Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যাপোলো ১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প || পর্ব ১১

(পর্ব ১০ এর পর থেকে) 

ট্রেঞ্চে থাকা অফিসারদের এর আগে কখনো রকেট চালুর সময় নিজেদের এতটা পাইলটদের মতো মনে হয়নি। গাইডো যখন ফিডোর কাছ থেকে স্পেসক্রাফটের গতিপথ সংক্রান্ত তথ্য গ্রহণ করেন, তিনি সামনে থাকা সাদা কিবোর্ডে সেই সংখ্যাগুলো টাইপ করতে থাকেন কম্পিউটারে ডেটা প্রবেশ করানোর জন্য। এরপর স্পেসক্রাফটের কম্পিউটারের ডেটার সাথে সেগুলো মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেন। অন্যদিকে রেট্রো অফিসার রকেটের জ্বালানি পোড়ানো সম্পর্কিত নির্দেশনা লিখছিলেন। সামনে বক্সে থাকা সবুজ রঙের কৌশল লিখার কাগজগুলোতে তিনি লিখছিলেন কোন মুহূর্তে রকেট চালু করা হবে, কত সময় ধরে চালু থাকবে এবং সে সময় স্পেসক্রাফটের অবস্থান কেমন হবে। ক্যাপকম সেই সংখ্যাগুলো লাভেলকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। লাভেল আবার একইরকম সবুজ রঙের কাগজে টুকে নিয়েছিলেন। তারপর তিনিও সেটা পড়ে শুনিয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন। শেষে কম্পিউটারে সেই নির্দেশনাগুলো প্রবেশ করান।

ট্রেঞ্চের পেছনের সারির ‘কারিগররাও’ পাইলটদের মতোই ব্যস্ত ছিলেন। কন্ট্রোল অফিসারদের লুনার মডিউলের মূল রকেট চালু করার জন্য নির্দেশনাগুলোকে বিশেষায়িত করার প্রয়োজন ছিল। এই কাজটাকে বলা হতো ডিসেন্ট প্রপালশন সিস্টেম (Descent Propulsion System) বা সংক্ষেপে ডিপিএস, যাকে তারা ‘ডিপস’ (dips) উচ্চারণ করতেন। কমান্ড মডিউলে জিএনসি’র দায়িত্বের মতো লুনার মডিউলের দায়িত্ব ছিল কন্ট্রোল অফিসারের।

লুনার মডিউল; Image Source: NASA

লুনার মডিউলের রকেটটা ছিল সম্মিলিত স্পেসক্রাফটে সার্ভিস মডিউলে থাকা বড় রকেটের বিপরীত প্রান্তে। এই রকেটটা সার্ভিস মডিউলের রকেটের মতো অত শক্তিশালী না হলেও বেশি সময় ধরে জ্বালানি পোড়ানো হলে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার মতো ছিল। তখন প্রত্যেকের মনেই কিছু প্রশ্ন ছিল ডিপিএসের কার্যকারিতা নিয়ে। কেউই তখন জানতেন না ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত। ডিপিএসও হয়তো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে, এমন সন্দেহ ছিল অনেকের মনে।

রকেট চালুর পূর্বে ক্যাপকম নভোচারীদের জানান, ডিপিএস রকেটের সম্মুখভাগ ঠিকমতো অবস্থানে রাখা হয়নি। এতে স্পেসক্রাফটের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। তখন নভোচারীরা শেষ বারের মতো তাদের কন্ট্রোল প্যানেল আরেক বার দেখে নিলেন। তাদের একজন জানান সেখানে একটা সুইচ অন করা আছে, যেটা অন করা থাকলে লুনার মডিউলের নিচের অর্ধেক অংশ আলাদা হয়ে পড়ে। এটা সাধারণত চাঁদে ফেলে আসা হয়। ওই অংশেই ছিল ডিপিএস রকেট। ক্যাপকম তাদের জানান সুইচটা অফ করে দিতে।

লুনার মডিউলে নভোচারী জিম লাভেল; Image Source: NASA

দুর্ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা পর রাত ২টা ৪৩ মিনিটে লাভেল বাম হাত দিয়ে একটা সুইচ টিপলেন। ত্রিশ সেকেন্ড সময় ধরে তিনি মেঝের দিকে চাপ অনুভব করলেন। ওই মুহূর্তে ওটাই ছিল রকেট চালু হওয়া বোঝার একমাত্র ইঙ্গিত। পরবর্তীতে স্পেসক্রাফটের গতির দিক ক্ষুদ্র সংশোধন করা হলে এটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে ভারত মহাসাগরে পতিত হয় চার দিনেরও কম সময়ে। রিকভারি অফিসাররা ভারত মহাসাগরে কোনো জাহাজ মোতায়ন করেননি। ফলে তাদেরকে দ্রুত কাজ করতে হচ্ছিল এটা নিয়ে।

সবচেয়ে নিকটবর্তী আমেরিকান নৌবাহিনীর জাহাজ ছিল ডেস্ট্রয়ার বরডিলন। বরডিলন ছিল নৌবাহিনীর বিশেষায়িত জাহাজগুলোর একটা, যা সমুদ্র থেকে ক্রেনের মাধ্যমে সার্ভিস মডিউল তুলে আনতে সক্ষম। কিন্তু রিকভারি অফিসারদের ভার্জিনিয়ার নরফক থেকে ক্রেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে হয় মরিশাসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল মরডিলন সমুদ্রবন্দরে গিয়ে ক্রেন নিয়ে ৭০০ মাইল দূরে নভোচারীদের অবতরণের সম্ভাব্য স্থানে যাবে তারা পৌঁছানোর আগেই।

রাতের বাকি সময়টা ছিল পুরোটাই অবস্থান ধরে রাখার মিশন। বিশেষ করে টেলমু অফিসাররা চাচ্ছিলেন লুনার মডিউলে থাকা মজুদগুলো বেশি খরচ না করতে, যা নিয়ে অন্য ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের সাথে তাদের বিরোধ হচ্ছিল। রকেটের জ্বালানি পোড়ানো শেষ হলে টেলমু তৎক্ষণাৎ নভোচারীদের অনুরোধ করেন যন্ত্রগুলো বন্ধ করে দিতে। বিশেষ করে গাইডেন্স কম্পিউটার প্ল্যাটফর্মকে সচল রাখায় পানি ও বিদ্যুতের খরচ হচ্ছিল। নভোচারীরা ১৫ ঘণ্টা পর চাঁদকে ঘিরে আসার আগ পর্যন্ত সময়টা গাইডেন্স প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন ছিল না।

কন্ট্রোল রুমে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা; Image Source: NASA

গাইডো তখনই এ সিদ্ধান্তে আপত্তি জানান। তিনি কমান্ড মডিউল অতি সতর্কতার সাথে স্থানান্তরিত করা প্ল্যাটফর্মের শ্রেণিবিন্যাস হারিয়ে ফেলতে চাচ্ছিলেন না। টেলমু জবাব দেন পরবর্তীতে রকেট চালুর আগে সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের মাধ্যমে তারার ঔজ্জ্বল্য দেখে প্ল্যাটফর্মের নতুন বিন্যাস নির্ণয় করতে পারবেন। গাইডো নিশ্চিত ছিলেন এটা আদৌ সম্ভব হবে কী না। রেট্রো দিয়েত্রিখ জেদ করেন পুরো সময়টাই প্ল্যাটফর্ম চালু রাখার জন্য। ফ্লাইট ডিরেক্টর লানি রক্ষণশীল মেকানিকদের চেয়ে পাইলটদের সাথেই বেশিরভাগ সময় একমত হলেও তিনি এখানে প্ল্যাটফর্ম চালু রাখার ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেন। যদিও প্ল্যাটফর্মে ব্যবহৃত ড্যাশবোর্ড ডিসপ্লে এফডিএআই (FDAI) বলগুলো বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

এই সিদ্ধান্ত নিচের তলায় হোয়াইট টিমে থাকা দুই টেলমু অফিসার পিটার্স আর হেসেলমেয়ারকে চিন্তায় ফেলে দেয়। এটা সত্য যদি সবকিছু ঠিকমতো হয়, তাহলে নভোচারীদের পৃথিবীতে ফিরে আসতে চার দিনেরও কম সময় লাগবে। তারপরও টেলমুদের সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে মজুদ নিয়ে রক্ষণশীল পন্থায় চিন্তা করতে হচ্ছিল। বিদ্যুতের চেয়ে লুনার মডিউলের বৈদ্যুতিক গিয়ার ঠাণ্ডা রাখার জন্য পানির সরবরাহ নিয়েই তাদের বেশি চিন্তা করতে হচ্ছিল।

পানি আর বিদ্যুতের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক ছিল। যন্ত্রগুলো যত বিদ্যুৎ ব্যবহার করছিল, তত পানির প্রয়োজন হচ্ছিল। তাই যন্ত্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিলে পানিগুলো বাঁচিয়ে রাখা যেত। যন্ত্র ঠাণ্ডা করার প্রক্রিয়া অনেকটা গাড়ির ইঞ্জিন ঠাণ্ডা রাখার মতো। কিন্তু এখানে পানি পুনরায় ব্যবহার করা যায় না। লুনার মডিউলে যখন বিদ্যুৎ চালু থাকে, পানিগুলো বাষ্প হয়ে মহাশূন্যে চলে যায়। এই প্রক্রিয়া এত মৃদুভাবে হয়, যে এটা কখনো স্পেসক্রাফটের গতিপথকে পরিবর্তন করে না।  

স্পেসক্রাফটে থাকা লিথিয়াম হাইড্রোক্সাইড রাখার অংশ; Image Source: NASA

টেলমুর সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রয়োজনীয় সম্পদ মজুদ করা নিয়ে ছিল না। বরং এর উল্টোটা। সেটা হচ্ছে নভোচারীদের নিঃশ্বাসের সাথে বের হয়ে যাওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড। সাধারণত লুনার মডিউল বা কমান্ড মডিউলে থাকা বাতাস লিথিয়াম হাইড্রোক্সাইডের পিলেটের মাধ্যমে দূরীভূত হতো। ছোট সাদা নুড়ি পাথরের মতো অংশগুলোর কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রতি আকর্ষণ ছিল। এই পিলেটগুলো এক প্রকার ছোট কন্টেইনারে রাখা হতো, যাতে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। পিলেটগুলো দূষিত বায়ু টেনে নিয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড জমা রেখে বিশুদ্ধ বাতাস আবার ফিরিয়ে দিত। যখন একটা কন্টেইনার তার ধারণক্ষমতার কার্বন ডাইঅক্সাইড জমা করে ফেলত, তখন এটা বদলে নতুন কন্টেইনার রাখতে হতো।

মূল সমস্যা ছিল নভোচারীরা ফিরে আসার সময় পর্যন্ত লুনার মডিউলে প্রয়োজনীয় কন্টেইনারের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকা। কমান্ড মডিউলের বায়ু চলাচল ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান ছিল কমান্ড মডিউলের কন্টেইনারগুলো লুনার মডিউলের বায়ু বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। কারণ এগুলো লুনার মডিউলে ব্যবহার উপযোগী ছিল না। কারণ লুনার মডিউলকে ‘লাইফবোট’ হিসাবে ব্যবহার করা কখনো পরিকল্পনায় ছিল না। টেলমু তখন এই সমস্যা সমাধানের ভার ক্রু সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারসদের হাতে তুলে দিলেন। কারণ এ ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে তারাই কাজ করে। নভোচারীরা দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে এ সমস্যা সমাধানের জন্য তারা মাত্র দুই দিন সময় পাবেন।

(এরপর দেখুন পর্ব ১২ তে) 

Related Articles