পরিবেশ দূষণের অন্যতম একটি কারণের নাম বলতে বললে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরেই পলিথিনের নাম আসবে। মাটিতে না মেশা, মাটির উর্বরতা নষ্ট করা, আবার পুড়িয়ে ধ্বংসের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় বিষাক্ত গ্যাস উৎপাদন যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ; শুধু পলিথিন নয়, প্লাস্টিকজাতীয় সব বস্তুর ক্ষেত্রেই এসব তথ্য সত্য। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক তৈরি হচ্ছে এবং কাজের শেষে তাদের গন্তব্য হয় সাগর, নদী-নালা, নর্দমা বা মাটি। প্লাস্টিক যে ধ্বংস হয় না তা নয়, তবে সময় লাগবে বহু বছর। বহু বছর পর রায়ায়নিক বন্ধন শিথিল হয়ে টুকরো টুকরো হয়। এ সময় এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরিত হয় যেগুলো মাছ এবং বিভিন্ন জলজ প্রাণীরা খাবার ভেবে বিভ্রান্ত হতে পারে। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিক নিয়ে মানুষের যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন সামান্য একটি ছত্রাক দেখাচ্ছে মুক্তির সম্ভাবনা।
হ্যাঁ, এমনই এক ছত্রাকের দেখা মিলেছে যেগুলো খুব সহজেই প্লাস্টিকের দৃঢ় বন্ধনগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে কয়েক সপ্তাহেই! চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের গবেষকগণ পাকিস্তানের বিজ্ঞানীদের সাথে একজোট হয়ে পাকিস্তানের ইসলামাবাদের একটি ময়লার ভাগাড় থেকে আবিষ্কার করেছেন এই ছত্রাক। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aspergillus tubingenesis (অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনেসিস)। অনেকটা শকুনি দৃষ্টি দিয়ে গবেষকগণ নমুনা জোগাড় করেন ময়লার ভিতর থেকে। নানা প্রকারের ময়লা তারা সংগ্রহ করেন। বিশ্বাস একটিই, নিশ্চয়ই এমন কোনো অণুজীবের দেখা মিলবে যেটি প্লাস্টিককে মিশিয়ে দিতে।
সংগৃহীত নমুনাগুলোকে অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র এবং বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করে তারা একধরনের ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের দেখা পান, যেগুলো এদের দেহের মাইসেলিয়ার (অণুজীবের দেহ থেকে বের হওয়া শিকড়ের ন্যায় সূত্রবিশেষ) শক্তি ব্যবহার করে পলিমারকে ভেঙে দিতে পারে। গবেষকদল বলেন, প্রাকৃতিকভাবে পলিমার বন্ধন ভাঙতে যেখানে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে, সেখানে এই ছত্রাকগুলো কয়েক সপ্তাহেই ভেঙে দিতে পারে।
অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনেসিস
অ্যাসপারগিলাস টুবেনজেনেসিস এমন একধরনের ছত্রাক যা সাধারণত মাটিতে থাকে। তবে গবেষণাগারে এগুলোকে প্লাস্টিকের উপর বেড়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। ২০১৭ সালের এই গবেষণাটিতেই প্রথম জানা গেল এর সম্পর্কে তা কিন্তু নয়। ১৯৩০ সালে রাউওল মোজেরে নামক একজন বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম এই ছত্রাকটির বর্ণনা দিয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক নামটিও মোজেরেরই দেওয়া। তার মতে, এই ছত্রাকটি ‘বর্ডারলাইন এক্সট্রেমোফাইল’ অর্থাৎ এটি অতি প্রতিকূলতায়ও বেঁচে থাকতে পারে। এটি অতিবেগুনী রশ্মি সহনশীল এবং অত্যাধিক তাপমাত্রা (৩০-৩৭ ডিগ্রি সে.) এর বৃদ্ধি ঘটে, যেখানে অন্যান্য প্রজাতিগুলো ২১-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছাড়া পারে না। তবে এর লৈঙ্গিক ধরণ সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে কিছু জানা যায় নি। ধারণা করা হচ্ছে, অযৌন জনন প্রক্রিয়ায় এদের বংশবৃদ্ধি ঘটে। তবে কালো অ্যাস্পারগিলাসদের সাথেও এটি সম্পর্কযুক্ত। শুধু তা-ই নয়, এর যৌন বৈশিষ্ট্যের সাথে পেক্টোমাইসিস গোত্রের যৌন বৈশিষ্ট্যেরও মিল পাওয়া গিয়েছে।
অ্যাস্পারগিলাস টুবিনজেনেসিস নামক ছত্রাকটির কনিডিয়াগুলোর ব্যাস মোটামুটি ৩-৫ মাইক্রোমিটার এবং সেগুলো খুব বেশি অমসৃণ। কখনো কখনো সাদাটে বা গোলাপী বর্ণের ০.৫-০.৮ মি.মি. ব্যাসবিশিষ্ট স্ক্লেরোশিয়ার সৃষ্টি হয়। এটি অক্রাটক্সিন, অ্যাসপারাজিন, পাইরানোগ্রিন এ, পারোফেন, ফিউনালেনান এবং কোটানিনের মতো এক্সটোলাইট তৈরি করতে পারে। এছাড়াও এই ছত্রাকগুলোকে ক্রিয়েটিন সুক্রোজ আগার (CREA) মাধ্যমে কালচার করলে খুব ভালভাবে এসিড সৃষ্টি করে এবং বৃদ্ধির গতিও মোটামুটি ভালোই থাকে। ১৫-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এরা মাইকোটক্সিন এবং অক্রাটক্সিন উৎপাদন করতে পারে।
অ্যাসপারগিলাস গোত্রের আরেকটি সদস্য Aspergillus niger এর সাথে এর যথেষ্ঠ মিল থাকায় অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে এদেরকে আলাদা করা কঠিন। এমনই একটি পদ্ধতি হলো এরলিক বিক্রিয়া (Ehrlich reacton)। এছাড়া অ্যাসপারজিন উৎপাদন দেখেও অ্যাসপারগিলাস গোত্রের অন্যান্য প্রজাতি থেকে টুবিনজেনেসিসকে আলাদা করা যায়।
অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনেসিস এর pH এর মান অনেক কম, অর্থাৎ এটি এসিডীয় এবং কম পানিযুক্ত স্থানকে বসবাসের জন্য উপযুক্ত মনে করে। থাইল্যান্ড এবং চীনে এর প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও পৃথিবীর উষ্ণতম দেশগুলোতে দেখা মিলবে এই ছত্রাকের। কখনো কখনো ঘরের মধ্যেও দেখা দিতে পারে এই ছত্রাক, বিশেষ করে ক্রোয়েশিয়া এবং তুরস্কে। এছাড়াও নেদারল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং আলজেরিয়াতেও এর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
উপকারিতা
– এই ছত্রাকটি যেহেতু মাইকোটক্সিন উৎপাদন করতে পারে তাই জৈবপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এবং শৈল্পিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে।
– এছাড়াও এটি অ্যামাইলেজ, লাইপেজ, গ্লুকোজ, গ্লুকোজ অক্সাইড, ফাইটেজ, জিলানেজ, এবং এসিড ফসফেটের মতো প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানগুলো তৈরি করতে পারে। অবিশুদ্ধ পানি এবং চিটাগুড়ের অবশিষ্টাংশ থেকে বায়ো-ইথানল প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে এই টুবেনজেনেসিসের উৎপাদিত অ্যামাইলেজ।
– এ টুবেনজেনেসিস ছত্রাকটি কিছু জৈবিক এসিডও উৎপাদন করতে পারে, যেমন- সাইট্রিক এসিড, অ্যাসকরবিক এসিড ইত্যাদি, যেগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
– শস্য উৎপাদনে, বিশেষ করে ভুট্টা উৎপাদনের জন্য মাটি প্রস্তুতিতে এটি খুবই কার্যকরী একটি ছত্রাক হিসেবে পরীক্ষিত। এটি মাটির ফসফেট মুক্ত করে এবং মাটির ক্ষারত্ব কমিয়ে দিতে পারে।
– টমেটো গাছকে প্যাথোজেনিক রোগসৃষ্টিকারী ছত্রাক থেকে মুক্ত রাখে এই টুবেনজেনেসিস। এছাড়াও আঙুর উৎপাদনেও রয়েছে এর উল্লেখযোগ্য উপকারী ভূমিকা।
– বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ভূমিকা এই ছত্রাকটি পালন করছে তা হলো প্লাস্টিক ধ্বংস করা। প্লাস্টিকের মধ্যে যে অসংখ্য পলিমার বন্ধন আছে তা খুব সহজেই ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে।
অপকারিতা
আশার পরেও রয়ে যায় হতাশা। খুব বেশি নয়, ভাবুন তো গত ৭০ বছরে ঠিক কত প্লাস্টিক, কত পলিমার বন্ধন পৃথিবীতে কৃত্রিম উপায়ে বানানো হয়েছে শুধুমাত্র মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাবার জন্য? প্লাস্টিকের বালতি, জগ, গামলা, মগ, চকলেটের কৌটা, ফোম, সিনথেটিক লেদার, রঙ, রেফ্রিজারেটরের ইনসুলেশন, পলিথিন ব্যাগ ইত্যাদি অসংখ্য প্লাস্টিক পণ্যে পলিমার বন্ধনের সংখ্যাও কম নয়। অথচ এই ক্ষুদ্র ছত্রাকগুলো সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচ মিলিয়ন হবে। এছাড়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, সব ধরনের প্লাস্টিককে ভেঙে দেবার ক্ষমতাও এদের নেই।
মানুষের উপর একেবারেই খারাপ প্রভাব নেই তা-ও নয়। যদিও আমেরিকার খাদ্য এবং ঔষধ প্রশাসন (FDA) এর তথ্যানুযায়ী এই ছত্রাকটি নিরাপদ। অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনেসিসের দ্বারা ‘কেরাটাইটিস’ নামক কর্নিয়াল ইনফেকশন হবার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া এরা ম্যাক্সিলারি হাড়ে ইনফেকশনও সৃষ্টি করতে পারে যার প্রভাবে দাঁত পড়ে যেতে পারে বা তুলে ফেলতে হতে পারে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় ফুসফুসীয় রোগে আক্রান্ত রোগীদের শ্বাসনালীতে ধরা পড়েছে এই অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনেসিস।
শেষ কথা
বিজ্ঞানীরা এখনো জোর গবেষণা চালাচ্ছেন। অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনেসিসের মতো আরও প্রাকৃতিক অণুজীবের দেখা নিশ্চয়ই মিলবে, যেগুলোকে সম্মিলিতভাবে ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণের মতো সমস্যার সমাধান করে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করা যাবে।