আসুন, দক্ষিণ আমেরিকার দিকে নজর ফেরানো যাক। এ হচ্ছে সেই দক্ষিণ আমেরিকা, যেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে হরেক রকমের মানুষ এসে স্থানীয়দের সাথে কখনো মেশে আবার কখনো লড়াই করে সৃষ্টি করেছে ছোট্ট এক আলাদা পৃথিবী। সাদা, কালো, বাদামী; হরেক রঙের এর মানুষের এই পৃথিবীর ইতিহাস কিন্তু রক্তে মাখা, দুঃখ, বঞ্চনা আর গ্লানিতে পরিপূর্ণ।
দক্ষিণ আমেরিকার ম্যাপটা নিয়ে বসা যাক। গোটা মহাদেশটা অনেকটা আইসক্রিমের কোনের মত। পশ্চিম দিকটা বেড় দিয়ে রেখেছে সুবিপুল আন্দিজ পর্বতমালা। আর আন্দিজের পাদদেশ থেকে মধ্য আর উত্তর অংশটা জুড়ে আছে কষাড় ঘন আমাজন বন।
বিপুল এই বন, বিরাট তার রহস্যভান্ডার। বহু অংশে আজ পর্যন্ত কোনো সভ্য মানুষের পা পড়েনি। স্থানীয় ভাষায় ‘সবুজ নরক’ বলে পরিচিত এই আমাজন বনের দিকে এবার ভাল করে তাকান। ব্রাজিল অংশে চোখে পড়বে বেলেম, মানাউস, রোডনডোনিয়ার মতো শহর। পেরুর অংশে পড়ছে ইকুইতোস। এই শহরগুলোর কোনটাই আকারে ছোট নয়। প্রত্যেকের জনসংখ্য অন্তত ৪ লক্ষের ওপরে।
এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে গহীন বনে এমন ঝকঝকে শহর মাথা উচুঁ করে দাড়ালো? বনের মধ্যে দু’চারটে ব্যবসাপাতি করবার জন্য ছোটখাট বন্দর বা মফস্বল গোছের শহর থাকতেই পারে। কিন্তু এমন প্রকান্ড শহর গড়ে উঠতে হলে তো চাই বিশাল ব্যবসায়িক কর্মকান্ড। তা, এই শহরগুলো আসলে বেণিয়াদেরই শহর। উনিশ শতকের বিখ্যাত রাবার বুমের বদৌলতে এই শহরগুলো আজ পেয়েছে এমন আধুনিক, উন্নত অবকাঠামো।
কী ছিল এই রাবার বুম? কিভাবে এর জাদুর ছোয়াতে বদলে গেল বুনো বসতি, গড়ে উঠলো এমন শান শওকতদার সব শহর? আজ সেসব নিয়েই আলাপ হবে।
আমাজনের রাবার বুম বলতে বোঝানো হয় দুটি নির্দিষ্ট সময়কালকে। একটি হচ্ছে ১৮৭৯ থেকে ১৯১২ আর অপরটি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫। যদিও আমাজনে রাবারের খোঁজ সেই সতের শতাব্দীর দিকেই পাওয়া গিয়েছিলো, বিশ্বজুড়ে সেসময় ঐ বস্তুর বিশেষ দামছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে লাগলো খুব দ্রুত।
প্রথম রাবার বুম (১৮৭৯-১৯১২)
ইউরোপে চলছে শিল্প বিপ্লব। দেদারসে কলকারখানা গড়ে উঠছে। এসব কলকারখানার মেশিনপাতিতে রাবার খুবই দরকারি। ওদিকে আমাজন অববাহিকার বিশাল বনে রয়েছে অসংখ্য রাবার গাছ। সমীকরণ মিলে গেল দ্রুত। দলে দলে রাবার ব্যবসায়ী এসে ভীড় জমালেন সেই আদিম জঙ্গলে। এক ১৮৭৯ সালেই প্রায় ১০ হাজার টন রাবার রপ্তানি হয় এই অঞ্চল থেকে। গড়ে ওঠে বড় বড় শহর। এই যেমন মানাউসের কথাই ধরা যাক। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও এর পরেই মানাউস বৈদ্যুতিক সুবিধাপ্রাপ্ত শহর হিসেবে গড়ে ওঠে।
সীমান্তে দ্বন্দ্ব
জঙ্গল সাফ করে রাবার গাছ লাগানো হলে তাতে ফল আসতে আসতে বহুত দেরি হবে। তাছাড়া আমাজন জঙ্গলে রাবার গাছের কোনো কমতি ছিল না। কর্মীরা এই বন্য গাছ থেকেই রাবার সংগ্রহ করতেন। তা রাবার সংগ্রহ করতে করতে একসময় ব্রাজিলীয়রা বলিভিয়া সীমান্তে ঢুকে পড়লে দুই দেশের মধ্যে শুরু হল টানাপোড়েন। শেষমেষ বিপুল অর্থের বিনিময়ে বলিভিয়ার একটি অংশ কিনে নিলো ব্রাজিলের সরকার। বর্তমানের ব্রাজিলীয় প্রদেশ ‘আক্রি’ হচ্ছে সেই কিনে নেওয়া ভূখন্ড।
বিলাস এবং অত্যাচার
ব্রাজিলের মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ তখন এসব রাবার পণ্য থেকে আসতো। ফলে দেদারসে টাকা কামাতে লাগলেন আমাজনের ‘রাবার ব্যারন’রা। বিশেষ করে মানাউস আর বেলেমের চাকচিক্য তখন যেকোনো ইউরোপীয় শহরের মত হয়ে উঠেছে। গহীন জঙ্গলের মধ্যে লক্ষ লক্ষ লোক, বিদ্যুৎ সুবিধা, ট্রাম, চওড়া সব রাস্তাঘাট এবং সুবিপুল প্রাসাদ, অট্টালিকায় ঠাসা শহরগুলো ব্রাজিল কেন, গোটা দক্ষিণ আমেরিকারই সেরা শহর হয়ে উঠেছিলো। এসব অঞ্চলের লোকেরা এমনকি ব্রাজিলীয় মুদ্রা রিয়ালের ব্যবহারও ছেড়ে দিয়ে ব্রিটিশ পাউন্ড এর মাধ্যমে ব্যবসা করতো। মানাউস অঞ্চলের লোকেরা ব্রাজিলের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে দ্বিগুণ আয় করতো।
সমাজের একটা অংশের অপরিমিত বিলাসের পেছনে থাকে নিপীড়ন আর শোষণ। ব্রাজিল এর ব্যতিক্রম ছিল না। রাবার ব্যবসাটা মূলত পেরু আর ব্রাজিলের ধনকুবেরদের হাতে ছিল। এখন গহীন বনে রাবার গাছ খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। জীবজন্তুর আক্রমণ, সাপ আর পোকামাকড়ের বিষাক্ত কামড় এবং স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া আর প্রাণান্তকর পরিশ্রম, নানা রোগজীবাণুর আক্রমণে বহিরাগত লোকের নাভিশ্বাস উঠে যেত এই জঙ্গলে। কাজেই রাবার ব্যারনেরা কাজে নামালেন এই অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদেরকে।
জঙ্গলের সন্তান রেড ইন্ডিয়ানরা অত টাকা-পয়সার লেনদেন বুঝতো না, সামান্য অর্থের বিনিময়েই তাদেরকে কাজে নামানো যেত। তা বলে তাদের সাথে যে খুব মধুর ব্যবহার করা হত তা নয়। গহীন বনের ভেতরে আইন শৃংখলার কোনো বালাই ছিল না। পালে পালে রেড ইন্ডিয়ানদের জোর করে না খাইয়ে কাজে নামানো হত। অসুখ আর অত্যাচারে মরতো তারা দলে দলে। ততোদিনে অনেক স্থানে বন সাফ করে বাণিজ্যিকভাবে রাবার গাছ লাগানো হয়েছে। এসব খামারে কাজ করতে গিয়ে প্রচুর মানুষ মারা যেত। এমনও হয়েছে যে কোনো খামারের পঞ্চাশ হাজার কর্মীর মধ্যে বেয়াল্লিশ হাজার লোক স্রেফ খাটতে খাটতেই মারা গিয়েছে। অত্যাচারে তিষ্ঠোতে না পেরে রেড ইন্ডিয়ান গোত্রগুলো প্রধান নদীর ধারে কাছে থাকতো না। গহীন জঙ্গলে পালিয়ে যেত। তাতেও শেষরক্ষা হত না সবসময়। কোনো কোনো অঞ্চলের আদিবাসী জনসংখ্যার ৯০ ভাগই এসব রাবার ব্যারনদের অত্যাচারে শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
আমাজনের রাবার ব্যারনদের কথা উঠলে কার্লোস ফিটজক্যারাল্ডের গল্প না বলাটা রীতিমত অন্যায়। আইরিশ বাবা আর পেরুভিয়ান মা এর এই ‘সুপুত্র’টির জন্ম পেরুর আমাজনের পাড়ের এক শহর, ইকুইতোস এ। ভয়ানক লোভী আর দৃঢ়প্রত্যয়ী এই মানুষটি নদী দিয়ে যেতে যেতে আবিষ্কার করলেন, বিরাট এক পাহাড়ের ওপারে, আরেকটা নদীর তীরে আছে বিপুল পরিমাণ রাবার গাছ। কী করে সেগুলো আহরণ করা যায় এই নিয়ে ভেবে ভেবে শেষমেষ তিনি এক উপায় ঠাওরালেন। ৩০ টন ওজনের জাহাজটাকে কেটে টুকরা টুকরা করে সঙ্গের রেড ইন্ডিয়ানদের দিয়ে পাহাড় পার করিয়ে ওপারে নামালেন। এই দুঃসাহসী কাজের সুফল অবশ্য তিনি পাননি। কিছুদিনের মধ্যেই জাহাজডুবিতে আমাজনেই তার মৃত্যু হয়, সালটা তখন ১৮৯৭।
শুধু ফিটজক্যারাল্ড নয়, আমাজনে পা রেখেছিলেন ফোর্ড কোম্পানির বিখ্যাত প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ড। ১৯২৮ সালে তিনি বিরাট একটি অঞ্চল কিনে নেন, উদ্দেশ্য এখানে রাবার চাষ করা। ফোর্ড তখন দেদারসে গাড়ি বানাচ্ছে, টায়ারের জন্য রাবারের চাহিদাও তুঙ্গে। তা হেনরী ফোর্ডের এই বিশাল প্রকল্প অবশ্য সফল হয়নি। অস্বাস্থ্যকর অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার কল্যাণে শহরের লোকজন মরে সাফ হয়ে গেলে পরে তিনি ব্রাজিল থেকে পাততাড়ি গুটান। ফোর্ডল্যান্ডিয়া নামের এই শহর আজকেও টিকে আছে অবশ্য। হাজার তিনেকের মত মানুষের বাস সেখানে।
রাবার ব্যবসার পতন
দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটা গরিব দেশ এমন রমরমা ব্যবসা করে চলবে এটা ব্রিটিশ রাজের পছন্দ হবে না বলাই বাহুল্য। কাজেই ব্রাজিল থেকে পাচার করে আনা কিছু রাবার গাছ মালয়েশিয়াতে লাগানো হল (সে আমলে মালয়েশিয়া ব্রিটিশদের কলোনি ছিল)। মালয়েশিয়ার মাটিতে ভালোই ফলন পাওয়া গেলে পরে ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠলো বিরাট বিরাট সব রাবার প্ল্যান্টেশন। দক্ষিণ আমেরিকার তুলনায় ব্রিটেনের ব্যবস্থাপনা উন্নত ছিল। কাজেই কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববাজারে ব্রাজিলের রাবারের চাহিদা একদম কমে গেল। ব্রাজিলের বিরাট বিরাট শহরগুলো ছেড়ে মানুষ চলে গেল অন্যত্র। রাবার ব্যারনেরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেন অন্য ব্যবসার সন্ধানে। জঙ্গলে নেমে এলো অন্ধকার।
দ্বিতীয় রাবার বুম (১৯৪২-৪৫)
রাবার ব্যবসাটা ব্রিটিশদের হাতেই থাকতো যদি না দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাধতো। জাপান এসে মালয় অঞ্চল দখল করে নিলে ব্রিটিশদের রাবার যোগান দেওয়ার কেউ থাকলো না। সবাই তখন আবার নজর ফেরালো ব্রাজিলের দিকে। মানাউস আর বেলেম আবার জেগে উঠলো। তবে দ্বিতীয় রাবার বুম সাধারণ ব্রাজিলীয়দের জন্য নিয়ে এলো আরো অনেক অত্যাচার। রেড ইন্ডিয়ানরা ততোদিনে রাবার চাষে ইতি দিয়েছে, পালিয়ে গিয়েছে গহীন বনে। কাজেই ব্রাজিল সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক চুক্তি করলো। ব্রাজিল যোগান দেবে কর্মী, যুক্তরাষ্ট্র দেখবে ব্যবসা। উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোককে জোরপূর্বক পাঠানো হল আমাজনে। প্রতিটি কর্মীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ব্রাজিল সরকারকে ১০০ মার্কিন ডলার দিত। এসব কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে খুব একটা যে সুখে ছিল না তা বলাই বাহুল্য। হাজারে হাজারে মরতো তারা অসুখ এবং বন্য জীব জন্তুর আক্রমণে। মাত্র ছয় হাজার কর্মী শেষপর্যন্ত নিজেদের আদি আবাসে ফিরতে পেরেছিলেন। বাকিরা হয় জঙ্গলেই থেকে গিয়েছেন কিংবা তাদের হাড়গোড় মিশে গিয়েছে আমাজনের সোঁদা মাটিতে।
দ্বিতীয় রাবার বুম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষহলে ব্রাজিলের রাবারের চাহিদা আবার কমে যায়। এরপরে আর আমাজনের বুক খুঁড়ে রাবার চাষের এই ব্যবসা সেভাবে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তবে রাবার ব্যারনদের বিরাট সব প্রাসাদ আর অত্যাচারের নিদর্শন দেখতে পেরু আর ব্রাজিলের আমাজনে অবস্থিত শহরগুলোতে অনেক পর্যটকের সমাগম হয়।
আমাজনের রাবার বুম, কিংবা সঠিক করে বললে কার্লোস ফিটজক্যারাল্ডকে নিয়ে ১৯৮২ সালে ‘ফিটজক্যারাল্ডো’ নামের একটি জার্মান চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে।