
মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ফার্মি প্যারাডক্সে সবাইকে আবারো স্বাগতম। গত দুটি লেখায় (ফার্মি প্যারাডক্স – মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণের সন্ধানে) এবং (মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান সভ্যতার খোঁজে) আমরা দেখেছি কত বিশাল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। মহাবিশ্বের এই বিশালতার মাঝে মহাকালের তরীতে চড়তে চড়তে আমরা খুঁজে ফিরেছি একটি পাড় দেখবো বলে, আমাদের মতো একটি জনবসতি দেখবো বলে। কিন্তু বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি, এই অন্তরীক্ষে আমরা বড়ই একা। প্রশ্ন হলো তাহলে ওরা কোথায়? আজ আমরা ফার্মির এই প্যারাডক্সের কিছু সমাধান খুঁজার চেষ্টা করবো।

চিত্রঃ এনরিকো ফার্মি।
প্রথমেই বলে রাখি ফার্মির এই প্যারাডক্সটির সমাধান আমরা এখনো পাইনি। তো সমাধান না পেলে কি বসে থাকবো? না, অবশ্যই না। হাতের কাছে তথ্য উপাত্ত, পর্যবেক্ষণ দিয়ে কিছু সম্ভাব্য সমাধান দাঁড় করাবো, তাই না? তো আমরাও তাই করতে গেলাম। আর তখুনি বাঁধল নানা বিপত্তি। নানা মুনির নানা মত! এই যেমন আপনি নিজেই আপনার আশপাশের দশজনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, ভাই বলেন তো মহাবিশ্বে আমরা একা কেন? তারা কী বলে দেখুন না! নিশ্চয়ই কারো সাথে কারো মতের মিল হবে না। বিজ্ঞানীদের অবস্থাও এর থেকে খুব একটা ভালো না। একেকজনের একেক সমাধান।

চিত্রঃ ফার্মি প্যারাডক্স নিয়ে একটি কৌতুক।
তো আমরা কেন একা এই প্রশ্নের সমাধান যেসব বিজ্ঞানী দিয়েছেন, আলোচনার সুবিধার্থে আমরা তাদের দুটা দলে ভাগ করে ফেলি। একদলের যুক্তি, যেহেতু আমরা এখনো দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির বুদ্ধিমান সভ্যতার কোনোরূপ আলামত পাইনি, এর মানে হলো এদের আসলে কোনো অস্তিত্বই নেই। আরেকদল বলছে, না তারা আছে। তবে আমাদের প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতার জন্য আমরা এখনো তাদের অস্তিত্ব টের পাইনি।
প্রথম দলঃ আমরা একা, বুদ্ধিমান সভ্যতার কোনো অস্তিত্বই নেই
প্রথম দলের কথা শুনে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। প্রথমবারের মতো সমুদ্র দর্শনে বের হয়েছেন একজন পদার্থবিজ্ঞানী, একজন জীববিজ্ঞানী এবং একজন রসায়নবিদ। পদার্থবিজ্ঞানী সমুদ্র দেখলেন আর ইয়া বড় বড় সব ঢেউ দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। ঢেউয়ের ফ্লুইড ডায়নামিক্সের উপর গবেষণা করার কথা চিন্তা করে সাগরে চলে গেলেন। যথারীতি তিনি ডুবে গিয়ে আর ফিরলেন না। জীববিজ্ঞানী বললেন, তিনি সমুদ্রের উদ্ভিদ ও প্রাণীকণার উপর গবেষণা করবেন, কিন্তু তিনিও ওই পদার্থবিজ্ঞানীর মতো সাগরে গিয়ে আর ফিরলেন না। রসায়নবিদ করলেন কি, বহুক্ষণ ধরে বাকি দু’জনের জন্য অপেক্ষা করে শেষে পর্যবেক্ষণ লিখতে বসলেন, ‘পদার্থবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানী উভয়েই সমুদ্রের পানিতে দ্রবণীয়’। তো এই মতের সমর্থকদের অবস্থাটাও হয়েছে ওই রসায়নবিদের মতো। বুদ্ধিমান সভ্যতার কোনো নজির আমাদের চোখে পড়েনি, তার মানে মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণীরই কোনো অস্তিত্ব নেই, এমনি মত এদের!
না বাপু। তাদের দেখি না বলে, তারা নাই। এসব সস্তা কথাবার্তা বলে পার পাওয়া যাবে না। তারা কেন নাই, সেটার উত্তর দিয়ে যাও। গণিত বলছে আকাশগঙ্গা ছায়াপথেই আমাদের মতো হাজারখানেক বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকার কথা, আর সেখানে তোমরা বলছো কেউই আসলে নাই! তাহলে কী হলো তাদের? নিশ্চয়ই এদের ভাগ্যে ঘটে গেছে কিছু একটা। এ দলের বিজ্ঞানীরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অবতারণা করলেন নতুন একটি ধারণার। তারা সেই ঘটে যাওয়া কিছু একটার নাম দিলেন ‘দ্য গ্রেট ফিল্টার’।
এ প্রপঞ্চ অনুসারে, প্রাণসৃষ্টির সূচনা থেকে তৃতীয় শ্রেণির সভ্যতায় পরিণত হওয়ার এই বিশাল যাত্রাপথে কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে আছে এক অনতিক্রম্য বাঁধার দেয়াল, যা পার করে কোনো সভ্যতা আর এগিয়ে যেতে পারে নি। এই দেয়ালের নামই ‘দ্য গ্রেট ফিল্টার’।
কিন্তু প্রশ্ন হলো সভ্যতার অগ্রগতির সুদীর্ঘ এই যাত্রাপথের ঠিক কোথায় আছে এই বাঁধার দেয়াল? আমরা কি পার করে এসেছি এই বাঁধার দেয়াল? নাকি অন্যান্য বুদ্ধিমান সভ্যতার মতো ভবিষ্যতে এই ফিল্টারে এসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে আমাদের? ঠিক এই মুহুর্তে মানবজাতির জন্য এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসার আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। কারণ এর উপর নির্ভর করছে আমাদের তিনটি বাস্তবতা।
১। আমরা বিরল।
২। আমরাই প্রথম।
৩। আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
প্রথম সম্ভাবনাঃ আমরা বিরল, গ্রেট ফিল্টার আমরা পার করে এসেছি
যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমরা নিজেদের বেশ ভাগ্যবানই বলতে পারি। বিবর্তনের ক্রমিক ধাপগুলোর কোনো একটিতে আমরা পার করে এসেছি এই বাঁধার দেয়াল, যেখানে অন্যান্যরা এসে থমকে গিয়েছে। নিচের চিত্রটির দিকে তাকানো যাক। ধরে নেই আমাদের মতো অন্য একটা প্রাণও এই বাঁধার দেয়াল টপকাতে পেরেছে।
এই যদি হয় কাহিনী তবে অনুমান করাই যায় কেন তৃতীয় শ্রেণির একটা বুদ্ধিমান সভ্যতা আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। অর্থাৎ কোটি কোটি প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাসে হাতে গোনা দু’একটা সফল প্রজাতির একটি আমরা। আমাদের জন্য এ এক বিশাল আশার বাণী। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরাই তাহলে একদিন পরিণত হবো তৃতীয় শ্রেণির সভ্যতায়। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন জানি হয়ে গেল না, নিজেরাই নিজেদের অনন্য বলে ভাবছি। আজ থেকে ৫০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরাও কিন্তু নিজেদের খুব অনন্য ভাবতো। তারা ভাবতো পৃথিবী বুঝি এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র, আর একে কেন্দ্র করেই ঘুরছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড!

চিত্রঃ তখনকার দিনের পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব (Image Credit: laboiteverte.fr)।
যাই হোক, বিজ্ঞানে ‘Observation selection effect’ নামে একটা কথা আছে। এর মানে হলো যদি কেউ মনে করে সে অনন্য, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তার মতো আর কেউ নেই, তবে ধরে নিতে হবে সে আসলে একটা বুদ্ধিমান স্বত্বার অংশ। হোক সে বিরল কিংবা আরো দশজনের মতো, তার এই চিন্তন, তার এই ভাবনা অন্য সবার থেকে আলাদা হতে বাধ্য। আর এই ব্যাপারটাই আমাদের ঠেলে দেয় মানুষের অনন্যতার দিকে।
আমরা বিরল, আমরা অনন্য, এটাও তো একটা সম্ভাব্যতা হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই অনন্য হয়ে থাকি, ঠিক কবে আমরা এই অনন্যতা লাভ করেছি? অর্থাৎ সভ্যতা পরিক্রমায় কোন পর্যায়ে এসে অন্য সকল সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়লেও আমরা ঠিকই পার হয়ে আসতে পেরেছি? আগামি কোনো এক লেখায় আমরা এর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।