আগের পর্বে রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো। যারা রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন নিয়ে জানতে আগ্রহী, তারা এই লিঙ্ক থেকে ঘুরে আসতে পারেন। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে।
তরবারি
তৎকালীন যুদ্ধরীতিতে তরবারি একেবারেই প্রাথমিক, সাধারণ, কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকরী একটি অস্ত্র ছিলো। সম্মুখ যুদ্ধের অন্যতম প্রধান অস্ত্র ছিলো এই তরবারি। মুঘল শাসনামলে হিন্দুস্তানের তরবারিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পূর্বে সোজা ধাতব ব্লেডযুক্ত তরবারির ব্যবহার বেশি হতো, যা তুলনামূলক একটু ভারী ছিলো। হিন্দুস্তানে মুঘলরা সোজা ধাতব ব্লেডের পরিবর্তে বাঁকা ব্লেডযুক্ত তরবারির ব্যাপক প্রচলন করেন, যা অধিক ধারালো আর বেশ তীক্ষ্ণ ছিলো।
এই ধরনের তরবারিগুলো খুব সহজেই শত্রুর বর্ম ভেদ করে ফেলতে পারতো। মুঘল শাসনামলে সেনাবাহিনীর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরবারির উন্নত ধাতব ফলক আমদানী করা হতো। ফলক বা ব্লেডগুলোর আবার বিভিন্ন নাম ছিলো, যেমন- শমশের, পাতা, খান্দা, সিরোহি, ধুপ ইত্যাদি।
সাধারণ অবস্থায় মুঘল সৈন্যরা তরবারি কোমর থেকে ঝোলানো একটি খাপে বহন করতেন, আর অশ্বারোহী বাহিনীর যোদ্ধারা যুদ্ধের সময় কাঁধ থেকে ঝোলানো বিশেষ এক ধরনের খাপে তরবারি ঝুলিয়ে রাখতেন।
ঢাল
তরবারিধারী যোদ্ধাদের তরবারির পর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও প্রিয় অস্ত্রটি হচ্ছে ঢাল। ঢাল মূলত ধাতব একটি পাত, যা যোদ্ধারা শত্রু পক্ষের যোদ্ধাদের তরবারির আঘাত থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করতেন। ঢাল সাধারণত বাম হাতে ব্যবহার করা হতো। অন্যান্য বাহিনীর সৈন্যদের মতোই মুঘল সৈন্যরাও যখন প্রয়োজন হতো না, তখন ঢাল কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতেন। মুঘল সেনাবাহিনীর ঢালগুলো সাধারণত ১৭-১৪ ইঞ্চি ব্যাসের হতো। ধাতব স্টিলের তৈরি এই ঢালগুলো ‘দামাস্কেনিং’ করা হতো, যা দ্বারা আসলে স্টিলের বা অন্য কোনো ধাতব পাতের উপরে স্বর্ণ বা রৌপ্যের কারুকাজ করাকে বোঝানো হয়।
ছোরা
তরবারি ছাড়াও মুঘল সেনাবাহিনীর যোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ন আরেকটি অস্ত্র ছিলো ছোরা বা খঞ্জর। তীক্ষ্ণ এবং দুদিকেই ধারালো এই ধরনের অস্ত্র যোদ্ধাদের সাথে বহন করার জন্য আলাদা খাপ সরবরাহ করা হতো। কোনো কারণে তরবারি হাতছাড়া হয়ে গেলে বা তরবারি ব্যবহার করা সম্ভব না হলে মুঘল সৈন্যরা ছোরা ব্যবহার করতেন। ‘কাটারা’ মুঘল সেনাবাহিনীর খুব জনপ্রিয় একটি ছোরা ছিলো। এছাড়া, জামাদার, খঞ্জর, পেশকাজ, কারুদ ইত্যাদি ছোরাগুলো মুঘল সেনাবাহিনীতে বহুল ব্যবহৃত হতো।
তীর-ধনুক
তৎকালীন যুদ্ধরীতির সবচেয়ে জনপ্রিয় অস্ত্র ছিলো এই তীর-ধনুক। ধনুকের সাহায্যে তীর নিক্ষেপ করে দূর থেকেই শত্রুদের উপরে আক্রমণ করা যেত। এতে নিজ বাহিনীর যোদ্ধাদের হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম থাকতো। তবে বিপক্ষ দলের সেনাবাহিনীও কিন্তু ছেড়ে কথা বলতো না! মধ্যযুগীয় যুদ্ধরীতিতে তাই পাল্টাপাল্টি তীর নিক্ষেপ চলতো। যুদ্ধের শুরুতেই সাধারণত তীর নিক্ষেপ করে শত্রুবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হতো। আর তীরন্দাজদের ছত্রছায়ায় অশ্বারোহী অথবা পদাতিক সৈন্যরা শত্রুপক্ষের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতেন। তৎকালীন যুদ্ধরীতিতে তাই তীরন্দাজদের সফলতার উপরে যুদ্ধের ফলাফল অনেকাংশেই নির্ভর করতো।
আর তাই যুদ্ধক্ষেত্রে মুঘল সেনাবাহিনীর সফলতা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীতে দুর্ধর্ষ একটি তীরন্দাজ ইউনিট ছিলো। ধনুক থেকে তীর ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করতে তারা অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন, আর তাদের সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। একজন মাস্কেটিয়ারের (ম্যাচলক বন্দুকবাহী সৈন্য) চেয়ে একজন মুঘল তীরন্দাজ প্রায় তিনগুণ দ্রুতবেগে তীর ছুড়তে পারতেন, যা তাদের মুঘল সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত করেছিলো।
কাঠ, বাঁশ বা হাতির দাঁতের তৈরি মুঘল সেনাবাহিনীর ধনুকগুলোর সাধারণ দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ১.২ মিটার। তবে ধাতব ধনুকের ব্যবহারও ছিলো। ধনুক থেকে ছোড়ার জন্য ‘তারকাশ’ নামের তূণে তীর পরিবহরণ করা হতো। তূণ সাধারণত মুঘল সৈন্যদের পিঠে ঝোলানো থাকতো। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে খুব দ্রুত পরাস্ত করার জন্য তীরের মাথায় বিষ মেশানো থাকতো।
রণকুঠার
সম্মুখ যুদ্ধে মুঘল যোদ্ধাদের আরেকটি জনপ্রিয় অস্ত্র হচ্ছে এই রণকুঠার। সম্মুখ যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করে খুব সহজের শত্রুকে ধরাশায়ী করা যেত। মুঘল সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন রকমের রণকুঠার ব্যবহার করা হতো, এদের বিভিন্ন নামও ছিলো; যেমন- সরু মাথাওয়ালা রণকুঠারের নাম ছিলো ‘জাগনল’, লম্বা হাতলওয়ালা রণকুঠারের নাম ছিলো ‘তারানগালাহ’। বেশিরভাগ রণকুঠারের মাথাই বাঁকা চাঁদের মতো আকৃতির ছিলো।
বল্লম বা বর্শা
মুঘল সেনাবাহিনীর আরেকটি জনপ্রিয় অস্ত্র ছিলো এই বল্লম বা বর্শা। লম্বা হাতলযুক্ত হওয়ায় এই অস্ত্রটি তরবারির তুলনায় কিছুটা দূর থেকে ব্যবহার করা যেত, আবার প্রয়োজনে দূরে নিক্ষেপ করাও যেত। পদাতিক সৈন্য থেকে শুরু করে অশ্বারোহীরাও বল্লম বা বর্শা ব্যবহার করতেন। মুঘল রাজদরবারে সম্রাটের দেহরক্ষীবাহিনীর সদস্যরা বল্লম ব্যবহার করতেন। নিযাহ, সাং, বারচাহ, সিলারাহ, আলম, পাঞ্জমুখ, গারহিয়া ইত্যাদি হচ্ছে মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত জনপ্রিয় কিছু বল্লমের নাম। এই ধরনের অস্ত্রগুলো মুঘল সেনাবাহিনী ছাড়াও মারাঠারা ব্যবহার করতো।
ম্যাচলক বন্দুক
‘ম্যাচলক’ মূলত একধরনের বন্দুক, যা দিয়ে বারুদ ব্যবহার করে গোল আকৃতির ধাতবপিন্ড বা গুলি ছোড়া যেত। মুঘল সেনাবাহিনীর ম্যাচলক বন্দুকধারী যোদ্ধাদের ‘মাস্কেটিয়ার’ বলা হতো। প্রথমদিকের ম্যাচলক বন্দুকগুলোতে বেশ কিছু সমস্যা ছিলো। এগুলো দিয়ে খুব দ্রুত গুলি ছোড়া যেত না, আবার এদের গোলাগুলির সীমাও খুব কম ছিলো। তাছাড়া নতুন অস্ত্র হওয়ায় মুঘল সৈন্যরাও এতে খুব একটা অভ্যস্ত ছিলেন না। সম্রাট বাবর যখন হিন্দুস্তান আক্রমণ করেন, তখন মুঘল সৈন্যরা এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। সর্বপ্রথম ম্যাচলক বন্দুকের ব্যাপক সংস্কার করেন সম্রাট আকবর। ৬৬ ইঞ্চি আর ৪১ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ব্যরেলযুক্ত দুটি ম্যাচলকবন্দুক তিনি ডিজাইন করেছিলেন। মুঘল সেনাবাহিনীর ম্যাচলক বন্দুকের ব্যরেলের গায়ে ‘দামাস্কেনিং’ পদ্ধতিতে স্বর্ণ আর রৌপ্যের বিভিন্ন কারুকাজ করা থাকতো। সমসাময়িক সময়েই হিন্দুস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে ফ্লিন্ট-লক বন্দুকের প্রচল ঘটে।
ম্যাচলক বন্দুকগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিলো, এগুলো দিয়ে কয়েকটি গুলি ছোড়ার পরই ধাতব ব্যারেলগুলো উত্তপ্ত হয়ে যেতো, ফলে আর গুলি নিক্ষেপ করা যেত না। এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছিলো সেনাবাহিনীতে অধিক সংখ্যক মাস্কেটিয়ার নিয়োগ করার মাধ্যমে।
মুঘল সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন রকমের ম্যাচলক বন্দুক ব্যবহৃত হতো। এদের মাঝে ‘ক্যাটিলগ’ আর ‘যাজাইর’ খুব জনপ্রিয় ছিলো। ‘ক্যাটিলগ’ আর ‘যাজাইর’ বন্দুকের ব্যরেলগুলো খুব লম্বা হতো। ‘জিনজাল’ নামের আরেক ধরনের ম্যাচলক বন্দুক দুর্গ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হতো। এই বন্দুকগুলোর গুলির ভর ২৮ গ্রাম থেকে ৮৫ গ্রাম পর্যন্ত হতো। জিনজাল ম্যাচলক বন্দুকগুলোর ব্যারেল খুব উন্নত ধাতুর তৈরি হতো, ফলে সহজেই ফেটে বিস্ফোরিত হতো না। এছাড়া এই বন্দুক থেকে একটানা গুলিবর্ষণ করা যেতো।
পিস্তল
মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত পিস্তলগুলো ‘তামানচাহ’ নামে পরিচিত ছিলো। মূলত এগুলোও একধরনের ‘ম্যাচলক’ বন্দুকই, তবে এদের ব্যারেলগুলো খুব ছোট, আর সহজে ব্যবহারযোগ্য ছিলো। মুঘল সেনাবাহিনীর অফিসার আর অভিজাতরা এই ধরনের পিস্তল ব্যবহার করতেন। তবে সৈন্যরাও পিস্তল ব্যবহার করতেন। মুঘল সেনাবাহিনীর এই পিস্তল বা হ্যন্ডগানগুলো তৎকালীন ইউরোপীয় হ্যান্ডগানগুলো থেকেও অনেক উন্নত ছিলো। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে এদের ব্যবহার খুব কম হতো।
কামান
হিন্দুস্তানের মুঘলদের আগমনের পর যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের ব্যবহার এক ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে। হিন্দুস্তান অধিকারের সময় মুঘল সম্রাট বাবর হিন্দুস্তানে সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করেন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সম্রাট বাবরের কামানের গর্জন শুনেই হাতিগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, যা মুঘল সেনাবাহিনীকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিলো। তবে কিছু সূত্রে সম্রাট বাবরের পূর্বেও হিন্দুস্তানে কামানের ব্যবহারের কথা শোনা যায়।
হিন্দুস্তানের প্রচলিত যুদ্ধরীতিতে যুদ্ধহাতিগুলো বিপক্ষ দলের সৈন্যদের জন্য খুবই অসুবিধা তৈরি করতো। এই হাতিগুলোর জন্য বিপক্ষ দলের সৈন্যরা সামনে অগ্রসর হতে পারতো না, আর বিশালাকার হাতিগুলো দেখলে ভয়ে ঘোড়াও সামনে অগ্রসর হতে চাইতো না। হিন্দুস্তান অভিযানে মুঘল সেনাবাহিনীও একই রকম সমস্যায় পড়তো, যদি না মুঘল সেনাবাহিনীতে কামান থাকতো। তবে তখনকার কামানগুলোর ধ্বংসক্ষমতা খুব বেশি ছিলো না, কিন্তু কামানগুলো গোলা নিক্ষেপের সময় বিকট শব্দ তৈরি করতো। আর এই শব্দেই হস্তিবাহিনী ঘাবড়ে যেতো। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে হাতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যেতো। এছাড়া, কামানের গোলাবর্ষণের কারণে শত্রুপক্ষ হঠাৎ করেই আক্রমণ চালাতে পারতো না। এই সুযোগে অশ্বারোহীরা শত্রুদের উপর বিনা বাঁধায় ঝাপিয়ে পড়তে পারতো।
মুঘল সেনাবাহিনীর কামানগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর অস্ত্র হলেও এগুলো ব্যবহার করা বেশ অসুবিধাজনক ছিলো। প্রথমে এদের ভরের কথাই ধরা যাক। ভারী কামানগুলোর একেকটি গোলার ভরই হতো ২০০-২৫০ কেজির! আর তাই যুদ্ধক্ষেত্রে কামান খুব সহজে মোতায়েন করা যেত না। আর যদি কামান মোতায়েন করা হতোও, তাহলে এদের পরিবহণ করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যপার ছিলো। আর তাই দ্রুতগতির যুদ্ধে মুঘল সেনাবাহিনীকে কামান ছাড়াই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হতো। তাছাড়া, বর্ষার সময় কামান পরিবহণ করা একপ্রকারের দুঃস্বপ্নে পরিণত হতো। আর উঁচু পাহাড়ের উপরে অবস্থিত দুর্গ আক্রমণে তো কামান ব্যবহার করাই যেতো না। মুঘল সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা এসব ক্ষেত্রে মর্টার আর মাইন ব্যবহার করতেন। তবে সম্রাট আকবরের সময় ছোট ছোট কিছু কামান উদ্ভাবন করা হয়, যেগুলো খুব সহজেই পরিবহণ করা যেতো। এমনকি এসব কামান অনায়াসেই পাহাড়ের উপরে মোতায়েন করা যেতো!
মুঘল সেনাবাহিনীতে প্রধানত লোহা আর তামার তৈরি কামান ব্যবহার করা হতো। তামার কামানগুলো উৎপাদন করা হতো আগ্রার দুর্গে, আর লোহার কামানগুলো জয়গড়ের দুর্গে তৈরি করা হতো। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে জয়গড় দুর্গের কামান কারখানাটি পৃথিবীর বৃহত্তম কামান উৎপাদন কারখানা ছিলো! আর সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কামান উৎপাদনের ক্ষেত্রে মুঘল সেনাবাহিনী ভিন্ন এক মাত্রা অর্জন করে।
মুঘল সেনাবাহিনীর সবচেয়ে উন্নত কামান ছিলো জাফরবক্স। এ ধরনের কামান উৎপাদনে দুর্লভ ধাতব মিশ্রণের প্রয়োজন হতো। মুঘল সেনাবাহিনীর ‘জয়ভান’ কামানটি ছিলো তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চাকাযুক্ত কামান। এই কামানটি দিয়ে প্রায় ১০০ কেজি ভরের একেকটি গোলা প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে নিক্ষেপ করা যেতো! এ ধরনের একটি কামান টেনে নিতে প্রয়োজন পড়তো প্রায় সাতশ ষাঁড়ের!
কামানের গোলা সংরক্ষণের জন্য আলাদা সংরক্ষাণাগার ছিলো। এগুলোকে বলা হতো ‘তোপখানা’। আগ্রা, দিল্লি আর লাহোরে মুঘল সেনাবাহিনীর কামান আর কামানের গোলাগুলো মজুদ করে রাখা হতো। যেসব সৈন্যরা কামানগুলোকে পরিচালিত করতেন তাদের ‘গোলন্দাজ’ বলা হতো।
জাম্বুরাক
মুঘল সেনাবাহিনীর উটগুলোর উপরে এক ধরনের হালকা কামান বসিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা হতো। এই কামানগুলোকে জাম্বুরাক বলা হতো, আর কামানবাহী মুঘল উটবাহিনীকে জাম্বুরাক বাহিনী হলা হতো। জাম্বুরাক বাহিনীর কামানগুলো আকারে কিছুটা ছোট ছিলো, কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো। জাম্বুরাক কামানগুলোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এগুলোকে ডানে-বায়ে খুব সহজেই ঘোরানো যেতো, ফলে শত্রুর উপর নিখুঁতভাবে গোলাবর্ষণ করা যেতো। জাম্বুরাক থেকে যেসব সৈন্যরা গোলাবর্ষণ করতেন তাদের ‘জাম্বুরাকচি’ বলা হতো। মুঘল সেনাবাহিনী ছাড়াও এই জাম্বুরাক কামান অটোমান সেনাবাহিনী আর ইরানের সাফাভী সেনাবাহিনী ব্যবহার করতো।
এসব যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াও রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী রকেট, মর্টার, ক্যাটাপুল্টসহ (ভারী পাথর নিক্ষেপক এক ধরনের যন্ত্র) প্রচলিত অন্যান্য সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্রই ব্যবহার করত। তবে এসব অস্ত্র যে শুধুমাত্র মুঘল সেনাবাহিনীই ব্যবহার করতো তা নয়, বরং তৎকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সব সেনাবাহিনীই কমবেশি এসব অস্ত্র ব্যবহার করতো। আর আধুনিক যুগে এসব অস্ত্র ‘সেকেলে’ হলেও তখন এসব অস্ত্রই ছিলো সেই যুগের ‘আধুনিক অস্ত্র’!
রাজনৈতিকভাবে বহু দ্বিধাবিভক্ত আর অনৈক্যের দেশ হিন্দুস্তান শাসন করতে চাইলে তরবারিতে জোড় থাকা আবশ্যক ছিলো। যোদ্ধা জাতি মুঘলদের তরবারিতে এই জোর বেশ ভালোই ছিলো। তবে মুঘলরা অকারণে রক্তপাত পছন্দ করতেন না। আসলে কোনো শাসকই সহজে যুদ্ধে জড়াতে চান না। একেকটি যুদ্ধ মানে সাম্রাজ্যের অর্থনীতির ভীত নড়ে ওঠা, অযথা ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞে সাম্রাজ্যের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি, হাজার হাজার প্রশিক্ষিত বীর যোদ্ধাদের নির্মম মৃত্যু, হাজার হাজার বিধবা আর তারও অনেকগুণ অনাথ শিশুর জন্ম দেয়া। কোন শাসক জেনে-বুঝে এত ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে চাইবেন? তবে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিকভাবে যখন কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না, তখন যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। হিন্দুস্তানের মুঘল সাম্রাজ্যও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। বিশাল হিন্দুস্তানকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসা কিংবা হিন্দুস্তানের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মুঘল সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা সবসময় প্রস্তুত থাকতেন।
তথ্যসূত্র
১। বাবরনামা (মূল: জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর, অনূবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)
২। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায় (সাহাদত হোসেন খান)
এই সিরিজের আগের পর্ব
১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা
২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ
৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল
৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক
৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল
৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল
৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন
৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য
৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস
ফিচার ইমেজ: vintagehandmadeleatherbags.com