Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিডনাইট ম্যাস: অলৌকিক এক দ্বীপের এলিজি

শার্লি জ্যাকসনের ‘দ্য হন্টিং অব হিলহাউজ’ বিশ শতকের সেরা হরর থ্রিলারগুলোর একটি। ২০১৮ সালে তাকে মিনিসিরিজে রূপ দেন মাইক ফ্ল্যানাগান। সাথে সাথে সাড়া পড়ে যায় বোদ্ধামহলে। হরর জনরার অগ্রনায়ক স্টিফেন কিং অভিহিত করেন দুর্দান্ত নির্মাণ হিসেবে। সেই থেকেই মাইকের পরিচালক পরিচয়ে সিরিজ জগতে হাঁটা। বছর দুই পর ২০২০ সালে নির্মাণ করেন ‘দ্য হন্টিং অব ব্লাই ম্যানর’। হেনরি জেমসের হরর উপন্যাস ‘দ্য টার্ন অব দ্য স্ক্রু’ অবলম্বনে। এটাও প্রশংসিত হয় দারুণভাবে। অতঃপর সেই মাইকের হাত ধরেই ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সামনে আসে ‘মিডনাইট ম্যাস’। নিজের সৃষ্টি নিয়ে তার নিজের ভাষ্য,

আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই, মিডনাইট ম্যাস এখন অব্দি আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রজেক্ট।

মাইক ফ্ল্যানাগান নির্মিত তৃতীয় সিরিজ মিডনাইট ম্যাস; Image source: kumparan.com

ক্রকেট আইল্যান্ড; আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে মাইল ত্রিশেক দূরে এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ। জনসংখ্যা মাত্র ১২৭ জন। তরুণ রাইলি ফ্লিন মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়িচাপা পড়ে নিহত হয় একজন। ফলে মূল ভূখণ্ডে চার বছর সাজাও খাটতে হয় তাকে। কিন্তু অনুশোচনা পিছু ছাড়ে না। দ্বীপে পরিবারের কাছে ফিরে আসে নতুন জীবনের আশায়। কিংবা পুরাতন জীবনে নতুন বাঁক খুঁজতে। বাঁক আসে গোটা দ্বীপবাসীর জীবনেই। কেউই যা কল্পনা করেনি। শুরুটা অবশ্য চার্চেই। ক্রকেটের সেইন্ট প্যাট্রিক চার্চের যাজক মনসিনর প্রুট পূণ্যভূমি জেরুজালেম সফরে গিয়েছেন। তার জায়গায় এলো নতুন যাজক পল। আর একের পর এক ঘটতে থাকল অলৌকিক সব ঘটনা। যেন ক্রকেট দ্বীপ জুড়ে নয়া ধর্ম-আন্দোলন কিংবা উন্মাদনা।

‘মিডনাইট ম্যাস’ মাইকের দীর্ঘচর্চিত চিন্তার প্রকাশ। ক্যাথলিক ধর্মে বেড়ে ওঠা শৈশবের স্মৃতি, পরবর্তী জীবনে নাস্তিকতার প্রভাব, ধর্মসংক্রান্ত পড়াশোনা এবং হররের প্রতি ভালোবাসাকে মেলে ধরেছেন রূপালি পর্দায়। ক্যাথোলিক মিথ, বাইবেল, চার্চের নিয়মকানুন এবং বিভিন্ন আচার নিয়ে তার অভিজ্ঞতা রীতিমতো এনসাইক্লোপিডিয়া পর্যায়ের। পাঠ্য হিসেবে পড়ার সময়েই বাইবেলের হরর উপাদানগুলো তাকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে মিশরের মাটিতে ফেরেশতা নেমে আসা, প্রথম সন্তানদের হত্যা করা, নদীর পানি রক্তে পরিণত হওয়া, পঙ্গপালের উৎপাত কিংবা আগুনের স্তম্ভ। পরবর্তী জীবনে এসব তার গল্পে পরোক্ষভাবে হাজির থেকেছে। ‘মিডনাইট ম্যাস’ হলো অর্জিত সেসব ধারণা নিংড়ে দেয়ার জায়গা। যেখানে চরিত্রগুলোর মুখ দিয়ে বর্ণনা করেছেন একান্ত ব্যক্তিগত দর্শন। এ ব্যাপারে তার ভাষ্য,

বড় পার্থক্য হলো এই প্রজেক্টটা সব সময় থেকেছে আমার ব্যক্তিগত বিষয় রাখার কেন্দ্র হিসেবে। এখানেই বলা হয়েছে- বিশ্বাস এবং ধর্ম নিয়ে আমি কী চিন্তা করি, আমার কাছে বেঁচে থাকার মানে কী, এবং মৃত্যুর পরে কী ঘটে। কিংবা এরকম ছোট ছোট সকল প্রশ্নের জবাব।

মাইক ফ্ল্যানাগান এবং স্ত্রী অভিনেত্রী কেট সিগ্যাল; Image Source: sensacine.com

সাকুল্যে সাতটা এপিসোড নিয়ে সিরিজ। প্রতিটির নাম বাইবেলের কোনো এক পুস্তকের নামে। জেনেসিস, সাম, প্রভার্বস, ল্যামেন্টেইশান, গসপেল, অ্যাক্টস্ অব দ্য এপোসলস্ এবং রেভলেইশান। প্রথম দুই পর্বে খুব ধীরগতিতে গোটা দ্বীপ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে মুখ্য চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত হতাশা, না পাওয়া, আসক্তি কিংবা প্রত্যাশা। আস্তে আস্তে সামনে আসে হরর রহস্য। মানুষের চিরাচরিত চিন্তার বিষয়বস্তু জীবন ও মৃত্যু। যাপিত জীবনের উদ্বেগ কিংবা মৃত্যুকে পরাজিত করার নিগূঢ় চাওয়া। ফ্ল্যানাগান একেই ব্যবহার করেছেন নিপুণ হাতে, যার পরিণতি স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় জগতে প্রবেশ করা। শুভ-অশুভের চিরন্তন দ্বন্দ্বে নেমে যাওয়া। ফলে ধর্মের অনুষঙ্গ, এমনকি প্রতীকী উপাদানও প্রবেশ করেছে সিরিজে।

যাজক পলের রহস্যময় আচরণ ক্রকেট দ্বীপে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। পঙ্গুত্ব ঠিক করে দেয়া কিংবা দূরারোগ্য ব্যাধিকে সুস্থ করে দেয়া। দুয়েকজন অবশ্য চমকায় অন্য একটা বিষয়ে। বৃদ্ধ মনসিনরের যৌবনকালের ছবির সাথে যাজক পলের অদ্ভুত মিল। পল কি তাহলে প্রুটেরই আত্মীয়? নাকি অন্য কোনো রহস্য? সেই সাথে দ্বীপ চষে বেড়াতে থাকে একটা ডানাওয়ালা রক্তচোষা অদ্ভুত প্রাণী। হয়ে ওঠে দ্বীপের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। সে কি কোনো অ্যাঞ্জেল নাকি ভ্যাম্পায়ার? ভ্যাম্পায়ারের কথা আসলেই মনে আসে ব্রাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলা, স্টিফেন মেয়ারের টুইলাইট সাগা কিংবা হালের ভ্যাম্পায়ার ডায়েরিজ-এর কথা। ফ্ল্যানাগানের এই নির্মাণ যেন গথিক হরর এবং রিলিজিয়াস হররের মিশেলে এক নতুন ধারার উদাহরণ হয়ে উঠলো।

ধর্মীয় রসদের সাথে গথিক হররের মিশেল ঘনীভূত হয়েছে রহস্য; Image Source: thecinemaholic.com

হরর নিয়ে কাজের লিস্ট মাইকের ছোট না। স্টিফেন কিং ছাড়াও তার নির্মাণের প্রশংসা করেছেন কোয়েন্টিন টারান্টিনো এবং উইলিয়াম ফ্রিডকিন। ছাত্রাবস্থাতেই কয়েকটা ফিল্ম এবং শর্টফিল্ম সামনে আনেন মাইক ফ্ল্যানাগান। সেগুলো ছোট পরিসরে আদৃতও হয়; হররের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিও ফুটে ওঠে।

আনুষ্ঠানিকভাবে পরিণত মাইক ফ্ল্যানাগানকে দেখা যায় এবসেনশিয়া (২০১১) এবং অকিউলাস (২০১৩)-এ। দুটিই তাকে জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। ২০১৬ সালে একযোগে আনেন তিন চমক। হুশ, বিফোর আই ওয়েক এবং ওইজা: অরিজিন অব ইভিল। হররপ্রিয় দর্শক ঠিক ঠাহর করতে পারল এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। এরপর ২০১৭ জেরল্ড’স গেইম এবং ২০১৯-এ ডক্টর স্লিপ। দুটিই স্টিফেন কিংয়ের গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ।

‘দ্য হন্টিং অব হিলহাউজ’ তার স্বাতন্ত্র্য চিনিয়ে দেয়; Image Source: cinemablend.com

একই অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রীকে ভিন্ন চরিত্রে বারবার ব্যবহারের মুন্সিয়ানা মাইকের। ‘মিডনাইট ম্যাস’ নির্মাণে জড়িত প্রায় কুশীলবই ইতোপূর্বে মাইকের অন্যান্য সিরিজে কাজ করেছেন। এরিন গ্রিন চরিত্রে আছেন কেট সিগ্যাল। তার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। হরর সিনেমায় অভিনয় দিয়ে ‘স্ক্রিম কুইন’ উপাধি পেয়েছেন। সম্পর্কে মাইকের স্ত্রী; ইতোমধ্যে অধিকাংশ নির্মাণেই দেখা গেছে কেটকে। অনুতপ্ত তরুণ রাইলি ফ্লিন চরিত্রে জ্যাক গিলফোর্ড এবং সেইন্ট প্যাট্রিকের কর্তৃত্ব ফলানো সদস্য বেভ কেইন চরিত্রে দেখা যায় সামান্থা স্লোয়ানকে। হ্যামিশ লিঙ্কল্যাটার মাইকের কাজে নতুন মুখ। বেশ দীর্ঘ ক্যারিয়ার রূপালি পর্দায়। তবে নতুন রূপে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সিরিজজুড়ে তার রহস্যময় অভিব্যক্তি চোখ আটকে রাখার মতো।

শেরিফ হাসান চরিত্রে থাকা রাহুল কোহলি বিশেষভাবে দখল করে রেখেছে স্ক্রিন। ক্যাথলিক বিশ্বাসের উগ্রচর্চার সময়ে স্বীয় পুত্র আলিকে নিয়ে সে ভীত। দ্বীপের ধর্মীয় টানাপোড়েনের মাঝখানে মুসলিম হিসেবে দ্বিধাগ্রস্ততা উঠে এসেছে তার মধ্য দিয়ে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়, নাইন-ইলেভেনের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া হাসান পুলিশ হয়েও অদ্ভুতভাবে কোণঠাসা। চলতে থাকে আরেকজনের সন্দেহ এবং ভ্রকূটিকে মাথায় নিয়ে। হাসান যেন নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকায় কোণঠাসা হয়ে পড়া মুসলমানদের প্রতিনিধি, যারা ইসলামোফোবিয়ার কবলে মূলধারার সাথে মানিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। দীর্ঘ এক মনোলোগে এই সংকট তুলে ধরার অংশ প্রশংসা কুড়িয়েছে বেশ। প্রশংসা পেয়েছে পাবলিক স্কুলে বাইবেল পড়ানোকে কেন্দ্র করে তার দেয়া যুক্তিগুলোও।

গোটা ‘মিডনাইট ম্যাস’ জুড়ে ধর্মীয় আবহকে নিখুঁত করতে ব্যবহৃত হয়েছে পুরনো বিখ্যাত ধর্মীয় গান। স্কটিশ হেনরি ফ্রান্সিস লাইটের লেখা ‘অ্যাবাইড উইথ মি’ থেকে সেইন্ট জন হেনরি নিউম্যানের ‘লিড কাউন্ডলি লাইট’। কখনো ‘হোলি গড, উই প্রেইজ দাই নেইম’, আবার কখনো ‘নেয়ারার, মাই গড টু দি’। একটু পর পর ভেসে আসে হ্যারি চ্যাপিন, গর্ডন লাইটফুট, লিউনার্ড কোহেন এবং নেইল ডায়মন্ডের সুর। মুহূর্তের জন্য হরর পরিবেশ অন্যদিকে বাঁক নেয়। চার্চে ব্যবহৃত গানগুলোকে বেখাপ্পা লাগেনি মোটেও। বরং ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তার জন্য স্কোর কম্পোজার নিউটন ব্রাদার্স বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এদিকে বক্তব্যের ভেতরে বাইবেলের শ্লোক দেয়ার মুন্সিয়ানাও না বললে নয়, যা স্পষ্ট করেছে কীভাবে একটা ধর্মীয় কাল্ট শক্তি সঞ্চয় করে।

‘মিডনাইট ম্যাস’ অনেক পরে নির্মিত হলেও চিন্তাগুলো অনেক আগে থেকেই চলছিল। সেই সূত্রও ফেলে রাখতে দেখা যায় মাইকের পূর্ববর্তী কাজে। ২০১৬ সালে নির্মিত হয় হুশ। সেখানে ম্যাডি চরিত্রে ছিলেন কেট সিগ্যাল এবং সারাহ চরিত্রে সামান্থা স্লোয়ান। বধির লেখিকা ম্যাডি ‘মিডনাইট ম্যাস’ নামে উপন্যাস লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বান্ধবী সারাহ এসে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যায়।

রাইলিকে ভালোবেসে ফেলেছি। এরিনকেও। দারুণ চরিত্র তারা। অনুমান করার চেষ্টা করছি উপন্যাসের শেষটা।

২০১৬ সালেই হুশ মুভিতে ‘মিডনাইট ম্যাস’; Image Source: trendsmap.com

২০১৭ সালে নির্মিত ‘জেরল্ড’স গেম’ মুভিতেও দেখা যায় ইশারা। হাতকড়া পরা জেসি পায়ের কাছে কুকুরকে ছুড়ে দেয়ার জন্য উপরে শেলফে কিছু একটা হাতড়ায়। সেই মুহূর্তে দেখা মেলে ‘মিডনাইট ম্যাস’ উপন্যাসের।  

হরর মুভির নিয়মিত দর্শক কম। পুরস্কারের ক্ষেত্রেও হরর ঘরানাকে উপেক্ষা করা হয় প্রায়ই। ‘মিডনাইট ম্যাস’-এর উপর আগে থেকেই ভরসা ছিল অনেকের। পরিচালক যে দর্শকদের হতাশ করেনি, তার প্রমাণ প্রতিক্রিয়া। পুরস্কার না দেয়াতে খোদ এমি বোর্ডের সমালোচনায় মুখর ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যা-ই হোক, গতানুগতিক হরর ঘরানা থেকে মাইক ফ্ল্যানাগানের নির্মাণকে আলাদা করা যায় সহজেই। ‘মিডনাইট ম্যাস’ সেই তকমাকে আরো শক্তিশালী করল। একজন নির্মাতার জন্য এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী!

This Bengali article is about the religious horror miniseries named Midnight Mass, which is made by Mike Flanagan. All the references are hyperlinked below.
Featured Image: rottentomatoes.com 

Related Articles