Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘শঙ্খচিল’ কাঁটাতারের সীমানা চেনে না…

ইছামতিতে স্টিমারে বিজিবির টহলসঙ্গী হয়েছেন এক সাংবাদিক। পাশে দিয়ে একটি ভারতীয় নৌকা সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে সেটিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সাংবাদিক আটক না করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ক্যাপ্টেন বলেন, “এরা যাতায়াত করছে হাজার বছর ধরে। আর আমাদের কন্ট্রোল তো সবেমাত্র সাতষট্টি-আটষট্টি বছরের। কী করবেন? গুলি করবেন? নাকি জেলে পুরবেন? জেলে জায়গা হবে না।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি শঙ্খচিলের প্রথম দৃশ্য এটি, যা সাক্ষ্য দেয়- নির্মাতা গৌতম ঘোষ দুই দেশের সীমানা প্রাচীরকে ঘিরে তার গল্পের ফাঁদ পেতেছেন। প্রসঙ্গক্রমে পরিচালক তার ছবিতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সিরিল র‌্যাডক্লিফের ফোর্সড লাইন অব কন্ট্রোলের প্রসঙ্গ এনেছেন। দুই দেশের অদ্ভুত বিভাজনের বর্ডার লাইনটি সাংবাদিকের ভাষ্যে হয়ে উঠেছে ‘একটু নেশাগ্রস্ত হয়ে টানা’ বিভাজন রেখা। গৌতমের শঙ্খচিল দু’দেশের সীমারেখা মুছে দিতে না পারলেও চেয়েছে বাঙালির মধ্যকার বিভাজন ঘোচাতে। এ চলচ্চিত্র যেমন মনুষ্যত্ব দেখিয়েছে, তেমনি তার বিপরীত চিত্রও দেখিয়েছে। তবে তা দেখানোতে নিজের চিত্রনাট্যে নির্মাতা আদৌ কি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে পেরেছেন?

শঙ্খচিলের ফ্যানমেইড পোস্টার; Image Souce: Shakhachil Facebook page

কাঁটাতারে ঝুলে আছে বাংলাদেশী কিশোরের লাশ। শঙ্খচিলের এই ভিজুয়্যাল দেখে সচেতনভাবেই মনে পড়ে ফেলানি হত্যার কথা। গৌতমও বোধহয় ফেলানিকে স্মরণ করেই এমন দৃশ্যের সংযোজন করেছেন। ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে বিএসএফ তাদের প্রেস রিলিজ প্রকাশ করে। সেই প্রেস রিলিজের অসঙ্গতির কথা জানায় সাংবাদিকরা। তাদের থেকে একজন বিএসএফের রবি ভার্মাকে মনে করিয়ে দিয়ে বলে, ”এটি একটি নজিরবিহীন অমানবিক হত্যাকাণ্ড।” এমতাবস্থায় অফিসার নিজেদের দোষ স্বীকার না করে লিথাল ওয়েপন ব্যবহারে সংযত না হবার কারণের ব্যাখ্যা তো দেয়ই না, উপরন্তু ‘ব্লাডি হিস্ট্রি’র ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে সটকে পড়েন ঘটনাস্থল থেকে। দৃশটি দেখে এই ব্যাপারে নির্মাতার বক্তব্য শোনার আগ্রহ হয়। মানে, বহু বছর পরে আজও সীমান্ত হত্যার দায় ব্রিটিশ র‌্যাডক্লিফের ওপর চাপিয়ে দেয়া তিনি নিজে কতটা যৌক্তিক ভাবেন তা জানতে সত্যিই ইচ্ছা করে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে নির্মাতাকে শঙ্খচিলে সত্যিকার অর্থেই ভীষণ জটিল একটি বিষয় নিয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে গৌতম যে গল্পকে সরাসরি রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে যাননি সেই কৃতিত্ব তার। বরং এ গল্পে নির্মাতা প্রাধান্য দিতে চেয়েছে ‘হিউম্যান গ্রাউন্ড’। আপন ভিটা ছেড়ে বিতারিত হবার যন্ত্রণা এখানে স্থান পায়। পুরনো পত্রপাঠ শেষে ক্রন্দনরত মুনতাসির চৌধুরী বাদল বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতির তীরে দাঁড়িয়ে নদীকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে, “নদী তুমি কার? হিন্দু নাকি মুসলমানের?”

ইছামতি সেই নদী, যে নদীতে দেশ বিভাজনের সময় দুটি বোট দুই দেশের দিকে যাত্রা করেছিল। দারুণ সিনেম্যাটিক সেই শটের কম্পোজিশন!

ছবিটি ভারতে ৬৩ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত; Image Souce: Shakhachil Facebook page

পরিষ্কারভাবেই বলা যায়- গৌতম ঘোষের শঙ্খচিলের গল্পের গাঁথুনি বেশ শক্ত। বাংলাদেশি স্কুলশিক্ষক বাদল, তার স্ত্রী লায়লা, এবং একমাত্র মেয়ে রূপসাকে নিয়ে সীমান্তবর্তী ইছামতীর তীরে ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকেন। তাদের মেয়ে শারীরিকভাবে মাঝে মাঝে অসুস্থতা বোধ করে। রাজস্থান থেকে আসা বিএসএফ জওয়ান অর্জুন সিংয়ের সঙ্গে প্রাচীরের এপারে থেকে বন্ধুত্ব হয় ওর। এর কারণ অর্জুনের নিজেরও রূপসার সমবয়সী একটি মেয়ে আছে। পুরো ছবিতে দুজনের বন্ধুত্বের দারুণ কিছু ভিজুয়্যাল আমরা দেখি। আবেগঘন ও স্পর্শকাতর সেসব ভিজুয়্যাল। অনুরূপভাবে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হেমন্ত বাগচীর সাথে বাদলের সম্পর্কও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় গল্পে। কিন্তু আপত্তি হচ্ছে ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বাদলের অভিনয় সাবলীল হলেও তার বাংলায় পাওয়া যায় কলকাতার টান। বর্ডার গার্ড রফিকুলেরও ঐ একই সমস্যা। তাছাড়া রফিকুলের শারীরিক গড়ন এবং অনুরোধ করার ধরন খুব একটা গ্রহণযোগ্য লাগে না। একইভাবে সাতক্ষীরার দেবহাটার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় অন্তত সিনেমায় তার বাড়ির পরিবেশ যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেই অনুযায়ী একজন স্কুল শিক্ষকের বাড়িতে অ্যাকুয়ারিয়াম থাকাটা মানানসইও দেখায়নি। এবং উক্ত বস্তুর উপস্থিতি নির্মাতা যে জন্য রেখেছেন তা মূল গল্পে খুব একটা সহায়তাও করে না। এছাড়া বাদলের বলা, “আমাদের ভাষা দিবস আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে”এই সংলাপও অস্পষ্ট। এর ফলে মনে হয়েছে, নির্মাতা শব্দচয়নের ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতন হলে ভাল করতেন।

কুসুম শিকদার এবং সাঁঝবাতি দুজনই লায়লা ও রূপসা চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন মুভিতে। Image Souce: Shakhachil Facebook page

শঙ্খচিলে গৌতম ঘোষ তার কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপসাকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তার জন্য সাধুবাদ পাবেন। কেমন যেন একটা মায়া মায়া ভাব আছে মেয়েটার চেহারায়! কিশোরী রূপসা তার অভিনয়ে প্রতিটি দৃশ্যে মোহনীয়তা দেখিয়েছে। সবচেয়ে ভাল লাগে যখন আইসিইউ-তে পাশের বেডের রোগীকে সে ভেংচি কেটে ক্ষ্যাপানোর সময় দুষ্টুমিষ্টি এক এক্সপ্রেশন দেয়। প্রথমার্ধের পাঠ বাংলাদেশে চুকিয়ে সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধ গড়ায় ভারতে। হেমন্ত বাবুর রেফারেন্সে সুদীপ্ত নামে একজনের আশ্রয়ে অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসার জন্য পরিচয় গোপন করে সেখানে থাকতে হয় বাদলের পরিবারকে। সুবিধার্থে তার কথামতো ধারণ করতে হয় হিন্দুয়ানী নাম পরিচয়। এমন অস্তিত্ব সংকট সুনিপুণতায় ফ্রেমবন্দি হয়েছে ঈশান ঘোষের ক্যামেরাতে। ভাঙা জমিদার বাড়িতে একাকী সুদীপ্তও দুঃখী। গান-বাজনা ও মদে কাটে তার সময়। তবে এ নিঃসঙ্গতার কারণ জানা যায় না। অবশ্য এর সবিশেষ প্রয়োজনও পড়ে না। বরং এখানে অতিরিক্ত ফ্রেম যোগ না হওয়াই শঙ্খচিলের পরিমিতিবোধ। কলকাতার রাস্তায় বাদলের শঙ্খচিল দেখতে গিয়ে মাটিতে পরে যাবার সিনের শটগুলোর ফ্রেমিং নান্দনিক। ইন্দ্রনীল ঘোষ ও উত্তম গুহের আর্ট ডিরেকশন মোটের উপর ভাল লেগেছে। ধুলো ময়লা জমে থাকা পুরনো সুটকেস, চিঠি, এবং সেখানে আরশোলার বিচরণ নজর কাড়লেও অন্যত্র লায়লার রান্নাঘরের তাকে সাজিয়ে রাখা মশলার প্লাস্টিকের বয়াম একটু বেশিই নতুন ও চকচকে মনে হয়। সম্পাদনার কাজের ক্ষেত্রে চমৎকারভাবে তা সম্পন্ন করেছেন বৈশালী ভৌমিক ও নীলাদ্রি রায়। শঙ্খচিলে গানের ব্যবহার থাকলেও তা কাহিনিপ্রবাহে সামান্যতম বাধা দেয়নি বিধায় তা ইতিবাচক সংযোজন।

প্রাণোচ্ছল এই কিশোরী শঙ্খচিলের প্রধান আকর্ষণ; Image Souce: Shakhachil Facebook page

রূপসার অ্যাম্বুলেন্সের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বাজতে থাকা বাংলা ছবির ধুন্ধুমার আইটেম সং বেশ সচেতনভাবে অস্বস্তি ও বিরক্তিমিশ্রিত অনুভূতির উদ্রেক ঘটাতে পেরেছে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি পরিচয় জানার পর এর ফায়দা নেয়ার বাস্তবতার বিপরীতে দালাল, বাদলকে ‘বাংলাদেশি স্মাগলার’ বলে দোষারোপ করে সুবিধা নিতে চাইলে লোকজন তা আমলে না নিয়ে বরং বাদলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসায় ধরা পড়েছে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব। ২০১৬ সালের আরেক সিনেমা অজ্ঞাতনামা-তে লাশের পরিচয় কাস্টমস পুলিশের কাছে প্রকাশ, আর এই সিনেমাতে বাদলের হাসপাতালের রিসিপশনিস্টের কাছে পরিচয় প্রকাশের মধ্যে মিল আছে। তবে শঙ্খচিলে উদ্ভূত বাদলের পরিস্থিতির সাথে তার দেয়া ব্যাখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ লাগে। কারণ তার অসহায় অবস্থায় আর কী-ই বা করার ছিল?

বাদল পরিবারের করুণ পরিণতির জন্য শত সহায়তার পরেও যখন হেমন্ত বাগচীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, তখন তা ফ্রেমে দুঃসহ হয়ে ধরা দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশে আজও যে গুটিকয়েক মানুষ একরকম সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করে সেই সত্য প্রকাশ পায় হেমন্তকে উদ্দেশ্য করে বলা এক সংলাপে। প্রত্যুত্তরে “নিজের দেশ ছেড়ে কোথায় যাব?”— যেন বৈষম্যের শিকার হওয়া পৃথিবীর সকল সংখ্যালঘু ব্যক্তির চাপা আর্তনাদ ধ্বনিত হয় ছবিটিতে। গৌতম ঘোষের শঙ্খচিল প্রচলিত আইন ও নিয়মের জালে অদৃষ্টের পরিহাসে ধরা পড়েছে বললে যেমন ভুল বলা হয় না, তেমনি আবার শঙ্খচিল সব বিভাজনরেখা উপেক্ষা করে, সীমানার বাঁধা পেরিয়ে সর্বত্র উড়ে বেড়িয়েছে- এ কথাও অসত্য নয়। সব মিলিয়ে শঙ্খচিল যেন একইসাথে একাধিক বাস্তবতার বহুমাত্রিক বয়ান।

Language: Bangla

Topic: The article is a review of a Bangladesh-India joint venture drama fiction film released in 2016.

Featured Image: Shakhachil Facebook page

Related Articles