বই পড়তে ভালোবাসেন অনেকেই। হয়তো আপনিও সেই দলেই পড়েন। কিন্তু ভেবে বলুন তো ঠিক কতগুলো বই সারাজীবনে পড়েছেন আপনি? কতগুলো বই এক বছরে পড়তে পারবেন? বই পড়াটা কেবল মজার ব্যাপার নয়, এর সম্পর্কে এমন অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আছে যেগুলো জানাটাও বেশ মজার। চলুন, বইয়ের মাস আর বইমেলার মাস ফেব্রুয়ারিতে আজ জেনে আসা যাক বইয়ের জগতে এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যরকম আর মজার কিছু ব্যাপারকে যেগুলো হয়তো আপনার কোনো কাজে আসবে না, তবে মনের খোরাক জোগাবে নিশ্চিত।
পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি বই পড়েছে কে?
পুরো পৃথিবীতে কে সবচাইতে বেশি বই পড়েছে সেটা নিয়ে দ্বিধা থাকতেই পারে। তবে ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচাইতে বেশি বই পড়েছেন সেখানকার ৯১ বছর বয়সী নারী লুইজ ব্রাউন। আর সেটাকে কোনো না কোনোভাবে পুরো পৃথিবীর একটা সংখ্যা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়! ঠিক কতগুলো বই পড়েছেন এই নারী? আন্দাজ করুন তো! এক হাজার নয়, দুই হাজার নয়, পুরো ২৫ হাজার বই পড়েছেন এই নারী। তা-ও কেবল গ্রন্থাগার থেকে নিয়েই। আর এর বাইরে কতগুলো বই পড়া হয়েছে তার? সেটা জানা নেই ঠিক। শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৪৬ সালে। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ডজনখানিক করে বই পড়ে শেষ করেছেন লুইজ। আর কখনো তার বইগুলো ফিরিয়ে দিতে একটুও দেরী হয়নি। ঠিক সময় আর নিয়ম মেনেই বই শেষ করেছেন এই নারী। পড়ার ক্ষেত্রে সবসময় একটু বড় অক্ষরের বইগুলোকেই বেছে নিয়েছেন লুইজ। চোখে সামান্য সমস্যা থাকার কারণে নিজের যাতায়াতের পথে অবস্থিত স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রায় সবগুলো বই পড়ে শেষ করে ফেলেন তিনি ধীরে ধীরে। গ্রন্থাগারিকের মতে, টানা ৬০ বছর ধরে এমন অভ্যাস চালু রাখলে লুইজের নাম রেকর্ড বুকে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। তবে কোনো রেকর্ড করা নয়, বরং ছোটবেলায় নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকে শেখা বই পড়ার অভ্যাসটাকেই চালিয়ে গিয়েছেন লুইজ। বই পড়া শুরু হয় তার মাত্র ৫ বছর বয়স থেকে। এরপর থেকে আর পড়াশোনা থামাননি তিনি।
পড়াশোনার ক্ষেত্রে খুব একটা বাছবিচার নেই লুইজের। তবে পারিবারিক কাহিনী এবং ঐতিহাসিক বই পড়তে বেশি ভালো লাগে বলে জানান লুইজ। তবে পাশাপাশি হালকা মেজাজের, যুদ্ধ নিয়ে লেখা বই- এগুলোও পড়ে থাকেন তিনি। মিস লুইজের জন্ম ওয়েলসে। সেখানে ক্যাসল ডগলাস নামক একটি গ্রন্থাগার থেকে নিয়মিত বই পড়া শুরু করেন তিনি। তবে সেটা খুব কম সময়ের জন্য। কিছুদিন বাদেই বিয়ে হয়ে যায় তার। আর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য অন্যত্র বদলি হন তিনি। লুইজ ব্রাউনের মেয়ে লুইজ প্রাইড মায়ের ব্যাপারে বলতে গিয়ে জানান, সারাদিন এত বই পড়ার পরেও মা অনেক বেশি পড়তে চান। ফলে খবরের কাগজ পড়তে এবং টেলিভিশন দেখতেও দেখা যায় তাকে। কয়েক বছর আগে মেয়ের সাথে থাকবেন বলে চলে আসেন লুইজ। ফলে তার পড়ার স্থানেরও বদল হয়। তবে পড়ার অভ্যাস বদলায়নি এবারেও। মেয়ের বাড়ির পাশ থেকেই জায়গা খুঁজে নেন তিনি নতুন বই পড়ার। গত ছয় যুগ ধরে প্রতি ছয়দিনে ছয়টি বই পড়েছিলেন লুইজ। তবে কয়েক বছর ধরে সেই অভ্যাস পালটে গিয়ে প্রতি সাতদিনে বইয়ের সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২টি বইয়ে। আর গ্রন্থাগার থেকে ধার করা বইয়ের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৫ হাজারের ঘর। এসবের বাইরে আছে লুইজ ব্রাউনের পড়া বাদবাকি বইগুলো। এটাই শেষ নয়। এ তো গেল অনেক বেশি বই পড়েছে এমন মানুষের কথা। তবে বই নিয়ে এমন মজার তথ্যগুলো কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বই পড়া নিয়ে যে কেবল সাধারণ মানুষই আগ্রহী তা কিন্তু নয়। বিখ্যাত সব মানুষেরাও কিন্তু বই পড়েছেন এবং বই পড়া সংক্রান্ত নানারকম স্মৃতি তাদের আছে।
সফল মানুষ এবং বই
সফল মানুষদের মধ্যে একটি ব্যাপার প্রায় সময়েই উপস্থিত থাকে। আর সেটি হল, তারা সবাই বই পড়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাদের অনেকে হয়তো পড়াশোনা করেননি, অনেকে হয়তো বিদ্যালয়ের গন্ডী পার হননি। তবে ব্যাপারটা ঠিক এমন নয় যে, বিখ্যাত ও সফল মানুষ হতে গেলে আপনাকে বিদ্যালয়ের বই কিংবা কিছু বাঁধাধরা বই পড়তেই হবে। ঠিক তেমন করেই সফল মানুষেরা, সেটা শিক্ষিত হোক কিংবা না হোক, তাদের মধ্যে থাকে বই পড়ার ইচ্ছা এবং নানা বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ।
এই তালিকায় আছেন বিল গেটস, প্রতি বছর যিনি কম করে হলেও ৫০টি বই পড়েন। আছেন মার্ক কিউবেন, প্রতিদিন তিনঘণ্টা ধরে পড়েন তিনি। মার্ক জাকারবার্গ অবশ্য সেদিক দিয়ে একটু পিছিয়ে আছেন। ২০১৫ সালে নেওয়া অঙ্গীকার অনুসারে, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি বই পড়ে শেষ করেন তিনি। অপরাহ উইনফ্রে তো কেবল বই পড়েন না। সেইসাথে সেই বই নিয়ে আলোচনাও করেন প্রতি মাসে মানুষের সাথে। শিক্ষিত এবং স্বল্প-শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এদিক দিয়ে খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে পার্থক্য আছে সফল মানুষ এবং তাদের মধ্যে যারা খুব একটা সাফল্য তাদের পুরো জীবনে দেখাতে পারেননি তাদের মাঝে। সফল মানুষেরা পড়াশোনা করুন কিংবা না করুন, তারা কখনো নতুন কিছু শেখা থামান না। প্রতিদিন কোনো না কোনো শিক্ষামূলক বইয়ের মাধ্যমে তারা শিখে থাকেন। আর এক্ষেত্রে তারা বেছেও নেন শিক্ষামূলক সব বই। অন্যদিকে সফল নন এমন মানুষের কাছে প্রাধান্য পায় ম্যাগাজিন এবং এমন সব বই যেগুলো থেকে সাময়িক বিনোদন পাওয়া সম্ভব, অন্যকিছু নয়।
ওয়ারেন বাফেটকে পৃথিবীতে সবাই একনামে চেনে। প্রচুর সম্পদ তার। এই মানুষটিকেই একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সফলতার উপায় সম্পর্কে। তিনি দ্রুত নিজের হাতের পাশে থাকা বইগুলোর দিকে তাক করেন। বলেন, এই বইগুলোর ৫০০ পৃষ্ঠা করে প্রতিদিন পড়তে হবে। এভাবেই জ্ঞান গড়ে ওঠে। তবে সেইসাথে তিনি এটাও জানান যে, আমাদের অনেকেই এই কাজ করার সামর্থ্য রাখলেও তা করতে চাইবে না। আর হ্যাঁ! ব্যাপারটি কিন্তু সত্যি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ নয়, বলছি আমেরিকার কথা। উন্নত দেশ হিসেবে আমেরিকাবাসীদের পড়াশোনার পেছনে সবচাইতে বেশি সময় কাটানোর কথা থাকলেও তেমনটা কিন্তু একদম নয়। বরং, পড়াশোনার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ভারত, থাইল্যান্ড, চীন এবং ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো। ভারতীয়দের তুলনায় অর্ধেক সময় বইয়ের পেছনে ব্যয় করে আমেরিকার মানুষেরা। একজন ভারতীয় তার পুরো জীবনে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১০ ঘন্টা ৪২ মিনিট বই পড়ে থাকেন। তবে ভারতে শিক্ষার হার ততটা বেশি নয় এরপরেও। বই পড়া অসম্ভব সুন্দর আর প্রশংসনীয় একটি কাজ। মানুষ বই পড়লে কেবল সামাজিকভাবে উন্নত হয় না, মানসিকভাবেও হয়। তাই বই পড়ার অভ্যাস করুন। অন্তত এই বইয়ের মাস ফেব্রয়ারিতে নিজেকে বই পড়তে উৎসাহিত করুন; বই পড়ুন।
ফিচার ইমেজ: Medium