি বলতে চাচ্ছে। আমাদের মনোযোগ থাকে এরকম একটি ধারণায়, যেখানে সাফল্যের পেছনে একটি গোপন ফর্মুলা আছে এবং এর ফলেই আমরা তখন বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তাদের দিকে ফোকাস করি। তাদের জ্ঞান ও ফর্মুলা প্রয়োগ করতে পারলে সাফল্য আমাদের হাতেও ধরা দিতে বেশি বাকি নেই, এরকম একটা মানসিকতা তৈরি হয়। সত্যি বলতে, শুধুমাত্র সফল উদ্যোক্তাদের ফর্মুলা আমাদেরকে খুব বেশি কিছু শেখাতে পারে না। ব্যর্থদের গল্পগুলো আমাদেরকে ভুলগুলো চিহ্নিত করা শেখাতে পারে। এভাবে, ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, সফল এবং ব্যর্থ উভয়ের থেকে শেখা।
বেশিরভাগ সময়েই আমরা এমন উদ্যোক্তাদের গল্প উপভোগ করি, যারা অনেক প্রতিকূলতা জয় করে সফল হয়েছে। কিন্তু এর আগে আরো অনেক উদ্যোক্তা যে একইপথে হেঁটেও ব্যর্থ হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা একরকম চিন্তাগত অন্ধত্ব বজায় রাখি। পেছনের দিকে প্রতিকূল দিনগুলোর দিকে তাকালে সফল উদ্যোক্তাদের মনে হয় যে, তাদের সবসময়েই একটি চমৎকার পরিকল্পনা ছিল। তারা তখনই জানতো যে, এই পরিকল্পনা একসময় ঠিকই কাজ করা শুরু করবে। এই সম্পর্কে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কাহনেম্যান বলেছেন,
A stupid decision that works out well becomes a brilliant decision in hindsight.
বাইরের কোনো পর্যবেক্ষক তার গল্প শোনার পরেও সেখান থেকে হয়তো সাফল্যের প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে চাইবে। কিন্তু কাহনেম্যান যেমনটি বলেছেন, এই প্যাটার্নের মধ্যে একমাত্র সাদৃশ্য হচ্ছে ভাগ্য। কারণ একইপথে হাঁটা ব্যর্থ উদ্যোক্তারা, ভাগ্য যাদের পক্ষে কাজ করেনি, তাদের কাছে সবসময়েই একই পরিকল্পনাকে ভুল মনে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে গণিতবিদ ওয়াল্ডের গল্পটি সারভাইভরশিপ বায়াস কাটিয়ে উঠার একটি ভালো উদাহরণ। এই উদাহরণ থেকে শিক্ষণীয় অংশটি হচ্ছে, আমাদের সামনে যেসব তথ্য রয়েছে শুধুমাত্র তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা ভুলপথে ধাবিত করতে পারে। একই পথে শুরু করা সবগুলো ঘটনার কথা মাথায় রাখতে হবে, যেগুলো ব্যর্থ হয়েছে সেগুলোও। পত্রিকায় কোনো সফল গল্প পড়ার সময়ে একই প্যাটার্নের ব্যর্থ মানুষগুলোর ব্যাপারে সমানভাবে চিন্তা করতে হবে। অবশ্য, সারভাইভরশিপ বায়াস নতুন উদ্যোগ নেওয়ার বিপক্ষে কোনো অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করলে ভুল হবে। বরং এটা একটা টুল, যা পরিসংখ্যানগত ভ্রান্তিগুলো কেটে পৃথিবীর সত্যিকারের অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে। ফলে, যে কোনো ক্ষেত্রেই আপনার ভাবনায় সম্পূর্ণ চিত্রটি থাকবে যা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।