যদি বলা হয় যে গরুর ডিএনএ’র এক চতুর্থাংশ এসেছে সাপ থেকে, তাহলে আপনি বিশ্বাস করবেন কি? নাকি ভেবে বসবেন যে নিতান্তই প্রলাপ বকছি? মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে চলুন কিছু সাধারণ বিষয়াদি জেনে নেওয়া যাক।
ইদানীং জিন, জিনোম, ক্রোমোজোম আর ডিএনএ শব্দগুলো একেবারে বহুল ব্যবহৃত হয়ে গেছে। শব্দগুলো কি সমার্থক?
ডিএনএ এর পূর্ণ রূপ হল ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লিয়িক এসিড। চারটি নাইট্রোজেন ঘটিত ক্ষারের যেকোনো একটি, একটি ফসফেট গ্রুপ এবং পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট রাইবোজ সুগার নিয়ে গঠিত হয় ডিএনএ। চারটি ক্ষারের মাঝে দুইটি ধরণ থাকে।
পিউরিন- অ্যাডেনিন ও গুয়ানিন।
পাইরিমিডিন- সাইটোসিন ও থাইমিন।
জিন হচ্ছে ডিএনএ’র একটি সুনির্দিষ্ট অংশ যেটি একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনকে কোড করতে পারে। অর্থাৎ প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য জিনে অন্তর্নিহিত থাকে।
কুণ্ডলিত ডিএনএ যখন হিস্টোন নামক প্রোটিন দিয়ে মোড়ানো থাকে তখন তাকে ক্রোমোজোম বলা হয়।
একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির সকল জিনের সমষ্টিকে একসাথে বলা হয় জিনোম।
BovB জিন
জিনোমকে বলা হয়ে থাকে যেকোনো জীবের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের নিয়ন্ত্রক। মানুষের মাঝেও ডিএনএ’র অনেক বৈচিত্র্য আছে। হয়তো আজ থেকে এক শতাব্দী আগে মানুষের ডিএনএ’র সিকোয়েন্স যেরকম ছিল, পাঁচ শতাব্দী আগে তেমনটা ছিল না। বিভিন্ন কারণে মানুষের ডিএনএ সিকোয়েন্স পরিবর্তিত হতে পারে। ঠিক একইভাবে গরুর জিনোমের ক্ষেত্রে ডিএনএ’র একটি বিশেষ অংশ BovB অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট ক্রম বারবার আসছে বা পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে গরুর ডিএনএ’র প্রায় পঁচিশ শতাংশ BovB অথবা এর বিশেষায়িত সিকোয়েন্স দ্বারা তৈরী হয়েছে।
BovB জিনটি শুধু গরুর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাডিলেডের আলি মর্টন ওয়ালশের তথ্যানুযায়ী BovB জিনটি হাতি, ঘোড়া এবং হংসচঞ্চুতেও উপস্থিত। এছাড়াও টিকটিকি, গিরগিটি, অজগর, সামুদ্রিক সাপ, বেগুনী শজারু, রেশম পোকা এবং জেব্রাফিশেও BovB এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
মূলত বলা হচ্ছে যে, গরুর জিনোমের এক চতুর্থাংশ BovB অথবা এর পরিবর্তিত সিকোয়েন্স দ্বারা গঠিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে গরু ছাড়া অন্য আরও অনেক প্রাণীতেও তো এই সিকোয়েন্সের উপস্থিতি আছে। এই ব্যপারটার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? এই দুই আপাত পরস্পর বিরোধী বক্তব্য যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম যে, সম্পর্কিত প্রজাতিগুলোর মাঝে BovB এর অনুরূপ সংস্করণ পাওয়া যাবে। অর্থাৎ গরুতে উপস্থিত BovB সিকোয়েন্স, ভেড়ার BovB এর খুব কাছাকাছি হবে এবং হাতি, হংসচঞ্চু, সাপ ও গিরগিটির সাথে তুলনায় ক্রমান্বয়ে এর ভিন্নতা বেড়ে যাবে।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। BovB জিনের ফ্যামিলি ট্রি বা প্রবাহ ধারা আঁকলে স্পষ্টভাবে এটাই মনে হবে যে এমন এক পৃথিবীতে প্রবেশ করা হয়েছে যেখানে হাতির তুলনায় গরু বরং সাপের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এবং টিকটিকির সাথে অন্যান্য গিরগিটির সম্পর্কের তুলনায় ঘোড়ার সম্পর্ক বেজায় কাছাকাছি।
এই ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার কারণ হচ্ছে BovB জিন আর দশটা সাধারণ জিনের মত পিতামাতা থেকে আবশ্যিকভাবে সন্তানে প্রকাশিত হয় না। এটি একটি জাম্পিং জিন। জাম্পিং জিন শুধু জিনোমের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয় না, বরং নিজেদের মাঝেও এরা পরিবর্তনশীল।
হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফার
Horizontal gene transfer বা lateral gene transfer পদ্ধতিতে ডিএনএ’র স্থানান্তর ভিন্ন ভিন্ন জিনোমের মধ্যে হয়ে থাকে। অর্থাৎ দুটি ভিন্ন প্রজাতির মাঝে যখন ডিএনএ’র স্থানান্তর হয়, তখন সেটাকে বলা হয় অনুভূমিক জিন স্থানান্তর। এটা হতে পারে একটি প্রোক্যারিয়ট এবং একটি ইউক্যারিয়টের মাঝে। সাধারণত ডিএনএ’র স্থানান্তর হয় এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রজননের মাধ্যমে, যাকে বলা হয় ভার্টিক্যাল জিন ট্রান্সফার। হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফার সম্ভব হয় প্লাজমিড (নিউক্লিয়াস বহির্ভূত বৃত্তকার ডিএনএ), ট্রান্সপোজোন (জাম্পিং জিন) অথবা ব্যাকটেরিওফাজের (ব্যাকটেরিয়া ভক্ষণকারী ভাইরাস) মাধ্যমে। ডিএনএ’র স্থানান্তর ঘটে থাকে ট্রান্সফর্মেশন, কনজুগেশন বা ট্রান্সডাকশনের মাধ্যমে।
প্রোক্যারিয়ট ও ইউক্যারিয়ট উভয়ের ক্ষেত্রেই অভিযোজন ও অভিব্যক্তিতে হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন Pasteurella bacteria প্রজাতি থেকে বিপাকীয় উৎসেচক কোডিং জিনকে Trichomonas vaginalis পরজীবীতে স্থানান্তরের মাধ্যমে একে পোষক দেহে অভিযোজনের ক্ষমতা প্রদান করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীদের বর্তমান ধারণা অনুযায়ী হ্যালোফিলিক (লবণগ্রাহী) Haloarcula marismortui প্রজাতিতে মিথাইল অ্যাসপারটেট বিপাকের সাম্প্রতিক বিবর্তন মূলত হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে অর্জিত কিছু জিনের দরুন।
গরু আর সাপ একে অপরের সাথে যেভাবে সম্পর্কিত
হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে নতুন কোনো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে ওঠাটা ব্যাকটেরিয়ার বা নিম্ন শ্রেণীর জীবের ক্ষেত্রে খুব সহজ। অন্যদিকে উচ্চ শ্রেণীর অর্থাৎ জটিল এবং সংঘবদ্ধ জীবের ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি খুব সাধারণ নয়। তবে প্রায়ই এরকম কিছু না কিছু জিন ট্রান্সফার ঘটে। যেমন ইউনিভার্সিটি অফ উতাহ’র কয়েকজন গবেষক কিছু জাম্পিং জিনের একটি সেট খুঁজে পেয়েছেন যেটি বিভিন্ন স্তন্যপায়ী, গিরগিটি এবং ব্যাঙের মধ্যে উপস্থিত আছে।
ধরা যাক, একটি বইয়ে এমন একটি শব্দ আছে “প্রকাশক” যেটি দৈবক্ষমতায় নিজের বহু সংখ্যক অনুরূপ তৈরি করে বিভিন্ন জায়গায় বসে যেতে পারে। তাহলে ব্যপারটা কীরকম হতে পারে? “প্রকাশক প্রকাশক” বা “প্রকাশক প্রকাশক প্রকাশক” বা “প্রকাশক প্রকাশক প্রকাশক প্রকাশক প্রকাশক” ইত্যাদি।
ঠিক এরকম ঘটনা মানুষের জিনোমেও ঘটে থাকে। রেট্রোট্রান্সপোজোন নামক কিছু জিন ইচ্ছেমত তাদের অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরী করে ডিএনএ’র বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে পারে। মানুষের জিনোমের প্রায় অর্ধেক জুড়ে আছে এরকম জাম্পিং জিন। গরুর জিনোমের প্রায় এক চতুর্থাংশ একটি নির্দিষ্ট জাম্পিং জিন দ্বারা গঠিত যার নাম হচ্ছে BovB। আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে এই জাম্পিং জিন গরুতে প্রকাশিত হয়েছে সাপ এবং গিরগিটি থেকে এসে।
রেট্রোট্রান্সপোজোন সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রজাতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে কখনও কখনও একাধিক প্রজাতিতেও এর বিচরণ সম্ভব। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত না দিতে পারলেও তাঁদের ভাষ্যমতে, রেট্রোট্রান্সপোজোনগুলো একটি প্রজাতির ডিএনএ কেটে অন্য প্রজাতির ডিএনএ’র প্রবেশ ঘটাতে পারে। একই ঘটনা ঘটে BovB এর ক্ষেত্রে। সুনির্দিষ্টভাবে আজ অবধি নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি মূলত কোন প্রাণীতে এই ঘটনাটি প্রথম ঘটেছিল। তবে সেই অজানা উৎস থেকেই BovB জিনটি গরু, হাতি, সাপ এবং প্রজাপতির ডিএনএ’তে প্রকাশিত হয়েছে।
এই রহস্যের সমাধান তবে কী?
বংশগতির ধারক এবং বাহক বলা হয় জিনকে। অর্থাৎ কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হওয়া বা না হওয়া সংশ্লিষ্ট জিনের এক্সপ্রেশনের উপর নির্ভর করে। আবার একইসাথে এটাও সত্য যে পরিবেশের উপর নির্ভর করে জিনের এক্সপ্রেশন পরিবর্তিত হয়। সময়ের সাথে সাথে জিনে পরিবর্তন আসে। তারপরও সদৃশ প্রজাতিগুলোর মাঝে একটি নির্দিষ্ট জিনের কাছাকাছি অনুরূপ পাওয়া যায় এবং প্রজাতিগত দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জিনগত পার্থক্যও। সুতরাং একটি জিনের বিভিন্ন প্রতিলিপি নিয়ে কাজ করলে একটি ফ্যামিলি ট্রি বানানো সম্ভব যার মাধ্যমে জিনের প্রবাহ এবং এর বিভিন্ন অনুরূপগুলোর পারস্পরিক নৈকট্য বা দূরত্ব বোঝা যাবে। কিন্তু এই ধরনের ফ্যামিলি ট্রি শুধুমাত্র তখনই সম্ভব, যখন সন্তান তার মা-বাবার কাছ থেকে জিন লাভ করে অর্থাৎ যখন ভার্টিকাল জিন ট্রান্সফার হয়।
সব শেষেও যে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফার কীভাবে সম্ভব? অর্থাৎ নেপথ্যের নায়ক কে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা দিতে পারেন নি। তবে তাদের ধারণানুযায়ী রক্তচোষা পরজীবীদের মাধ্যমেই এই হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফার সম্পন্ন হয়ে থাকে।
গবেষকদের বর্তমান চিন্তা হচ্ছে, কোনোভাবে যদি এই অভিব্যক্তির ধারাকে উল্টোদিকে ধাবমান করা যায় তখন কি হবে? শুরু থেকে শুরু করে আবার যদি আজকের জায়গায় ফিরে আসা যায় তখনও কি ঠিক একই ফলাফল আসবে অর্থাৎ অভিব্যক্তির ধারা কি স্থিতিশীল থাকবে? ইতিহাস কি সত্যিই এর পুনরাবৃত্তি করবে? এই জাম্পিং জিনগুলোর প্রবাহিত হওয়াটা অত্যন্ত অনিশ্চয়তায় ঘেরা তবে একইসাথে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ যখন এই ধরণের হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফার হয় তখন সেটি অভিব্যক্তির অন্যতম ক্ষমতাবান নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়।
তবে এখানে খেয়াল করা দরকার যে, রেট্রোট্রান্সপোজোনগুলো কিন্তু আর দশটা সাধারণ জিনের মত কাজে বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে না। প্রাণীর বৈশিষ্ট্য প্রকাশে জিনের ভূমিকা এবং অভিব্যক্তিতে ভূমিকা রাখা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি বিষয়। আরও একটি চমৎকার বিষয় হচ্ছে, বর্তমান পৃথিবীতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম (GMO) এর কথা গুরুত্ব সহকারে ভাবা হচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে কথা বলার লোকজনও প্রচুর আছে। তবে হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফারের মূলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যাচ্ছে যে প্রকৃতি নিজেই তার সন্তানের মাঝে বিশুদ্ধতা রক্ষার পাশাপাশি জিনের অদলবদলও করছে কখনও কখনও।
ফিচার ইমেজ- phenomena.nationalgeographic.com