Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যাপোলো ১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প || পর্ব ৭

অ্যাপোলো ১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প || পর্ব ৬ এর পর থেকে। 

ক্রাঞ্জ আর লিবারগট সবচেয়ে বড় বিপদকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিলেও মনে মনে আশা করছিলেন স্পেসক্রাফটের বিদ্যুৎ পুনরায় ফিরে আসার ব্যাপারে। ক্রাঞ্জ পরবর্তীতে বলেন,

আমরা তখনো আশা করছিলাম ট্যাঙ্ক, জ্বালানি কোষ আর বাসের সঠিক কনফিগারেশন বের করতে পারব এবং এক নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের জ্বালানি দিয়ে স্পেসক্রাফটটাকে উড়িয়ে আনতে পারব।

অক্সিজেনের চাপ কমতে থাকলেও তিনি আশা ধরে রেখেছিলেন। স্বাভাবিক অবস্থায় যে চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৯০০ পাউন্ড থাকার কথা, সেটা নেমে এসেছিল ৩০০ পাউন্ডে। লিবারগট অবশেষে পরামর্শ দিলেন এক নাম্বার ট্যাঙ্কের হিটার আর পাখা চালু করে দিতে। এতে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে অক্সিজেনের চাপ বাড়তে পারে। ফলে ট্যাঙ্ক থেকে জ্বালানি কোষে অক্সিজেনের প্রবাহও বেড়ে যাবে।

অক্সিজেন ট্যাঙ্ক, জ্বালানি কোষ ও মেইন বাসের সরল নকশা; Image Source: New Yorker

লিবারগট টেলিমেট্রি স্ক্রিন পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি সেখানে হঠাৎ কার্যকর থাকা বাস থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিমাণ বেড়ে যেতে দেখলেন। তিনি ভাবলেন এটা হিটার আর পাখার কারণে হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য অক্সিজেনের চাপ বাড়তে দেখলেন না। বরঞ্চ অক্সিজেনের চাপ একই হারে হ্রাস পাচ্ছিল। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অক্সিজেনের ফুটো দিয়ে বের হওয়া আরো বেড়ে যাচ্ছিল। যখন দেখলেন অক্সিজেনের চাপ প্রতি ইঞ্চিতে তিন পাউন্ড কমে গেল, তিনি আবার নিরাশ হয়ে গেলেন। তখন ক্রাঞ্জকে বলেন,

আপনার এখন লুনার মডিউল নিয়ে চিন্তা করাই শ্রেয়। এলএম সিস্টেম (LM System) কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটা নিয়ে ভাবুন এবার।

দুর্ঘটনার পর ৪৭ মিনিট পেরিয়ে গেছে। ক্রাঞ্জ তখন লুনার মডিউলের দিকে মনোযোগ দিলেন। তিনি তখন টেলমু (TELMU) হেসেলমেয়ারকে নির্দেশ দেন তার লোকদের নিয়ে হিসাব করতে এলএম সিস্টেম চালু রাখতে ন্যূনতম কতটুক বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন। ক্রাঞ্জ তখনো অবশ্য কমান্ড মডিউল সম্পর্কে ভাবা একেবারে ছেড়ে দেননি। তিনি লিবারগটকে জিজ্ঞেস করেন অক্সিজেনের চাপ আগের অবস্থায় আনতে তার কাছে আর কোনো পরামর্শ আছে কী না। লিবারগট আর কোনো উপায় দেখছিলেন না। তবে তিনি তার সহযোগীদের কাছে পরামর্শ চান।

স্টাফ সাপোর্ট রুমে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের সহযোগী বিশেষজ্ঞরা; Image Source: NASA

কন্ট্রোল রুমের বাইরে স্টাফ সাপোর্ট রুমে প্রতি ফ্লাইট কন্ট্রোলারেরই সহযোগী বিশেষজ্ঞ দল ছিল। তাদেরই একজন এসে মতামত দেন, হয়তো অক্সিজেন ট্যাঙ্কে কোনো বিস্ফোরণ বা ফুটো হয়ইনি। এটা জ্বালানি কোষে হয়ে থাকতে পারে। আর এটা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তিন নাম্বার জ্বালানি কোষে, যেহেতু এটিই সবার আগে অকার্যকর হয়ে যায়। লিবারগট তৎক্ষণাৎ ক্রাঞ্জকে বলেন নভোচারীরা যেন জ্বালানি কোষের রিয়েকট্যান্ট ভালভগুলো বন্ধ করে দেন। এতে ট্যাঙ্কের সাথে কোষের সংযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। যদি তার সহযোগীর ধারণা ঠিক হয়ে থাকে, এতে ফুটো দিয়ে অক্সিজেন বের হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এটা ছিল সর্বেশেষ আশা।

এর আগে কেউ রিয়েকট্যান্ট ভালভ বন্ধ করা নিয়ে কথা না বলার কারণ হচ্ছে, এটা ছিল অপরিবর্তনীয়। জ্বালানি কোষ তখন স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে যাবে এবং চাঁদে অবতরণ করাও আর সম্ভব হবে না। ক্রাঞ্জ অবশেষে চাঁদে অবতরণের চিন্তা বাদ দিলেন। অন্যদিকে স্পেসক্রাফটে থাকা হাইস এই অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ছিলেন না। তার পাশে থাকা রিয়েকট্যান্ট ভালভের সুইচে টিপ দিয়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের মিশন বরবাদ করে দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি ক্যাপকমকে বলেন, নির্দেশটা পুনরায় দিতে। কোনো ভুল হয়েছে কিনা নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলেন তিনি। তিনি এরকম অনিশ্চয়তাপূর্ণ সময় থেকে রক্ষা পেতেন, যদি জানতেন এই ভালভ ইতোমধ্যে বিস্ফোরণের সময় থেকেই বন্ধ ছিল। কিন্তু ওই মুহূর্তে কেউ সেটা জানতেন না।

ইইকম লিবারগট; Image Source: NASA

লিবারগট তার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন জ্বালানি কোষ বিচ্ছিন্ন করায় অক্সিজেনের কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা। এটা বুঝে উঠতে সময় লাগছিল। কারণ হাইসকে তৃতীয়বারের মতো নিশ্চিত করতে হয়েছিল ভালভের সুইচ বন্ধ করার ব্যাপারে। কিছুক্ষণ পর লিবারগট দেখতে পেলেন অক্সিজেনের পরিমাণ তখনো একই হারে কমছে। তখন লিবারগট ও ক্রাঞ্জ উভয়ই নিশ্চিত হলেন, তারা কোনো সাধারণ ফুটো নিয়ে কাজ করছেন না, এখানে একটা বিস্ফোরণ হয়েছে, যার কারণে পুরো অক্সিজেন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। অবশেষে তারা মানতে বাধ্য হলেন স্পেসক্রাফটের অবস্থা এখন শোচনীয়। সৌভাগ্যবশত স্পেসক্রাফটের অবস্থা ছিল ডুবন্ত জাহাজের চেয়ে ভালো। কারণ তাদের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা একটা মহাকাশযানই মজুত ছিল।

পরবর্তীতে ক্রাঞ্জকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি নভোচারীদের জীবন নিয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন কিনা। তিনি এর উত্তরে বলেন,

হ্যাঁ এবং না। আমার মনে হয় উত্তরটা না-ই হবে। কারণ অন্য যেকোনো ফ্লাইট ডিরেক্টরদের চেয়ে আমিই লুনার মডিউল নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি। লুনার মডিউল আর ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের নিয়ে আমার অনেক আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি জানতাম লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম ভালো ছিল, গাইডেন্স সিস্টেম ভালো ছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এটা (লুনার মডিউল) নির্ভরযোগ্য স্পেসক্রাফট।

এক্ষেত্রে ক্রাঞ্জ আবারো ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের চেয়ে বেশিই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। লুনার মডিউলের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলার টেলমু (TELMU) হেসেলমেয়ার তিন নভোচারীর পৃথিবীতে ফিরে আসার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। কারণ লুনার মডিউলের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি, পানি আর নভোচারীদের জন্য যে অক্সিজেন আর পানি ছিল, তা দিয়ে দুই জন নভোচারী দুই দিন যাওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল।

দায়িত্বরত ফ্লাইট ডিরেক্টর ক্রাঞ্জ; Image Source: NASA

কিন্তু এ মুহূর্তে টেলমুকে লুনার মডিউল এমনভাবে প্রস্তুত রাখতে হচ্ছিল যেন এটা তিন জন মানুষকে নিয়ে চার দিন টিকে থাকতে পারে। কারণ জরুরি প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা রেট্রোফায়ার অফিসার ববি স্পেন্সার দুর্ঘটনার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে জানান স্পেসক্রাফট এমন দূরত্বে চলে গিয়েছে যেখান থেকে সরাসরি পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব নয়। এখন আসতে হলে চাঁদকে ঘিরে আসতে হবে। সেই বার্তা পাঠানোর পর স্পেসক্রাফট আরো তিন হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। চাঁদ ছিল তখন মাত্র ৪৫,০০০ মাইল দূরে। অন্যদিকে স্পেসক্রাফটের পেছনে থাকা পৃথিবীর দূরত্ব ছিল তার পাঁচ গুণ।

স্পেসক্রাফট যখন পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করে, তখন এর গতি ছিল ঘণ্টায় বিশ হাজার মাইল। কিন্তু পৃথিবীর অভিকর্ষ বল অতিক্রম করার পর এর গতি ধীর হয়ে দুই হাজার মাইলে নেমে আসে। চাঁদের দিকে যেতে থাকায় তখন স্পেসক্রাফটের গতি আবার বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ল। যদি দিক পরিবর্তন না করা যায়, টেলমু’র তখন লুনার মডিউলে নভোচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের পরিমাণ তিন গুণ কমিয়ে আনতে হবে এবং মডিউলের ধারণক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে।     

লুনার মডিউলের সামর্থ্য নিয়ে তখন যারা চিন্তা করছিলেন, নাসার অন্যদের মতো তারাও ভাবেননি কমান্ড মডিউল একেবারে অকেজো হয়ে পড়বে। এক ফ্লাইট কন্ট্রোলার এ প্রসঙ্গে সুইগার্টের মতোই বলছিলেন, “এই বিশেষ পরিস্থিতি হওয়াটা এতটাই অসম্ভব ছিল যে, কেউ যদি প্রশিক্ষণের সময় এরকম পরিস্থিতি সিমুলেট করতে বলত, তাহলে হয়তো অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিতাম।”

অনেকটা এ কারণেই টাইটানিক জাহাজেও খুব বেশি লাইফবোট ছিল না। যাত্রীদেরও লাইফবোট চালানো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ছিল না। নাসার প্রকৌশলীরা লুনার মডিউলকে জরুরি মহাকাশযান হিসাবে বিবেচনা করলেও ‘লাইফবোট’ হওয়ার মতো পরিস্থিতির সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেননি। সিমুলেশনে যে সমস্যাগুলো দেখা গিয়েছিল সেগুলো ছিল সাময়িক। তাদের কাছে মনে হয়েছিল কমান্ড মডিউলে কোনো সমস্যা দেখা গেলে নভোচারীরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মেরামত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন।

এরপর দেখুন- অ্যাপোলো ১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প || পর্ব ৮

Related Articles