বাঁদর, সে তো বাঁদরামি করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বাঁদর কি কখনো জ্ঞানী হতে পারে? না, আসলে জ্ঞানী না হলেও ‘তিন জ্ঞানী বানর’ নামে প্রচলিত এই বানরগুলোর সাথে হয়তো আমরা অনেকেই পরিচিত। আমাদের প্রত্যেকের স্মার্টফোনেই কিন্তু এই তিন বানরের ছবি আছে! কি অবাক হলেন? না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই তিন জ্ঞানী বানর এতটাই জনপ্রিয় যে এদের নিয়ে স্মার্টফোনে ইমোজিও রয়েছে।
এদের নিয়ে রয়েছে বহু চিত্রকর্ম, বহু স্থাপনা, বহু ভাস্কর্য। কিন্তু এই তিন বানর আসলে কারা? কী বোঝাচ্ছে এই তিন বানর? কেনই বা এরা এত জনপ্রিয়? চলুন আজকে জেনে নিই এই তিন জ্ঞানী বানরের সম্পর্কে।
দ্য থ্রি ওয়াইজ মাংকিজ
‘দ্য থ্রি ওয়াইজ মাংকিজ’ বা তিন জ্ঞানী বানর নামে পরিচিত এই তিনটি বানর আসলে একটি প্রবচনের সচিত্র রূপ। প্রবচনটি হলো, “See no evil, hear no evil, speak no evil”। অর্থাৎ, “খারাপ কিছু দেখো না, খারাপ কিছু শুনো না, খারাপ কিছু বলো না”। এই তিন বানরের রয়েছে তিনটি ভিন্ন নাম। যে বানরটি তার হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে তার নাম ‘মিজারু’, যে বানরটি কান চেপে রেখেছে তার নাম ‘কিকাজারু’ আর শেষেরটি যে কিনা তার মুখ চেপে রেখেছে তার নাম ‘আইওয়াজারু’। এই তিনটি বানর উপরের প্রবচনটির সচিত্র রূপ প্রকাশ করছে। অর্থাৎ মিজারু চোখ ঢেকে রেখে কোনো খারাপ জিনিস দেখছে না, কিকাজারু কান চেপে রেখে খারাপ কিছু শুনছে না আর শেষের জন আইওয়াজারু মুখ চেপে রেখে খারাপ কোনো কথা বলছে না। জাপানের বাইরে এই তিন বানরকে কোনো কোনো স্থানে মিজারু, মিকাজারু ও মাজারু নামেও ডাকা হয়।
এই তিন বানরের বহু মূর্তি পৃথিবী জুড়ে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মানুষ ভাস্কর্য হিসেবে ঘরের মধ্যেও এই তিন জ্ঞানী বানরের মূর্তি রেখে থাকেন। তবে শুধু ভাস্কর্য হিসেবেই নয়, এই তিন বানরের মধ্যে রয়েছে আরো গভীর এক জীবন দর্শন। সেটি জানার আগে চলুন জেনে নিই এই তিন বানরের উৎপত্তি সম্পর্কে।
কিভাবে এলো এই তিন বানর
এই তিন প্রতীকী বানরের উৎপত্তি সর্বপ্রথম কোথায় হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে সপ্তম শতাব্দীতে বানরের এই প্রতীকী রূপকে বৌদ্ধধর্মে যুক্ত করেন এক সন্ন্যাসী। নাম তার জুয়ানজ্যাং। তিনি ছিলেন চীনা ভাষায় বৌদ্ধধর্মীয় গ্রন্থগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদক। প্রচলিত উপকথা অনুসারে, এই সন্ন্যাসী যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন তখন তার সাথে সঙ্গী হিসেবে একটি বানর থাকতো।
তবে তিনি আসলে এই তিন বানরের আবিষ্কারক নন, বরং তিনি সর্বপ্রথম এই বানরদেরকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই তিন বানরের উল্লেখ সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া যায় কনফুসিয়াসের রচনাবলীতে।এছাড়াও অনেকের মতে, জাপানের কোশিন মতবাদ থেকে এদের উৎপত্তি। কোশিন মতবাদ অনুসারে, মানব দেহে তিনটি পোকা বা কীট বাস করে, যারা ‘সানসি’ নামে পরিচিত। এই কীটগুলো মানুষের সকল ভালো ও খারাপ কাজের হিসাব রাখে। প্রতি ৬০ দিন অন্তর অন্তর এরা মানব শরীর ত্যাগ করে এবং ‘টিন-টেই’ নামক দেবতার কাছে মানুষের এই ভালো-খারাপ কাজের হিসাব পৌঁছে দেয়। কোশিন মতবাদ অনুসারে, এই তিন বানর ‘সানসি’ ও ‘টিন-টেই’কে মানুষের খারাপ কাজ দেখতে, শুনতে ও বলতে বাধা দেয়।
এছাড়া এই তিন বানরের সচিত্র রূপ সর্বপ্রথম দেখা যায় জাপানের নিক্কোতে অবস্থিত বিখ্যাত ‘তোসুগু’ মঠে। এই মঠের প্রবেশ পথের ঠিক উপরে রয়েছে এই তিন বানরের মূর্তি। এগুলো নির্মাণ করেন হিদারি জিংগোরো নামের এক ভাস্কর।
গবেষকদের মতে, এই তিন বানরের ধারণাটি অষ্টম শতাব্দীতে ‘টেণ্ডাই বৌদ্ধধর্মীয় দর্শন’ হিসেবে চীন থেকে জাপানে প্রবেশ করে। এই বিশ্বাস অনুসারে, এই তিন বানর টেণ্ডাই দর্শনের তিনটি মতবাদকে প্রকাশ করে। এই মঠে মোট ৮টি প্যানেল রয়েছে। তিন বানর এই ৮টি প্যানেলের একটি অংশ। মঠের এই ৮টি প্যানেল কনফুসিয়াসের ‘আচারণের নিয়মাবলী’কে উপস্থাপন করে। কনফুসিয়াসের রচনাবলীর একটি অংশে রয়েছে,
“সঙ্গতির বিপরীতে কোনো কিছু দেখো না, সঙ্গতির বিপরীতে কোনো কিছু শুনো না, সঙ্গতির বিপরীতে কোনো কিছু বলো না এবং সঙ্গতির বিপরীতে যায় এমন কোনো কিছু করো না”
ধারণা করা হয়, এটাই প্রবচনটির মূল রূপ, যা জাপানে প্রবেশ করে সংক্ষেপিত হয়ে গিয়েছে। মঠের প্যানেলের এই বানরগুলো ম্যাকাও প্রজাতির বানর যা জাপানের একটি বিখ্যাত বাঁদর প্রজাতি। বানরগুলোর নামের উৎপত্তি হিসেবে ধারণা করা হয় মূলত মজা করেই বানরগুলোর এমন নাম রাখা হয়েছিল। বানর তিনটির প্রত্যেকের নামের শেষেই ‘জারু’ শব্দটি রয়েছে যা জাপানী শব্দ ‘সারু’ এর বিবর্তিত রূপ। জাপানী ভাষায় ‘সারু’ বানরকে নির্দেশ করে। এছাড়াও ‘সারুর’ আরেকটি অর্থ হলো ‘দূর হও’, যা খারাপ কিছুকে উদ্দেশ্য করে বোঝানো হচ্ছে। একত্রিতভাবে এই তিন বানরকে জাপানী ভাষায় ‘সামবিকি-সারু’ নামে ডাকা হয়, যার অর্থ ‘তিন রহস্যময় বানর’। কোথাও কোথাও এই তিন বানরের পাশে চতুর্থ আরেকটি বানরকেও দেখা যায়। যার নাম ‘শিজারু’। যে কিনা তার হাত দিয়ে পেট কিংবা নিম্নাঙ্গ ঢেকে রাখে। এই বানরটি “খারাপ কিছু করো না” এই ধারণাটিকে উপস্থাপন করে। তবে গবেষকদের মতে বিভিন্ন স্মারক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পরবর্তীতে এই চতুর্থ বানরটিকে যোগ করেছেন।
বানর তিনটির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক কিছু তো জানা হলো। এবার চলুন জেনে নিই এই বানর তিনটি কোন গভীর জীবন দর্শনকে প্রকাশ করে।
কী বোঝাতে চায় এই তিন জ্ঞানী বানর?
তিন জ্ঞানী বানরের এই প্রতীকী রূপ মূলত শিনতো ও কোশিন ধর্মানুসারে মানব জীবন দর্শনকে প্রকাশ করে। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় ৫০০ বছর পুরনো এই প্রতীকটি সহজ তিনটি নির্দেশনা দিচ্ছে। আর তা হলো, খারাপ কিছু দেখো না, শুনো না এবং বলো না। কিন্তু কেন? কেন নিষেধ করা হচ্ছে?
আমাদের বাস্তব জীবনেই এর উত্তর রয়েছে। আপনি কি কখনো কোনো পচা খাবার খেয়েছেন? আমরা যখন কোনো পচা বা নষ্ট খাবার খাই আমাদের শরীর প্রথমে এটিকে হজম করে। ফলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। এই অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে এই পচা খাবার যত দ্রুত সম্ভব আমাদের শরীর যে কোনো উপায়ে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে।
এই দর্শন অনুসারে, খারাপ কোনো কিছু ঠিক পচা খাবারের মতো কাজ করে। যখন আমরা কোনো খারাপ জিনিস দেখি তখন তার কিছু অংশ আমাদের নিজেদের মধ্যে প্রবেশ করে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের উপর পড়ে এবং কোনো না কোনোভাবে আমরা এই খারাপ নেতিবাচক প্রভাবের একটি নেতিবাচক বহিঃপ্রকাশ ঘটাই।
এই দর্শনের বাস্তব রূপ কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে মানুষ টিভিতে কিংবা মুভিতে যেসব অপরাধ, খুন, হত্যা, রাহাজানি প্রভৃতি দেখছি তা বাস্তবেই মানুষকে এসব অপরাধ করতে অনুপ্রাণিত করছে। শিশু-কিশোরেরা মারামারি, যুদ্ধ, নিষ্ঠুরতাযুক্ত ভিডিও গেম খেলে বিভিন্ন অপরাধ ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। ঠিক এ কারণেই তিন জ্ঞানী বানরের প্রথম বানরটি খারাপ কিছু দেখতে নিষেধ করছে। পরের বানরটি খারাপ কিছু শুনতে মানা করছে যার কারণ প্রথম কারণটির অনুরূপ। আর সর্বশেষ বানরটি আসলে প্রথম দুটি কাজের ফলাফল নির্দেশ করছে। অর্থাৎ আপনি যখন খারাপ কিছু দেখবেন না, খারাপ কিছু শুনবেন না তখন স্বাভাবিক ভাবে তার ফল হিসেবে আপনি খারাপ কিছু বলবেন না। অর্থাৎ আপনি শুদ্ধ থাকতে পারবেন।
এভাবেই তিন জ্ঞানী বানর আমাদেরকে সকল খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার উপায় বাতলে দিচ্ছে। তাই আজ থেকে এই তিন বানরকে শুধু ফোনের মজার ইমোজি হিসেবে ম্যাসেজিংয়ে ব্যবহার না করে সেই সাথে এই তিন বানরের শিক্ষাকে আপনার জীবনে কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। তাহলে হয়তো আপনিও পারবেন সকল খারাপ কাজ থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও দূরে রাখতে।
ফিচার ইমেজ – taopic.com