ভারতের ভগলপুরের বাসিন্দা সুনিতা কুমারীর (৫০) পা হঠাৎ করেই অনেক বেশি ফুলে গেল। তার সাথে যুক্ত হলো প্রচন্ড ব্যথা। কুসংস্কারাচ্ছন্ন অঞ্চলের অধিবাসী হবার কারণে এসব দেখে তার আত্মীয়-স্বজনরা তাকে সামাজিক মেলামেশা থেকে বয়কট করল। এমনকি সুনিতার শ্বাশুড়িও তার বাচ্চাদেরকে তার থেকে দূরে সরিয়ে নিলো অমঙ্গলের শঙ্কায়।
সুনিতাকে যখন হাসপাতালে নেয়া হলো, তখন ধরা পড়ল ‘লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস’ বা ‘এলিফ্যান্টিয়াসিস’ বা সহজ বাংলায় গোদরোগ। এটা একধরনের পরজীবী ঘটিত রোগ যা বিশেষ প্রজাতির মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগকে Neglected Tropical Diseases ( NTD) এর কাতারে ফেলা হয়।
NTD আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। যেসব দেশে সুপেয় এবং পরিষ্কার পানির অভাব আছে কিংবা মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেশ খারাপ, সেসব দেশে সাধারণত NTD ছড়িয়ে থাকে।
উপরোক্ত ঘটনাটি ভারতের হলেও বাংলাদেশেও এমন ঘটনা প্রায়শ ঘটে থাকে। এই রোগ একপ্রকার সামাজিক ট্যাবু। বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো, যেমন- পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রাজশাহী, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে।
গোদরোগ কী?
গোদরোগ মূলত একটি কৃমিঘটিত রোগ। এই কৃমি মানুষের দেহে প্রবেশের পর প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় লসিকাগ্রন্থিতে অবস্থান নেয়। লসিকাগ্রন্থিগুলো আমাদের দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলো আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে। যেহেতু কৃমিগুলো আমাদের লসিকাগ্রন্থিতেই অবস্থান নেয়, ফলে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাও স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে যায়।
যেভাবে ছড়ায়
এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় মশার কামড়ের মাধ্যমে। যখন মশা একজন গোদরোগে আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেয়, তখন রোগী থেকে কিছু পরিমাণ আণুবীক্ষণিক কৃমি মশার শরীরে ঢুকে যায়। এই কৃমির বৈজ্ঞানিক নাম Wuchereria bancrofti। আণুবীক্ষণিক কৃমিকে তখন বলা হয় মাইক্রোফাইলেরি।
কৃমিগুলো মশার দেহে প্রবেশের পর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। যখন আক্রান্ত মশা অপর কোনো সুস্থ মানুষকে কামড়ায়, তখন জীবাণু ওই সুস্থ মানুষের মাঝে ঢুকে যায়। পরবর্তীতে রক্তস্রোতের মাধ্যমে লসিকাগ্রন্থিতে অবস্থান নেয়। জীবাণু প্রাপ্তবয়স্ক হতে ৬ মাস কিংবা তারও বেশি সময় নিতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক জীবাণু যৌন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করে রক্তে প্রচুর পরিমাণে আণুবীক্ষণিক জীবাণু তৈরি করতে থাকে। সাধারণত এশিয়ায় Aedes এবং Mansonia মশার প্রজাতির মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশে ছড়ায় কিউলেক্স প্রজাতির স্ত্রী মশাদের দিয়ে।
লক্ষণসমূহ
অনেক রোগীই লক্ষণবিহীন অবস্থায় থাকেন। গোদরোগের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া, যেমন- পা, জননাঙ্গ, হাত, স্তন ইত্যাদি।
এসবের মধ্যে পায়ে সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। ফুলে যাওয়া ও বড় হয়ে যাওয়ার কারণে আক্রান্ত স্থানে প্রচন্ড ব্যথা হতে থাকে, এবং নড়াচড়া করানো যায় না। পুরুষদের ক্ষেত্রে অন্ডকোষ ফুলে যেতে পারে। একে হাইড্রোসেলি বলা হয়। এছাড়াও লসিকাগ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। একে লিম্ফোএডেমা বলে।
এছাড়া ত্বকেও বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন –
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া,
- ত্বক পুরু হয়ে যাওয়া,
- ত্বকে ঘা হওয়া,
- ত্বক কালচে আকার ধারণ করা ইত্যাদি।
কারো কারো ক্ষেত্রে জ্বরও হতে পারে। যেকোনো বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
গোদরোগের জীবাণু দীর্ঘদিন সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক জীবাণু ৫-৭ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। ছোটবেলায় আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ সময় সেটার লক্ষণ হিসেবে হাত কিংবা পা ফুলে যেতে পারে। পরবর্তীতে চিকিৎসা না করালে বড় হলে আক্রান্ত হাত কিংবা পা পুরোপুরি অকেজো হয়ে যেতে পারে।
আক্রান্ত স্থানের তীব্রতার ধরন অনুসারে এই রোগকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়-
- অ্যাকিউট অ্যাটাক,
- লিম্ফোএডেমা, এবং
- হাইড্রোসেলি।
গোদরোগ আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আক্রান্ত করতে পারে। ফলে যাদের গোদরোগ আছে তাদের অন্য কোনো রোগও ধরা পড়তে পারে। একে সেকেন্ডারি ইনফেকশন বলা হয়। এমনই একটি রোগের নাম ট্রপিক্যাল পালমোনারি ইওসিনোফিলিয়া সিনড্রোম।
শরীরের বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকা ইওসিনোফিল কোনো কারণে শরীরে বেড়ে গেলে তাকে বলা ইওসিনোফিলিস। ফলে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা, কফ, বুকে ব্যথা, রক্তে ইওসিনোফিলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শরীরের তরল জাতীয় পদার্থের সাথে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রোগ নির্ণয়
নিম্নোক্ত প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ নির্ণয় করা যায়-
- রক্ত পরীক্ষা,
- লিম্ফ নোড পরীক্ষা,
- এক্স-রে, ও
- আলট্রাসাউন্ড।
রিস্ক ফ্যাক্টর
বিশ্বে প্রায় ১২ কোটি রোগী আছে এই রোগের। প্রায় ৭২টি দেশে গোদ রোগের রোগী পাওয়া গেছে। নিচের অঞ্চলগুলোতে গোদ রোগের রোগী সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
- আফ্রিকা,
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া,
- ভারত,
- ল্যাটিন আমেরিকা, এবং
- ক্যারিবিয়ান।
আরো কিছু সাধারণ রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে অন্যতম হলো-
- দীর্ঘ সময় ধরে ট্রপিক্যাল বা সাব-ট্রপিক্যাল এলাকায় বসবাস করলে।
- মশা দ্বারা আক্রান্ত হলে।
- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করলে।
যেভাবে রোগপ্রতিরোধ করা যেতে পারে
যদি আপনি গোদ রোগের প্রাদুর্ভাব আছে এমন এলাকায় বসবাস করেন অথবা ভ্রমণ করেন, তবে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলতে পারেন।
- মশারি টানিয়ে ঘুমানো।
- ফুলহাতা কাপড় পরা।
- ট্রাউজার পরিধান করা।
- সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত শরীরের খোলা স্থানে মশারোধী ওষুধ ব্যবহার।
- বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখা।
- বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখা।
- খাল-ডোবা-ড্রেন পরিষ্কার রাখা।
- নিয়মিত মশা মারার ওষুধ ছিটানো।
চিকিৎসা
রোগ ধরা পড়লে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। এছাড়া সাধারণ কিছু নিয়মকানুন আছে যেগুলো মেনে চলা জরুরি। যেমন-
- যত্নসহকারে ফোলা স্থান সাবানপানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা এবং শুকনো রাখা।
- ফুলে যাওয়া হাত কিংবা পা দিনে এবং রাতে উঠাতে হবে যেন জমে যাওয়া তরল চলাচল করতে পারে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ব্যায়াম করতে হবে যেন শরীরে তরল চলাচল বাড়ে এবং লসিকাগ্রন্থির উন্নতি ঘটতে পারে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্ষতস্থান অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বা অ্যান্টি-ফাংগাল ক্রিম দিয়ে পরিচর্যা করা।
- পায়ে আঘাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য পরিমিত সাইজের জুতা পরিধান করা।
কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার দরকার হতে পারে। আক্রান্ত স্থানে অনেক সময় রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারির দরকার হয় অথবা আক্রান্ত লসিকাগ্রন্থিকে তুলে ফেলার জন্যও শল্যচিকিৎসার দরকার হতে পারে।
চিকিৎসা যেখানে পাবেন
বাংলাদেশে ফাইলেরিয়া চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে এবং সেটি বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল। জাপানের সহায়তায় নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের জুলাইয়ে সাভারে একটি ৫০ শয্যাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক ফাইলেরিয়া হাসপাতাল চালু করা হয়। সেখানে শুধু চিকিৎসাই নয়, রয়েছে ফাইলেরিয়া নিয়ে গবেষণার জন্য অত্যাধুনিক গবেষণাগারও। দেশে প্রতিষ্ঠিত ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগের জন্য বিশেষায়িত দুটি হাসপাতাল হলো-
১. ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল | সাভার, ঢাকা।
২. ফাইলেরিয়া হাসপাতাল | সৈয়দপুর, নীলফামারী।