কালের স্রোতে হারিয়ে যায়নি এমন অনেক গান মনের অজান্তেই বারবার গুনগুনিয়ে বের হয়ে আসে ঠোঁটের ফাঁকে। ‘৮০ এর দশকের ব্যান্ড শ্রোতাদের অনেকের বেড়ে ওঠা ব্যান্ড শিল্পের উন্নতির অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে করতে। তখনকার সময়ের অনেক গানের সাথে মিশে আছে পুরনো দিনের অনেক স্মৃতি। বয়স হয়তো বেড়ে যায়, কিন্তু গানগুলো যৌবন ধরে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কিছু কিছু গান মনের মধ্যে তৈরি করে স্মৃতিকাতরতা।
তেমন কিছু গানের রেশ ধরে মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় চলে যাই অচিনপুরে নাম না জানা কোনো পাখির সাথে, অথবা ঐ দূর পাহাড়ের ধারে নিঃসঙ্গ একাকী যে মেয়েটি কাঁদছে তার মনের কথা জানার ইচ্ছা্য়, আবার হৃদয়ের সব ভালোবাসা প্রিয় মানুষকে বিলিয়ে দেওয়ার একান্ত আহবানে কিংবা কিশোর মন যাকে দেখে তাকেই ভালোবেসে ফেলার দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠার মতো অবিস্মরণীয় অনেক গানের সাথে দুরন্ত পথচলা ‘উইনিং’ ব্যান্ডের।
বলছি আশির দশকের কথা। পপসম্রাট আজম খান তখন সংগীত জগতে এক শক্তিশালী নাম। আজম খানের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজাতেন কিছু মিউজিশিয়ান। এদের মধ্যে ছিলেন শেলী, বাবু এবং হায়দার হোসেন। কিন্তু সেই সময় গুরুর সাম্রাজ্য এতটাই বিশাল ছিল যে, বাকি মিউজিশিয়ানদের পর্দার অন্তরালে পড়ে থাকতে হতো। কিন্তু এমনটা মেনে নিতে নারাজ ছিলেন শেলী-বাবুরা। তারা তখন ভাবছিলেন এভাবে চললে হয়তো তাদের মেধার কখনো মূল্যায়ন হবে না। পরবর্তীতে তারা ৩ জন সিদ্ধান্ত নেন গুরুর ছায়া হতে দূরে সরে আসার।
আজম খানকে ছেড়ে আসার পরবর্তী ৬ মাস ছিল তাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেননা রকগুরুর সান্নিধ্য থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু করার চেষ্টা করা খুব সহজ কথা নয়। বারবার তাদের মনে প্রশ্ন জেগে উঠেছে, কতটা সঠিক ছিল এই সিদ্ধান্ত? কিন্তু আজ আমরা ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই বলতে পারি, সেইদিন যদি দুরন্তপনা গানপাগলের সেই দল যদি বেরিয়ে না আসতো তাহলে আমরা পেতাম না উইনিংয়ের মতো একটি ব্যান্ড আর তাদের সৃষ্টি অসংখ্য সব মন মাতানো কালজয়ী গান।
১৯৮২ সালের গ্রীষ্মের এক দুপুরে বন্ধুর বাড়িতে বসে তৈরি করে ফেললেন নিজেদের কিছু গান। এবার গানগুলো একটি রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে রেকর্ড করার অপেক্ষা। যুবকগুলোর ভাগ্য ছিল বেশ সুপ্রসন্ন। ঢাকার ফার্মগেটে ঝংকার নামে এক স্টুডিওতে দেখা হয়ে যায় ফিডব্যাকের ফুয়াদ নাসের বাবু এবং পিয়ারু খানের সাথে। এই দুই প্রতিভাবান শিল্পী বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন সেই সময় থেকেই। নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও নতুনদের জন্যে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতে কখনো কুন্ঠাবোধ করেননি তারা। ফুয়াদ নাসের বাবুর সহযোগিতায় তখন এই নতুন ব্যান্ড মোট ৫টি মৌলিক গানের রেকর্ডিং করলেন।
১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি। দিনটি উইনিং এর জন্যে বিশেষ একটি দিন। এই দিনেই মিতুল (গিটার ও ভোকাল), ফাহিম (ইংরেজি গানের ভোকাল), শেলী (বেজ গীটার), হায়দার হোসেন (গিটার ও ভোকাল), রানা (কী-বোর্ড) এবং রঞ্জন (ড্রামস ও ভোকাল) মিলে উইনিং গঠন করেন। সঙ্গে ছিল একখানা হারমোনিয়াম, একটি গিটার আর নিজেদের কম্পোজ করা কিছু গান। কিন্তু সকল অভাবই কিংবা ঘাটতি পূরণ হয়ে যায় নতুন কিছু তৈরি করার আনন্দে, নতুন কোনো পদযাত্রায়।
ব্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বছরেই বিটিভির একটি অনুষ্ঠান ‘নির্ঝর’ এ ডাক পড়ে উইনিং ব্যান্ডের। অনুষ্ঠানটি নতুন প্রতিভাকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ঐ অনুষ্ঠানে উইনিং দুটি গান করেন যার একটি ছিল ‘মন কি যে চায় বল’ আর অন্যটি ছিল ‘নীল চোখ’। প্রচারের সাথে সাথে গান দুটি আশাতীতভাবে সাড়া ফেলে দেয়। ব্যান্ড ভক্তদের কাছে তখন নতুন করে খোঁজ পড়ে নতুন এই ব্যান্ডের। গান দুটি এখনো সমানভাবে জনপ্রিয় এবং এখনো আশি বা নব্বইয়ের দশকের শ্রোতাদের নিয়ে যায় পুরনো দিনের স্মৃতিতে।
দুই বছর পর ১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের উইনিং ফ্যান ক্লাব কর্তৃক সংগঠিত একক কনসার্টে প্রথম সরাসরি দর্শকদের সম্মুখীন হয় উইনিং। কনসার্টটি সেই সময় বেশ সফলভাবে সমাপ্ত হয় এবং দর্শকদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়। এই ধরনের সফল অনুষ্ঠান উইনিং ব্যান্ডকে নিজেদের উপর আরো বেশি আত্মনির্ভরশীল এবং সাহসী করে তোলে। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে গ্রীন হ্যারল্ড স্কুলে রেনেসাঁ, ফিলিংস এবং ক্যাওসের সঙ্গে একটি যৌথ কনসার্টে অংশগ্রহণ করে।
১৯৮৬ সালের শেষের দিকে ব্যান্ডের প্রধান গায়ক হিসেবে যোগ দেন জামান আলী চন্দন। চন্দনের অন্তর্ভুক্তি ব্যান্ডটিকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। ১৯৮৮ সালের দিকে ব্যান্ডটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে আরেকটি একক অনুষ্ঠান করে উইনিং। এরপর ধীরে ধীরে আরো মৌলিক গান তৈরির লক্ষ্য এগিয়ে যেতে থাকে ব্যান্ডটি। সেই বছরই বন্যায় দুর্গতদের সাহায্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সোলস, মাইলস, রেনেসাঁর মতো বড় বড় ব্যান্ডের সাথে একসাথে গান করেন ব্যান্ডটি।
১৯৯০ সাল ছিল ব্যান্ডটির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। সেই বছর ব্যান্ডটি তাদের প্রথম অ্যালবামের কাজ শুরু করে। সেই সময়ের জনপ্রিয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘সারগাম’ উইনিংয়ের গান অ্যালবামবন্দী করার আগ্রহ দেখায়। পরের দেড়টি বছর ব্যান্ডটির স্টুডিওতে গান তৈরি এবং রেকর্ডিংয়ের ব্যস্ততায় কাটে। একেকটা গান যেন নিজেদের এক একটি সন্তান। তাই নিজেদের গানগুলোর সাথে কোনো ধরনের আপোষ করেনি ব্যান্ডটি।
অন্তরের অন্তরস্থল থেকে একেকটি গান তৈরি করেছেন তারা। অ্যালবামের কাজ সম্পূর্ণভাবে শেষ হতে প্রায় ২ বছরের মতো সময় লাগলো। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে নিজেদের ব্যান্ডের নামেই প্রথম অ্যালবাম ‘উইনিং’ প্রকাশ করা হয়। সেই বছর অ্যালবামটিকে বছরের সেরা অ্যালবাম বিবেচনা করা হয়। অ্যালবামের হৃদয় জুড়ে, সোনার মেয়ে, মন কি যে চায়, নীল চোখ, আঁধারে তুমি, সুন্দর ধরণী গানগুলো কালের প্রবাহে এখনো সমান আবেগ ছড়িয়ে চলেছে।
প্রথম অ্যালবাম মুক্তির পর ভক্তদের আকাশছোঁয়া ভালোবাসা এবং অবারিত প্রশংসায় নিজেদের আত্মবিশ্বাস আরো অনেকাংশে বেড়ে যায় উইনিংয়ের। ধীরে ধীরে দ্বিতীয় অ্যালবামের কাজের দিকে মনোযোগ দিতে থাকে উইনিং। এবার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৯৯৫ সালে ‘অচেনা শহর’ নামে দ্বিতীয় অ্যালবামটি প্রকাশ করে। ‘অচেনা শহরে’র কিছু গানের মধ্যে রয়েছে অচেনা শহর, ইচ্ছে করে, মনে পড়ে, শীতের সকাল ইত্যাদি।
২০০০ সালটি ছিল উইনিং ব্যান্ডের জন্যে একটি দুঃস্বপ্নের বছর। এই বছর ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড্রামার রঞ্জন এবং প্রধান গায়ক চন্দন কানাডায় অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যান্ডের দুজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের এমন সিদ্ধান্তে ব্যান্ডের স্থায়িত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ওঠে। অপরিচিত জায়গা, অচেনা পরিবেশে কী করে আর গান হবে? সেই চিন্তায় সর্বক্ষণ তাদের মন বিভোর। কিন্তু সঙ্গীতের বীজ যে তাদের রক্তে পোঁতা রয়েছিল অনেক আগে থেকেই। তাই সুর থেকে খুব বেশি দূরে সরে যাওয়া তাদের জন্যে ছিল অসম্ভব ব্যাপার।
সারাদিনের অসম্ভব পরিশ্রম শেষে ঘরে ফিরে গিটারে টুং টাং করে কোনো গানের সুর তুলেই যেন ভুলে যাওয়া যেত সারাদিনের সকল ক্লান্তি। এভাবে কানাডায় নতুন আরো কিছু সদস্যের অন্তর্ভূক্তিতে উইনিংকে নতুনরূপে গড়ে তোলার প্রয়াস করা হয়। ২০০২ সালে কানাডাতে প্রথম কোনো সরাসরি দর্শকদের মাঝে গান করে দলটি। অনুষ্ঠানটির সফলতার পর ২০০৩ সালের দিকে টরেন্টোর ‘স্টুডিও ৪২’ এ নিজেদের কিছু জনপ্রিয় গান ‘লাইভ’ স্টাইলে রেকর্ড করা হয়। পরবর্তীতে ‘উইনিং পরবাসে’ নামে গানগুলো অ্যালবামবন্দী করা হয়।
পরবর্তীতে ব্যান্ডের আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা ও বেস গিটারিস্ট শেলী এবং বিপ্লব (কী-বোর্ড) যখন কানাডায় পাকাপাকিভাবে বসবাসের জন্য চলে যান, তখন যেন কানাডায় উইনিংয়ের চাঁদের হাট বসে। তবে গানের সাথে থাকলেও অনেক বছর কোনো ধরনের অ্যালবাম তৈরি করেনি উইনিং। ২০১৬ সালের দিকে এসে বাংলাদেশে উইনিংয়ের তৃতীয় এ্যালবাম ‘বহু দূরে’ মুক্তি পায়। সফট রক ও মেলো রকের সামঞ্জস্যে ১২টি গানের এই অ্যালবামটির বহু দূরে, কখনো আমাকে, দূর-পাহাড় ২, চলো ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
আলবামটির মোড়ক উম্মোচনের দিনে ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রঞ্জন অ্যালবামটির নামকরণ নিয়ে বলেন,
‘‘আজ আমাদের ব্যান্ডের বয়স ৩৩ বছর। দীর্ঘদিনের এ পথ চলায় আমরা আসলে সবাই বহুদূরে চলে গেছি। বন্ধু থেকে বহুদূরে, দেশ থেকে বহুদূরে, গান থেকে বহুদূরে। তারপরও আমাদের পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। পুরনো সব স্মৃতি মনে পড়ে। আর এ কারণেই অ্যালবামটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বহু-দূরে’।’’
ব্যান্ড হিসেবে উইনিং বেশ সফল একটি ব্যান্ড হলেও ব্যান্ডটিকে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো চড়াই উৎরাই। নিয়মিত ব্যান্ড সদস্যদের দলত্যাগ উইনিংয়ের জন্য বিশাল এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বারবার। পরবর্তীতে ব্যান্ডের মূল সদস্যদের বিদেশে পাড়ি দেয়ার মাধ্যমে ব্যান্ডটির অস্তিত্ব অনেকটাই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। বর্তমানে জামান আলী চন্দন (ভোকাল ও গিটার), মোহাম্মদ শামসুন নুর রঞ্জন (ড্রামস ও ভোকাল), এস এম মশিউর রহমান শেলী (বেজ), বিপ্লব আশরাফসহ (কিবোর্ড) ব্যান্ডটির নিয়মিত সদস্য।
সঙ্গীতের দীর্ঘ যাত্রায় ব্যান্ডটির অ্যালবামের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। তবে সংখ্যা যেমনই হোক, এরই মধ্যে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন মন মাতানো সব গান। এখনো ভালো গানের শ্রোতা এবং উইনিংয়ের শুভাকাঙ্ক্ষীদের চাওয়া আগের মতো নিয়মিত হয়ে শ্রোতাদের সুমধুর সব গান উপহার দিয়ে যাবেন এই ব্যান্ড।
ফিচার ইমেজ-megainsane.com