ঝলমলে আলো সমৃদ্ধ কোনো দিনে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির পর আমরা আকাশে বর্ণালীর যে পট্টি বা ব্যান্ড দেখে থাকি এটাই আসলে রংধনু বা রামধনু। অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকা (বাস্তবে বৃত্তচাপের ন্যায়) হওয়ায় এবং বর্ণালীর আলোর পট্টি থাকায় রংধনু নামকরণের সার্থকতা নিহিত।
রংধনু গঠনের পেছনে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা এখন বিস্তৃত হয়েছে। কারণ বিজ্ঞানী নিউটন প্রমাণ করে দিয়েছেন যে সূর্যের আলো মূলত বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর যৌগিক রূপ। তিনি অন্ধকার ঘরে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করিয়ে দেখতে পান যে সূর্যের আলো প্রতিসরিত হয়ে পর্দার উপর বর্ণালীর ব্যান্ড তৈরী করে।
রংধনুও মূলত এই নীতির উপরেই গঠিত হয়। সাধারণত এক পশলা বৃষ্টির পরে পানির কণা বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়াতে থাকে। যখন সূর্যের আলো এসব পানি কণার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে তখন প্রতিটি পানি কণা একেকটি প্রিজমের মতো আচরণ করে। যদিও এক্ষেত্রে পানির কণার মধ্যে দিয়ে আলোর প্রতিসরণই রংধনু গঠন করে না। পানির পূর্ণ অভ্যন্তরীন প্রতিফলনের ফলেই সেটা দুবার প্রতিসরণের মাঝে একবার প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে রংধনু হিসেবে ধরা দেয়।
যেহেতু বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর প্রতিসরণ ক্ষমতা বা পথ একই নয়, সেহেতু যৌগিক সূর্যালোক বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিভক্ত হয় এবং আলোর পট্টি তৈরী করে।
দশকের পর দশক ধরে বিজ্ঞানীরা পানিকণার উপর ভিত্তি করে রংধনুকে শ্রেণীবিভাগ করে আসছেন। কিন্তু আসলে কেবল এই একটি বিষয়ে শ্রেণীবিভাগ করাটা ঠিক পোষায় না। পরবর্তীতে গবেষকরা বিভিন্ন রংধনুর ছবি সংগ্রহ করে এদের প্রায় বারোটি প্রজাতিতে ভাগ করেছেন। অর্থাৎ আমাদের দেখা সাধারণ একপ্রকার রংধনুর বাইরেও আরো প্রায় এগারো প্রজাতির রংধনুর দেখা মেলে। আমরা কি সেসব সম্পর্কে আদৌ জানি? চলুন জেনে নেয়া যাক সেসব রংধনু সম্পর্কে।
মুখ্য বা প্রাথমিক রংধনু
মূলত এই ধরনের রংধনুই সচরাচর আমরা দেখে অভ্যস্ত। প্রাথমিক রংধনু হচ্ছে অর্ধবৃত্তাকার এবং এতে বেগুনী থেকে লাল পর্যন্ত (অর্থাৎ বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল) একক বর্ণালী বা পট্টি দেখা যায়। এক পশলা বৃষ্টির পরেই সাধারণত প্রাথমিক ধরনের রংধনু গঠিত হয়ে থাকে। এ ধরনের রংধনুর উজ্জ্বলতা নির্ভর করে পানিকণার কত বড় বা ছোট তার উপর।
গৌণ রংধনু
যদি আপনি প্রাথমিক রংধনু দেখে থাকেন তাহলে আপনার গৌণ রংধনু দেখার সম্ভাবনা অনেক। অর্থাৎ আপনি মুখ্য বা প্রাথমিক রংধনুর সাথে সাথে গৌণটিও দেখে থাকতে পারেন। এদেরকে কখনো কখনো আবার ‘ডাবল রেইনবো’ বা দ্বৈত রংধনুও বলা হয়ে থাকে। মূলত মুখ্য রংধনুর সাথেই এটি গঠিত হয় যখন সূর্যের আলোক রশ্মি ভাসমান পানি কণার মধ্যে দিয়ে একবারের পরিবর্তে দুবার প্রতিফলিত হয়। মুখ্য রংধনুর উপরে বা বাইরের দিকে এই রংধনু গঠিত হয় এবং এদের বর্ণক্রম সাধারণত মুখ্য রংধনুর ঠিক উল্টো। মুখ্য রংধনুর থেকে আকারের দিক থেকে দ্বিগুণ হলেও এদের উজ্জ্বলতা প্রায় এক-দশমাংশ।
আলেক্সান্ডার’স ডার্ক ব্যান্ড
যদিও আলেক্সান্ডার’স ডার্ক ব্যান্ডকে বাস্তবিক অর্থে ঠিক রংধনু হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু এই ব্যান্ডে মুখ্য ও গৌণ রংধনুর মতো ব্যান্ড দেখা যায়। মূলত মুখ্য ও গৌণ রংধনুর মধ্যবর্তী এলাকাতেই এই ডার্ক ব্যান্ড গঠিত হয় এবং আকাশের বাকি অংশ থেকে এই অংশ একটু বেশি অন্ধকার দেখা যায়। মুখ্য রংধনু এর ভেতরের অংশ এবং গৌণ রংধনু এর বাইর দিকের অংশ আলোকিত করে রাখে। ফলে আমাদের কাছে আলেক্সান্ডার’স ডার্ক ব্যান্ডকে কালো মনে হয়।
সুপারনিউমেরারি রেইনবো
সুপারনিউমেরারি শব্দের অর্থ সংখ্যায় স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত। এ ধরনের রংধনুকে স্ট্যাকার রংধনুও বলা হয়ে থাকে যাদের খুব কমই দেখা যায়। স্ট্যাকার রংধনু মূলত গঠিত হয় একাধিক দুর্বল প্রজাতির রংধনুর সমষ্টি নিয়ে যারা প্রাথমিক রংধনুর অভ্যন্তরীণ অংশে অবস্থান করে। এই অংশে পানির কণাগুলোর আকার অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হলেও আকৃতি একই রকম। সূর্যের আলো যখন একবার প্রতিফলিত হয় তখন সাধারণ পথে না গিয়ে এরা একটু অন্যপথে গমন করে, ফলে দুর্বল প্রকৃতির একাধিক রংধনু গঠন করে।
মনোক্রোমাটিক রংধনু
মনোক্রোমাটিক রেইনবো অনেক সময় রেড রেইনবো নামেও পরিচিত। মূলত সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময়টিতে এক পশলা বৃষ্টির পর এই ধরনের রংধনু গঠিত হয়ে থাকে। সাধারণত এই সময়ে বর্ণালীর ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো, যেমন নীল বা সবুজ বায়ু ও ধূলিকণা দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়। এর ফলে তুলনামূলক বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো অর্থাৎ লাল ও হলুদ বর্ণী আলোই এই ধরনের রংধনু গঠন করে। সূর্য যখন অস্তগামী হয় তখন এই রংধনু গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।
ক্লাউড রেইনবো
নামের দ্বারাই বোঝা যায় যে এই ধরনের রংধনুর সাথে মেঘ জড়িত। এই ধরনের রংধনু গঠিত হয় যখন আর্দ্র পরিবেশ বিরাজ করে এবং একইসাথে মেঘের ভেতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির কণা অবস্থান করে। এই পানির কণাগুলো বৃষ্টির পানির কণা থেকেও ক্ষুদ্র হয়ে থাকে সাধারণত। ফলে ক্লাউড রেনবো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাদা বর্ণের মতো হয়ে থাকে। কারণ আমরা জানি পানি কণার আকৃতি যত বড় হবে, বর্ণালীর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রতিফলন ক্ষমতাও তত বাড়বে। এরা সাধারণ রংধনু থেকে আকৃতিতে বড় হয়ে থাকে। সচরাচর এরা কোনো বড় জলাশয়ের উপরই গঠিত হয়।
তবে পাতলা কুয়াশার কারণে এদের স্থলভাগেও দেখা যেতে পারে। এদের ফগ বো বা গোস্ট রেইনবোও বলা হয়ে থাকে।
যমজ রংধনু
যমজ রংধনু বা টুইনড রেইনবো কে ঠিক দ্বৈত রংধনু বলা চলে না। এ ধরনের রংধনু বেশ বিরল হয়ে থাকে। যমজ রংধনু বলতে বোঝায় যখন দুটি রংধনু একই পাদবিন্দু থেকে গঠিত হয়, কিন্তু আলাদা দুটি বৃত্ত তৈরী করে। যমজ রংধনু গঠিত হওয়ার পেছনে পানি কণার আকৃতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ, ক্ষুদ্র ও অপেক্ষাকৃত বড় পানি কণা যখন একইসাথে অবস্থান করে এবং যেহেতু এদের প্রতিফলন ক্ষমতা একই রকম নয়। আবার বড় পানিকণাগুলো বাতাসের চাপে সমতলীয় হতে শুরু করে আর অন্যদিকে ক্ষুদ্র কণাগুলো এদের পৃষ্ঠটানের জন্য একসাথে থাকে। ফলে এরা দুটি রংধনু গঠন করে, কিন্তু এদের পাদবিন্দু থাকে একই।
প্রতিফলিত রংধনু এবং প্রতিফলন রংধনু
যদিও এদের নাম প্রায় একই রকম হলেও এরা আসলে এক প্রজাতি নয়। সাধারণত কোনো বড় জলাশয়ের উপরই এদের দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিফলিত রংধনু আসলে প্রাথমিক রংধনুর মতোই, কিন্তু এরা প্রথমে পানির কণার মধ্যে দিয়ে বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের চোখের পৌঁছানোর আগেই পানিতে প্রতিফলিত হয়।
অন্যদিকে প্রতিফলন রংধনুর ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো হয়ে যায়। অর্থাৎ আগে পানিতে প্রতিফলিত হয়ে তারপর সেটা পানির কণার মধ্যে দিয়ে বিচ্ছুরিত হয় এবং তারপর আমাদের চোখে এসে পৌঁছায়। তবে এদের উজ্জ্বলতা প্রতিফলিত রংধনুর মত নয়।
রেইনবো হুইল
রেইনবো হুইল গঠিত হয় যখন ঘন কালো মেঘ বা ঘন বৃষ্টিপাতের কারণে সূর্যের আলো আমাদের চোখে পৌছাতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। এই বৃষ্টির ফোটাগুলোর কারণেই রংধনুর বর্ণসমূহ আমরা দেখতে পারি না। ফলে এই ধরণের রংধনু অনেকটা বড় স্পোকওয়ালা ওয়াগন হুইলের মত দেখা যায় যারা একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দু থেকে আসছে বলে মনে হয়। মজার ব্যাপার হলো যখন ঘন মেঘ সরে যেতে থাকে তখন মনে হয় রংধনুর এই হুইলটি যেন ঘুরছে।
লুনার রেইনবো
আমরা সচরাচর দিনের বেলাতেই রংধনু দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু কেমন হয় যদি রাতের বেলায় রংধনু দেখা যায়। লুনার রেইনবো সেরকমই এক বিরল প্রজাতির রংধনু। মূলত জ্যোৎস্নালোকিত রাতে এই ধরনের রংধনুর দেখা পাওয়া যায়। যেহেতু জ্যোৎস্নার আলো ঠিক ততটা শক্তিশালী নয় কাজেই লুনার রেইনবো খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের রংধনু দেখার উপযুক্ত সময় হলো যখন উজ্জ্বল পূর্ণিমা রাতে বৃষ্টি হয়ে থাকে। এ সময়ে আকাশ অবশ্যই কালো হতে হয়। ফলে লুনার রেইনবো কিছুটা বিবর্ণ দেখায়, কারণ এ সময়ে রাত আমাদের রেটিনার কোন কোষগুলোকে উদ্দীপিত করতে সক্ষম হয় না।
পূর্ণ বৃত্তীয় রংধনু
যখন সূর্যের আলো আর পানির কণা মিলে রংধনু গঠন করে তখন এরা পুরোপুরি একটি বৃত্তের আকারেও রংধনু তৈরী করতে পারে। তবে এ ধরনের রংধনু বেশ বিরলতর। কারণ এজন্য প্রয়োজন হয় আকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। তবে এ ধরনের রংধনু দেখার জন্য সমতল থেকে কিছুটা উপরে ওঠার প্রয়োজন হয়। কারণ সমতলে থাকাকালীন অবস্থায় দিগন্তরেখা কারণে পুরো বৃত্ত দেখা যায় না।
তো আমরা সচরাচর যে রংধনু দেখে থাকি সেটি মুখ্য বা প্রাইমারি রংধনু। কিন্তু এর বাইরেও আছে আরো অনেক প্রজাতির রংধনু। সব পরিবেশে বা সবসময়ে এদের দেখা মেলা খুবই কঠিন। তবে বায়ুতে যদি কোনো প্রকারে ভাসমান পানি কণার উপস্থিতি থাকে সেখানেই রংধনু দেখার সম্ভাবনা সর্বাধিক।
ফিচার ইমেজ: wallpapersbrowse