কখনো কি এরকম মনে হয়, দুনিয়ায় যত অলক্ষুণে আর অশুভ জিনিস আছে তার সব ঘটে আপনার সাথেই? এমন প্রশ্ন কখনো কি করেন, “দুর্ভাগ্যগুলো এই মরার কপাল ছাড়া অন্যদেরকে কি দেখে না? আমার কপালেই কেন একের পর এক ‘মরা’ লেগে থাকবে?” আসলে আপনি একা নন, সবার সাথেই এমন ঘটে এবং সবাই-ই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে অভাগা আর পোড়া কপালের অধিকারী বলে মনে করে। কিন্তু আসলেই কি সবাই অভাগা?
অশুভ ঘটনা তো পরের কথা, যদি বলি কোনো ঘটনা কেন ঘটে তার উত্তর কী হবে? শুনতে মামুলী মনে হলেও প্রশ্নটা একেবারেই বেয়াড়া। এর উত্তর কী হবে? ভালোই জটিল বলে মনে হচ্ছে। এর উত্তর জটিল হলেও শিরোনামের প্রশ্নের চেয়ে কিছুটা বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন বলে মনে হবে। কেন এমন কথা বললাম? অশুভ ঘটনা কেন ঘটে, এমন প্রশ্ন করা কি বিচার বুদ্ধিহীন? এখানে এর উত্তর খুঁজে দেখবো।
সত্যি কথা বলতে, সাধারণ ঘটনা ও অশুভ ঘটনা ঘটার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। অশুভ ঘটনাও এক প্রকার ঘটনা। একে আলাদা করে হিসেব করার কোনো কারণ নেই। যদি মনে হয়ে থাকে খারাপ জিনিসগুলো শুধু আপনার বেলাতেই হয়, তাহলে এখানে ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে। ‘মার্ফির সূত্র’ নামে একটি নিয়ম আছে। অনেকে একে ‘সডের সূত্র’ও বলে থাকে। অশুভ ঘটনার ক্ষেত্রে তামাশার ছলে মানুষ এই সূত্রটি ব্যবহার করে।
এই সূত্র অনুসারে, মাখন মাখানো কোনো পাউরুটি যদি নিচে পড়ে যায়, তাহলে সবসময় মাখনের পাশটিই নিচের দিকে পড়বে। মেঝেতে যদি রুটিটি পড়ে আর মাখন যদি উপরের দিকে থাকে তাহলে ক্ষেত্রবিশেষে এটি তুলে নিয়ে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু মাখন নিচের দিকে পড়ে মেঝেতে লেপ্টে গেলে তা আর ব্যবহার করার উপায় থাকে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষের বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন ঘটে। এজন্য তারা মনে মনে বলে, “আমার কপালেই যত নেতিবাচক ঘটনা ঘটে।”
যারা মাঝে মাঝে টেলিভিশনের জন্য প্রামাণ্যচিত্র বা নাটক-সিনেমা নির্মাণ করেন, তাদের কাজে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে শুটিং চলাকালীন অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ। অনেক দূর দিয়ে যদি কোনো উড়োজাহাজ উড়ে যায় তাহলেও তাদেরকে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। এটি চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর কাজ শুরু করতে হয়। চলমান কোনো কাজে যদি এরকম বাধা কয়েকবার দেখা দেয়, তাহলে তা হয় চরম বিরক্তিকর। অনেকটা বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে দেবার মতোই।
এখন উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করে অনাকাঙ্ক্ষিত শন্দ অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু আগের দিনে সিনেমা নির্মাণে এই সুযোগ ছিল না। এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দের কারণে মাঝে মাঝে পুরো সিনেমাই নষ্ট হয়ে যেত। চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মাঝে একটি কুসংস্কার প্রচলিত আছে- যখন সিনেমার কোনো মুহূর্তে নীরবতা খুবই প্রয়োজন ,তখন উড়োজাহাজ উড়ে গিয়ে শব্দের জ্বালাতন করবেই করবে। এরকম কিছু ঘটে গেলে তারা বলে সডের সূত্র অনুসারে এই ঘটনা ঘটেছে।
একজন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতার কথা বলি। তিনি মাঝে মাঝে গবেষণামূলক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। একটি প্রামাণ্যচিত্রের শুটিংয়ের জন্য তারা একটি স্থান নির্ধারণ করেছেন। স্থানটি হলো ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড অঞ্চলের বিস্তৃত এক তৃণভূমি। তাদের ধারণা ছিল, দিনের বেলায় গেলে সেখানে অবশ্যই কোনো না কোনো শব্দ থাকবে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, সকলে মিলে খুব ভোরে চলে যাবেন। ভোরে শব্দ থাকার কথা নয়। যখন তারা সেখানে পৌঁছালেন, তখন আবিষ্কার করলেন, একজন লোক সেখানে একাকী বসে বসে বেলুনের বাঁশি বাজাচ্ছে! সম্ভবত তার স্ত্রীর সাথে রাতের বেলা ঝগড়া হয়েছে এবং স্ত্রী তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তাই উপায় না দেখে সে উদাস হয়ে ফুঁ দিয়ে বেলুনে বাতাস ভরছে এবং সেই বাতাসে বাঁশি বাজাচ্ছে। আর এই ঘটনাটা ঘটতে হলো তাদের একান্ত প্রয়োজনের সময়টিতেই। তাদের যখন একান্ত নীরবতা প্রয়োজন তখনই এই ‘কুফা’ এসে লাগলো। সডের সূত্র দেখা যায় আসলেই সত্য!
আসলে এখানে অশুভ বা অলক্ষুণে বা কুফা বলতে কিছু নেই। সত্যিকার বাস্তবতা হচ্ছে, এখানে বেশিরভাগ সময়ই শব্দের উৎপাত থাকে। এই শব্দগুলো আমরা খেয়াল করি না বা খেয়াল করার প্রয়োজন হয় না। খেয়াল তখনই করি, যখন এটি আমাদের নিজেদের কোনো কিছুতে ব্যাঘাত ঘটায়। যেমন- সিনেমার জন্য ভিডিও করার সময় অপ্রয়োজনীয় ছায়া ভেসে উঠতে পারে পর্দায়। এর আগে এটির অস্তিত্ব থাকলেও আমাদের নজরে আসে না তেমন। মানুষের একটি জন্মগত স্বভাব হচ্ছে বিরক্তিকর জিনিসকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলা। এরকম কোনোকিছু কয়েক বার ঘটলেই আমরা ধরে নেই, সমস্ত পৃথিবীর সবকিছুই বুঝি আমার বিরুদ্ধে লেগে আছে। কোনোকিছু করতে গেলে তারা কোনো না কোনো দিক থেকে ঝামেলা পাকাবেই।
আসলে সত্যিকার অবস্থা এমন না। অসামঞ্জস্যতা সবখানেই থাকে। সবসময়ই থাকে। প্রয়োজন না পড়লে আমরা তা দেখতে পাই না। প্রয়োজন পড়লে অর্থাৎ কাজের সময় আমরা তা দেখতে পাই। মাখন মাখানো রুটির কথাই বিবেচনা করি। মাখন লাগানো অংশটা কেন বেশিরভাগ সময় নিচের দিকে পড়ে, তা উদ্ধার করা খুব কঠিন কিছু নয়। হাতে বা টেবিলে মাখন লাগানো অংশটি উপরের দিকে থাকে। হাত বা টেবিল থেকে পড়ে গেলে এটি অর্ধেক বার ঘোরার সময় পায়। সম্পূর্ণ একবার ঘোরার সময় খুব কম ক্ষেত্রেই পায়। মেঝে বা ভূমি থেকে হাত কিংবা টেবিলের উচ্চতাও সবসময় প্রায় একই থাকে। তাই যখনই রুটি হাত ফসকে নিচে পড়ে যায়, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাখন লাগানো অংশটি নিচের দিকে থাকে। একাধিকবার এরকম হলে আমরা একে রংচঙ দিয়ে বলি, যত কুফা আর অশুভ জিনিস আছে আমার কপালে!
সডের সূত্রের জন্য শুটিং কিংবা পাউরুটির উদাহরণ বাদ দিয়ে সরল একটি উদাহরণ বিবেচনা করতে পারি। কয়েন দিয়ে। যখন কোনোকিছু টস করি, তখন হেড চাইলে ওঠে টেল আর টেল চাইলে ওঠে হেড- নির্মম ভাগ্য। আবার কেউ কেউ আছে আশাবাদী বা ইতিবাচক। তাদের অনুভূতি অনেকটা এরকম, আমি খেলায় যে দলকে মনে মনে সাপোর্ট করি সেই দলই টসে জিতে। আমি ‘সুফা’, আমি অমুক কালারের টি-শার্ট পরলে পক্ষের দল ছক্কা মারে আর বিপক্ষ দলের উইকেট পড়ে। চাহিদামতো ইতিবাচক ঘটার ব্যাপারটিকে বলা হয় ‘পলিয়ানার সূত্র’। কিন্তু সত্যিকার বাস্তবতার কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সডের সূত্র আর পলিয়ানার সূত্রের উভয়েই আসলে অযৌক্তিক ব্যাপার।
কার মন কী চাইছে, তা টসের কয়েন কিংবা পাউরুটির পৃষ্ঠের কারোরই বোঝার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া টসের মতো ব্যাপারগুলোতে ভালো-খারাপ উভয়ই হয়। দুই দলকে নিয়ে টস হয়, কোনো এক দল হেরে গেলে অন্য দল জিতে যায়। একজনের জন্য এটা অশুভ হলে, তার পাশেরই আরেকজনের জন্য এটি আনন্দের ও সফলতার। টেনিস খেলার দুই দলই মনে প্রাণে দোয়া করে জিতে যাবার জন্য। কিন্তু খেলায় জেতা সম্ভব একজন। কাউকে না কাউকে হারতে হবেই। দুজন জিততে চেয়ে কিন্তু একজন জিতেছে। এক্ষেত্রে যে জিতেছে সে মনে মনে বলবে, দোয়ায় যেমন চেয়েছি তেমনই পেয়েছি। আমার রাশি ভালো। যে হেরে গেছে সে বলবে, চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। যত অশুভ জিনিস আছে আমার কপালে জোটে!
এখানে খেলায় ভালো কিংবা মন্দ ভাগ্যের কোনো ভূমিকা নেই। প্রত্যেক খেলাতেই এমন হয়। জিত হয়, হার হয়। কিন্তু মানুষ মনে রাখে শুধু অমুক দিন ভাগ্যের দোষে হেরে গিয়েছিলাম। সেজন্য ‘অশুভ ঘটনা কেন ঘটে?’ কিংবা ‘শুভ ঘটনা কেন ঘটে?’ এগুলো আসলে সত্যিকার অর্থে কোনো প্রশ্নই না। তাই এগুলো নিয়ে হতাশ হয়ে বা দুঃখ করে কোনো লাভ নেই। এর চেয়ে বরং কোনো কিছু ঘটলে তাকে স্বাভাবিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করে, মন খারাপ না করে খুশি থাকাই উত্তম।