কৌতূহলটা জেগেছিল সামান্যই এক ছবি থেকে। প্রথম দেখায় যে ছবির মানুষগুলোকে চীনা কোনো বহরের যাত্রী বলেই মনে হয়েছিল, দুয়েকজনকে দেখে একটু-আধটু উপমহাদেশীয়ও ঠেকেছিল, অতঃপর সামনের পতাকা দেখে ভুলটা শুধরে নিতে হয়েছিল, আদতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছিল!
অন্তর্জালে খানিকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করতেই মিটেছিল কৌতূহল। প্রথম দেখায় চীনা দল বলে মনে হওয়াটা ঠিক এই লেখকের ভুল নয়, তাদের পূর্বপুরুষের নাড়ি পোঁতা রয়েছে চীনদেশেই। যে দুজনকে উপমহাদেশীয় বলে ভ্রম জেগেছিল, তারাও আদতে ভারতীয়-বংশোদ্ভূতই। ৩০ হাজার আমেরিকান শিক্ষার্থীকে টেক্কা দিয়ে যারা পেয়েছিল রোমানিয়ায় হয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের ৫৯-তম আসরে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ, পরে তো ১১৫ দেশকে হারিয়ে জিতে নিয়েছিল শিরোপাই।
মূল প্রশ্নটা জেগেছিল তারপরেই, কেন আমেরিকাতে জাত আমেরিকান শিক্ষার্থীরাই পিছিয়ে পড়ছেন এশিয়ান-আমেরিকান শিক্ষার্থীদের চেয়ে? গণিত অলিম্পিয়াডের সর্বশেষ ৩১ আসরে পদক তালিকার শীর্ষে এশিয়ার প্রতিনিধি চীনের নামটা দেখা গিয়েছে ২০ বার, কিংবা ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী ছয় লাখ শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচালিত এক পরীক্ষায় গণিত শিক্ষার জন্য সেরা দেশ নির্বাচিত হয়েছে সিঙ্গাপুর, এই তথ্যগুলো জানবার পরে জিজ্ঞাসাটি জোরালো হয়েছিল আরও, ‘গণিতে কিংবা বিজ্ঞানে, এশিয়ানদের এমন জয়জয়কারের রহস্য কোথায় লুকিয়ে?’
প্রশ্নটি এই লেখকের মতো নিশ্চয়ই আপনারও, এবং আমাদের দলে আছেন বিখ্যাত লেখক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলও। তারই লেখা বহুল পঠিত বই ‘আউটলায়ার্স’কে পুঁজি করে এবং আরও কিছু গবেষণা-অনুসন্ধানকে সঙ্গী করে এই লেখক আপনাকেও জানানোর চেষ্টা করছেন কারণগুলো।
এশিয়ার অধিক কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা
কিছুদিন আগেও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে মুখস্থবিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছিল বেশ শক্তকণ্ঠেই। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গণিতের প্রফেসর জো বোয়ালারের মতে,
“আমরা মুখস্থবিদ্যায় যত বেশি জোর দেবো, শিক্ষার্থীরা সংখ্যা নিয়ে ভাবতে তত বেশি অনুৎসাহী হবে, তাদের ভেতরে নাম্বার সেন্স তত কম পরিমাণ বাড়বে।”
কোমলমতি শিশুদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পশ্চিমা দেশগুলো জোর দিচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কোন বিষয়গুলো জানতে চায় তার ওপরে। অর্থাৎ, পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করবে শিক্ষার্থীরাই, শিক্ষক কেবল ক্লাসে আসবেন তাকে খানিকটা সাহায্য করতে। বিপরীতে, চীন-জাপান এখনো আঁকড়ে ধরে আছে পাঠদানের সেই সনাতন পদ্ধতিকেই। চীনে এখনও শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে ঢুকে হাতে তুলে নেন চক-ডাস্টার, শিক্ষার্থীরা হয়ে যায় মন্ত্রঃমুগ্ধ শ্রোতা। জাপানি শিশুদের নামতা মুখস্থ করবার কসরত শুরু হয় সাত কিংবা আট বছর বয়স থেকে। ছড়া আবৃত্তির মতো করে শেখা এই নামতা মস্তিষ্কে জমা হয়ে যায় আজীবনের জন্যে। তিন-চার সংখ্যার গুণ-ভাগগুলোও ক্যালকুলেটর ছাড়াই কষবার সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে তারা গণিত শিক্ষায় ব্যয় করে সপ্তাহে প্রায় তিন ঘণ্টা।
গবেষণা বলছে, ব্রিটেন-আমেরিকার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে চীন-জাপানের এই প্রাচীনপন্থী শিক্ষাব্যবস্থাই ফল দিচ্ছে বেশি। তাদের দাবি, বিলেতি শিশুদের চেয়ে এ কারণে চীনা শিক্ষার্থীরা নম্বর পাচ্ছে অন্তত ত্রিশ শতাংশ বেশি।
যেহেতু, চীনা অঙ্কগুলো বলতে সহজ
একবার এই সংখ্যাগুলো শব্দ করে পড়তে চেষ্টা করুন তো: ৪, ৮, ৫, ৩, ৯, ৬, ৭। এবারে অন্য দিকে তাকিয়ে ২০ সেকেন্ড সময় নিন এবং সংখ্যাগুলো ধারা মেনে আত্মস্থ করবার চেষ্টা করুন। ২০ সেকেন্ড পরে বলে আরেকবার মুখ ফুটে বলে দেখুন তো! যদি আপনি ইংরেজিতে পড়ে থাকেন, তবে আপনার সফল হবার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ। কিন্তু একই সংখ্যাগুলো যদি আপনি মান্দারিন (চীনের প্রধান ভাষা) ভাষায় মনে রাখতে চেষ্টা করে থাকেন, তবে নিশ্চিত থাকুন, আপনি প্রায় শতভাগ সময়ই সফলকাম হবেন।
সংখ্যাগুলো একই রইছে, তবুও এই ফারাকটা কেন হচ্ছে? কারণ মানব-মস্তিষ্কর ধরনটাই এমন, এর মধ্যে ওই অঙ্কের লুপগুলোই সবচেয়ে ভালো সংরক্ষিত থাকে, যা দুই সেকেন্ডের ভেতরে বলে ফেলা যায়। ইংরেজিতে ৪, ৮, ৫, ৩, ৯, ৭, ৬ বলতে গেলে সময়টা দুই সেকেন্ডের বেশি দরকার পড়ে অবধারিতভাবেই। কেননা, ‘এইট’, ‘ফাইভ’, ‘সেভেন’, ‘নাইন’ শব্দগুলোর প্রত্যেকটি উচ্চারণেই সময় লাগে প্রায় ০.৩৩ সেকেন্ড করে। বিপরীতে মান্দারিন ভাষায় অঙ্কগুলো ছোট (যেমন: ৪-কে চীনারা বলেন ‘si’, ৭-কে বলেন ‘qi’) বিধায় বেশিরভাগ অঙ্কই উচ্চারণ করা যায় ০.২৫ সেকেন্ডের কমে। যে কারণে প্রথমে উল্লিখিত অঙ্কগুলো মনে রাখতে গিয়ে যতটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় ইংরেজদের, চীনাদের ততটা নয়।
অর্থাৎ, আমরা বলতে পারছি, উচ্চারণের সহজতার সঙ্গে মনে রাখবার সম্পর্কটা সমানুপাতিক। চীনা উচ্চারণ সহজ বিধায় তারা অঙ্ক মনে রাখতে পারছে ইংরেজদের চেয়ে বেশি।
এগারো মানে দশ-এক
সংখ্যার নামকরণ পদ্ধতির দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয়, এশিয়ানদের সঙ্গে পশ্চিমাদের বিরাট তফাৎ রয়েছে এক্ষেত্রে। ইংরেজিতে আমরা বলছি, সিক্সটিন (১৬), সেভেন্টিন (১৭), এইটিন (১৮), কিংবা নাইনটিন (১৯)। সদ্যই ইংরেজি শিখতে বসা কেউ যদি ধারণা করে নেন, এর আগের সংখ্যাগুলোগুলো হবে ওয়ানটিন (১১), টুটিন (১২), থ্রিটিন (১৩) তবে তাকে দোষ দেয়া যায় না খুব একটা। কিন্তু পড়তে গিয়ে তিনি জানতে পারবেন, ওয়ানটিনকে তাকে বলতে হবে ইলেভেন, টুটিনকে টুয়েলভ, একইভাবে থ্রিটিনকে থার্টিন। আবার, যখন তিনি পড়তে যাবেন ফর্টি কিংবা সিক্সটি, তখন তিনি ভেবে বসতে পারেন, সংখ্যাগুলোর নৈকট্য বোধহয় চল্লিশ (ফোর) কিংবা ষাটের (সিক্স) ঘরের সঙ্গে। একই বক্তব্য খাটছে টোয়েন্টি, থার্টি অথবা ফিফটির ক্ষেত্রেও, প্রথম পড়তে বসা যে কেউই ভেবে নিতে পারেন- সংখ্যাগুলো যথাক্রমে দুই (টু), তিন (থ্রি) এবং পাঁচের (ফাইভ) সঙ্গে সম্পর্কিত। আদতে ঘটনা কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই সমস্যার সমাধানে বিশের ওপরের সংখ্যাগুলোতে ইংরেজরা দশকের ঘরের অঙ্কটিকে উচ্চারণ করেন আগে (যেমন: ২১ মানে টোয়েন্টি-ওয়ান), কিন্তু ‘টিন’ সংখ্যাগুলোতে এককের ঘরের অঙ্কটিকে তারা উচ্চারণ করছেন আগে (১৪-কে বলা হচ্ছে ফোর্টিন)। সব মিলিয়ে ইংরেজিতে সংখ্যা শেখার প্রক্রিয়াটা তাই হয়ে পড়ছে ভীষণ জটিল। বিপরীতে, চীনা ভাষাভাষীদের জন্যে এ সমস্যাটি নেই বললেই চলে। তারা শেখে এগারো মানে দশ-এক, বারো মানে দশ-দুই, চব্বিশ মানে দুই-দশ-চার।
সংখ্যা উচ্চারণের এই সহজীকরণের জন্য চীনা শিশুরা গুনতে শেখে আমেরিকানদের বেশ আগে। এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, চার বছর বয়সী একজন চীনা বালক গুনতে পারে চল্লিশ পর্যন্ত, বিপরীতে একই বয়সী একজন আমেরিকান শিশু গুনতে শেখে কেবলমাত্র পনেরো পর্যন্ত, এবং চল্লিশ অব্দি পৌঁছুতে বেশিরভাগ আমেরিকানদের বয়সই পেরিয়ে যায় পাঁচের কোটা।
সংখ্যা নামকরণের এই পার্থক্যের জন্য আমেরিকানদের চেয়ে চীনা শিশুরা বাড়তি সুবিধা পায় যোগ কিংবা বিয়োগ করতে গিয়েও। সাত-বছর বয়সী একজন আমেরিকানকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, খাতা-কলম ছাড়াই থার্টি-সেভেনের সঙ্গে টোয়েন্টি-টু যোগ করো, প্রথমে তাকে সংখ্যাগুলো সাজিয়ে নিতে হয় মাথার ভেতরে (৩৭ এবং ২২)। কেবলমাত্র এরপরেই সে মন দিতে পারে যোগ করাতে। বিপরীতে একই বয়সী একজন চীনা শিক্ষার্থীকে তিন-দশ-সাতের সঙ্গে দুই-দশ-দুই যুক্ত করতে বলে দেখুন, উত্তরটা আমেরিকানের চেয়ে ঢের দ্রুত পাবেন।
সুবিশাল কোনো ব্যাপার-স্যাপার হয়তো নয়। কিন্তু ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল বলছেন, সংখ্যার নামকরণের এই সামান্য সুবিধাটুকু নিয়েই গণিতের মৌলিক শিক্ষায় চীনা কিংবা এশীয় শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যায় প্রায় দুই বছর পরিমাণ।
ভগ্নাংশের স্বচ্ছতা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীতে উঠতে উঠতেই আমেরিকান শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই গণিত শিক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ কারেন ফুজোনের মতে, এই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবার নেপথ্য কারণটা ভগ্নাংশ।
বাংলায় আমরা যাকে বলি তিন-পঞ্চমাংশ, ইংরেজিতে তা-ই হয়ে যায় থ্রি-ফিফথ (three-fifth)। অথচ চীনারা একই জিনিস বুঝিয়ে ফেলে, ‘পাঁচটি খন্ড থেকে তিনটি নেবে’ বাক্যে। ফুজোনের চোখে,
“ভগ্নাংশ প্রকাশের এই পার্থক্য গণিতকে দেখার দৃষ্টিটা সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে। কেবলমাত্র ঠেসে মুখস্থ করবার বদলে ভগ্নাংশকে বোধগম্য বানিয়ে ফেলা যায় এই প্রকাশভঙ্গিতে।”
কারণ, এশিয়ানরা ধান উৎপাদন করে
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, ধান উৎপাদনের সঙ্গেও গণিতে দক্ষতার এক সম্পর্ক রয়েছে, এবং সম্পর্কটা বেশ গভীর। নৃবিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকা ব্রের মতে, ধান উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটাই দাবি করে চূড়ান্ত কৃষি দক্ষতার। জমিতে চাষ দিতে হয় সুনিপুণ হাতে, পানি দিতে হয় পর্যাপ্ত, আগাছা তুলতে হয় নিয়ম করে। ঐতিহাসিকভাবেই, অন্য যেকোনো কৃষকের চেয়ে ধানচাষীদের কায়িক শ্রমের পরিমাণটা খুব বেশি।
এশীয়রা, বিশেষ করে চীনারা যেহেতু ধান-প্রধান জাতি, শীতকালটা তাদের কেটে যায় ধানচাষের এই কাজগুলো করতে করতেই। ওই হাড়কাঁপানো শীতের ভেতরেও সূর্য উঠবার আগেই তাদের পৌঁছে যেতে হয় ক্ষেতে, পরিশ্রম করতে হয় ফসল ফলাতে। বছরে ধানচাষের পরে যে স্বল্প অবসর মেলে, সে সময়টাতেও বসে না থেকে নামে বিকল্প কোনো জীবিকার সন্ধানে। বিপরীতে, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বেশ লম্বা একটা সময় ইউরোপীয়রা কাটায় শীতনিদ্রায় গিয়ে, এ সময়টায় কাজ-কর্মের ধার বিশেষ একটা ধারে না তারা, অলসতার এই ধারাটা তারা বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
ভাবছেন, এখানে গণিতের কথা আসছে কেন? প্রতি চার বছর পর পর, গোটা পৃথিবীর প্রাথমিক এবং নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মান যাচাইয়ের লক্ষ্যে, ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ইভ্যালুয়েশন অব এডুকেশনাল অ্যাচিভমেন্ট’ বলে এক সংস্থার উদ্যোগে Trends in International Mathematics and Science Study (TIMSS) নামে একটি পরীক্ষা হয়ে আসছে বেশ কয়েকবছর ধরে। মূলত গণিত এবং বিজ্ঞানের ওপরে পরীক্ষাটি হলেও সেখানে পরীক্ষার্থীদের উত্তর করতে হয় বাড়তি কিছু প্রশ্নেরও। যেমন: তোমার বাবা-মার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, তোমার বন্ধুরা কী পছন্দ করে, গণিত নিয়ে তোমার ভাবনা কী ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মিলিয়ে সবশুদ্ধ প্রশ্ন থাকে ১২০টি। উত্তরপত্র মূল্যায়নকালে দেখা যায়, বেশ কিছু শিক্ষার্থী দশটি কিংবা বিশটি প্রশ্ন ফাঁকা রেখেই উত্তরপত্র জমা দিয়েছিল। গবেষণাসূত্রে জানা গিয়েছে, এশীয় দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এক ‘ফাঁকা রেখে যাওয়া’ দলে নেই। পরীক্ষার আয়োজকেরা আরও বলছেন, যারা এ ধরনের প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর করছে, দিনশেষে দেখা যাচ্ছে, গণিতের সমস্যাও তারাই সবচেয়ে ভালো সমাধান করেছে।
গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তার মতে, তারা কোনো গাণিতিক সমস্যা পরীক্ষার্থীদের সামনে পেশ না করেই প্রায় নির্ভুলভাবে অনুমান করে ফেলতে পারেন, কারা অলিম্পিয়াডে সবচেয়ে ভালো করবে। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, যেসব দেশ ঐতিহ্যগতভাবেই পরিশ্রমী এবং ফলের চেয়ে চেষ্টা করাতেই সবচেয়ে বেশি মন দেয়, দিনশেষে স্বর্ণপদক জয়ে তারাই বেশি এগিয়ে থাকে।
‘TIMMS’ পরীক্ষা এবং গণিত অলিম্পিয়াডের ফলাফল বিশ্লেষণ করেও পাওয়া যাচ্ছে তাদের দর্শনের সত্যতা। চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, তাইওয়ান, হংকং কিংবা দক্ষিণ কোরিয়া; ঘুরে-ফিরে তালিকার প্রথম সারিতে অবস্থান করছে এই দেশগুলোই।
এবং, এখানেই সামনে চলে আসে সেই ধান উৎপাদনের প্রসঙ্গটি। এই দেশগুলোর প্রতিটির অর্থনীতিতেই ধান উৎপাদন রাখছে বেশ বড় রকমের প্রভাব, পূর্ব-এশিয়ার এই দেশগুলোর প্রতিটিই বিশ্বাস করে এমনসব বাক্যে, ‘বছরের ৩৬০ দিন সূর্যোদয়ের পূর্বে না উঠলে তুমি তোমার পরিবারে সমৃদ্ধি আনতে পারবে না’। ধান উৎপাদনে দরকার পড়ে চূড়ান্ত একাগ্রতার, কর্মনিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রমের। গণিত অলিম্পিয়াডের সমস্যা সমাধানে কিংবা ‘TIMMS’ পরীক্ষার দীর্ঘ প্রশ্নবহরের উত্তর করতে গিয়েও দরকার পড়ছে সেই একই গুণাবলীর।
দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে খুব একটা কষ্ট বোধহয় হচ্ছে না।
এশিয়ার স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মকালীন ছুটির স্বল্পব্যপ্তি
বছরান্তে কিছু সময়ের জন্যে খালি ফেলে না রাখলে জমি হারায় তার স্বাভাবিক উর্বরাশক্তি, এই যুক্তিকে একটু বেশিই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে আমেরিকানরা তাদের বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়গুলোতেও চালু করেছিল সুদীর্ঘ গ্রীষ্মকালীন অবকাশের। কয়েকটি দেশের শিক্ষাবর্ষ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আমেরিকাতে শিক্ষাবর্ষের ব্যপ্তি কেবলমাত্র ১৮০ দিন, দক্ষিণ কোরিয়ায় যা বেড়ে যায় আরও ৪০ দিন, এবং জাপানের সঙ্গে আমেরিকার ফারাকটা ৬০ দিনের।
এই স্বল্পস্থায়ী শিক্ষাবর্ষের কারণে আমেরিকান শিক্ষকদের পাঠ্যক্রমটা শেষ করতে হয় বেশ ঝড়োগতিতে। শিক্ষার্থীরা পাঠ বুঝতে পেরেছে কী পারেনি তা ধর্তব্যে না নিয়ে তাদেরকে বেছে নিতে হয় ‘সিংক-অ্যান্ড-সুইম’ পদ্ধতি। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিভাজনটা হয়ে যায় স্পষ্ট। যে দ্রুত বুঝতে পারে, সাফল্যের গুড়টা জোটে তারই ভাগ্যে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গ্রীষ্মের ছুটিটা দীর্ঘ হবার কারণে আমেরিকার ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গরিব ঘরের এক সন্তানের পার্থক্য হয় ৫২.৪৭ পয়েন্টের। কেননা, বন্ধের ওই সময়টায় ধনীর দুলাল পড়াশোনার যে সুবিধাটা পায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তানের ভাগ্যে সেই সুবিধাটুকু জোটে না।
গবেষণার ফলাফল যে ত্রুটিপূর্ণ নয়, তা বোঝা যায়, আমেরিকার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়া কিপ স্কুলের কার্যক্রমেও। গ্রীষ্মকালীন ছুটির ব্যপ্তি কমিয়ে দিয়ে তারা জোর দিয়েছিল ধারাবাহিক মানোন্নয়নে। ফলাফলটাও মিলেছে হাতে-নাতে, কিপ স্কুলের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই এখন গণিতে কিংবা বিজ্ঞানে পাচ্ছে ৮৪-শতাংশের বেশি নম্বর। ফলতঃ বৃত্তি কিংবা উপবৃত্তি নিয়ে তাদেরও সুযোগ মিলছে নামীদামি সব উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়বার। এশীয় শিক্ষার্থীদের গণিতে এগিয়ে থাকবার কারণরূপে তাই চিহ্নিত করা চলে গ্রীষ্মকালীন ছুটির ব্যপ্তিস্বল্পতাকেও।
পার্থক্যগুলো উপলব্ধি করবার জন্যে রকেট সায়েন্টিস্ট হবার দরকার পড়ছে না, তেমন বৃহৎ কোনো বদলও নেই বাকি বিশ্বের সঙ্গে। তবুও এই সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম পরিবর্তনেই এশিয়ানরা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় রাখছে গণিতে তথা বিজ্ঞানে। ‘ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল; গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল;’ লাইন দুটো খুব সম্ভবত পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোকে উদ্দেশ্য করেই কবি লিখে গিয়েছিলেন।