ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হতে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এক দেশ বাংলাদেশ। দেশের উন্নয়নের অন্যতম ধারক রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু বিমানবন্দরের পাশেই রয়েছে আশকোনার বস্তি, যা আমাদের দেশের হতদরিদ্রদের চিত্রায়ন করে। সচেতন জনগণের মননে নির্মাণ করে উন্নয়ন আর অনুন্নয়নের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশের সিনেমার পর্দায় এরূপ দৃশ্যায়নের উপস্থিতি প্রায় বিরল বললেই চলে।
তেমনি এক প্রতিকূল লোকেশনকে তাঁর প্রতিভা প্রয়োগের স্থান হিসেবে বেছে নেন প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদ। অনুন্নয়নের চিত্র দেখানোর মাধ্যমে তিনি যে সাহসিকতা স্থাপন করেছেন, তা প্রতিটি শটেই নতুন রুপ পেয়েছে তাঁর নির্মিত ‘রানওয়ে’ (২০১০) সিনেমায়।
২০০৫-০৬ সালের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত ৯০ মিনিটের সিনেমা ‘রানওয়ে’। ২০০৮ সালের অক্টোবরে সিনেমার কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০০৯ সালের এপ্রিলে। তারেক মাসুদের সহধর্মিণী ক্যাথরিন মাসুদ প্রযোজিত ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে প্রথম মুক্তি পায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর বেতিলের স্বপ্নপুরী সিনেমা হলে। ‘রানওয়ে’ সিনেমার উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে।
আধুনিক প্রযুক্তির সিনে-আল্ট্রা ক্যামেরায় সিনেমার দৃশ্যায়ন ধারণ করেছেন তারেক মাসুদের অন্যতম সহকর্মী ও দীর্ঘদিন পথচলার অন্যতম সহযোদ্ধা, ‘রানওয়ে’ সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফার মিশুক মুনীর। ২০০৮ সালে সিনেমায় ব্যবহৃত উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরাটি আমদানি করা হয় আমেরিকা থেকে। এছাড়া সিনেমার সংগীতের কাজ ছিলো সমসাময়িক এবং গভীরতায় পরিপূর্ণ।
কাহিনী সংক্ষেপ
আপনি যদি তথাকথিত সিনেমার মতো করে নায়ক খুঁজতে চান, তাহলে এ সিনেমার নায়ক মাদ্রাসা থেকে ঝরে পড়া রুহুল নামের এক বেকার যুবক। যমুনার তীরে থাকা নিজেদের ভিটেমাটির জমি বিক্রি করে বাবা চলে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। তাই রুহুল তার মা, বোন আর দাদাকে নিয়ে থাকে ঢাকায় অবস্থিত তখনকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশে আশকোনার বস্তির এক ঝুপরি ঘরে।
মামার কম্পিউটারের সাইবার ক্যাফের দোকানে ছোটখাট কাজ করে সে। তার মা এনজিও থেকে লোন নিয়ে গরু কিনেছে। সে গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের খরচের একটা অংশ চালায়। তার দাদা বুড়ো হয়ে যাওয়ায় বিছানায় পড়ে থাকেন সবসময়। রুহুলের বোন কাজ করেন ঢাকার একটি গার্মেন্টসে। মধ্যপ্রাচ্যের খারাপ অবস্থার কারণে তার বাবার কোনো খোঁজ না থাকায় উদ্বিগ্ন থাকে তার পরিবার।
একদিন মামার কম্পিউটারের দোকানে ঘটনাক্রমে আরিফ নামের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় রুহুলের। সে তাকে দেখায় ইসলামের অন্যরকম এক পথ। ইসলামের শান্তির বার্তা কম্পিউটারে দেখানোর মধ্য দিয়ে আরিফ তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। আরিফ তাঁর দলের অন্যদের সাথে এবং লিডারের সাথে পরিচয় করিয়ে রুহুলের মনস্তাত্ত্বিক দিককে পাল্টে দেয়। ইসলামের নামে হিংস্র কর্মকাণ্ড করাকে তখন তাঁর কাছে মনে হয় জান্নাতে যাবার অন্যতম রাস্তা।
রুহুল চলে যায় বাংলাদেশে তখনকার সন্ত্রাসী উগ্র জঙ্গীদের ট্রেনিং ক্যাম্পে। তাদের উগ্র আদর্শের সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর। তাঁর বন্ধু আরিফ সিনেমা হলে বোমা মারার অপারেশনে গিয়ে আহত হন। দোকানে জঙ্গীদের কাজ চালানো হয়েছিলো বলে অভিযোগ করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় রুহুলের মামাকে। শেষে পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যাবার কারণে তারা গা ঢাকা দেয়। আলো আর অন্ধকার পথের তফাৎ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে রুহুল। ফিরে আসে তাঁর মা, বোন আর দাদার কাছে।
সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন ফজলুল হক, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রাবেয়া আক্তার মনি, নাজমুল হুদা বাচ্চু, মোসলেম উদ্দিন, আলী আহসান, নাসরিন আক্তার, রিকিতা নন্দিনী শিমু প্রমুখ। বিশেষ চরিত্রে ছিলেন নুসরাত ইমরোজ তিশা।
ফিতায় ফিতায় বাস্তবতা
বাস্তবতা আর প্রতীকের এক অদ্ভুত মিশ্রণে শুরু হয় সিনেমার প্রথম দৃশ্যটি। আলো আঁধারে মিশে থাকা রাত-দিনের সন্ধিক্ষণে দুনিয়া কাঁপিয়ে এক দৈত্যের চিৎকার নিয়ে আকাশে উড়ে আসে প্লেন। নামবে বিমানবন্দরে। সে আওয়াজে আর বাতাসে প্লেনের চাপের ফলে রানওয়ের পাশে থাকা একটি ঝুপরি ঘরের বেড়াসহ ঘরের মলিন তৈজসপত্র, পানির জগ, রোগের পথ্য ঔষধ এবং পানির গ্লাস বয়স্ক এক বৃদ্ধের মতো থরথর করে কাঁপতে থাকে। সেইসাথে আচমকা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এক বৃদ্ধ। পাশ থেকে টিনের মগটা তুলে নিয়ে টিনের গ্লাসে করে ঢকঢক করে পানি পান করেন। মাইকে তখন ফজরের আযান ভেসে আসে। শুরু হয় নতুন দিন।
তারেক মাসুদ তাঁর সিনেমার প্রথম শটটিতেই দেখিয়েছেন আমাদের চলমান সমাজে উন্নয়নের ধারকগুলো যেন কাঁপিয়ে দেয় আমাদের মলিন হতে থাকা নিচু শ্রেণীর প্রতিনিধিদের। কিংবা উন্নয়নের চিত্র কতটুকু সত্য তা দর্শকের কাছে ছুড়ে দেয়া এক প্রশ্ন। সদা আসতে থাকা হুমকির ভয়ে তৃষ্ণায় পানি পান করেন কাঁপতে থাকা দলিতরা। আরও একটি নতুন দিন শুরু হচ্ছে, যা তাদের জন্য আগের দিনগুলোর মতোই অবহেলা আর বঞ্চনায় ভরা হয়তো।
সকালটা বাড়তে থাকে, আর বাড়তে থাকে তাদের কর্মব্যস্ততার চিত্র। রুহুলের বোন কাজ করে গার্মেন্টসে। তার গার্মেন্টসে যাবার দৃশ্য দেখানো হয় বিশেষ এক বার্তা দেয়ার মাধ্যমে। প্রথমে তার বোন, তারপর বোনের বান্ধবী, তারপর আরও দুজন, তারপর আরও। তারা কোথায় যাচ্ছে? গার্মেন্টসে। দেশের কর্মজীবী মহিলাদের বেশিরভাগ অংশ যে গার্মেন্টসে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এর চেয়ে চমৎকারভাবে হয়তো দেখানো হয়নি আর।
মজুতদার আর সুদের কারবার করা নরপশুদের বেসাতি ছড়ানো ইংরেজদের সময়েই বিদায় নিলেও আজও তা ভিন্ন রূপে টিকে আছে সমাজে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের পুরো ব্যাপারটি হয়তো তারেক মাসুদ এ সিনেমায় বিশদ আকারে দেখানোর সুযোগ পাননি। কিন্তু গাভী, রুহুলের মা আর গাভীর বাছুরের দৃশ্য দিয়ে প্রতীকীভাবে বুঝিয়েছেন বর্তমানের নানা অজানা রহস্য। আপনি গাভী থেকে তারই দুধ নিয়ে নিজে হবেন স্বাবলম্বী, শেষে সামান্য রাখবেন সেই গাভীর বাছুরটির জন্য। এতেই সন্তুষ্ট হবে সেই গাভী। অল্পতেই তুষ্ট আমরা। রাঘব বোয়ালরা দেশ ফাঁকা করে দিলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। আবার বাছুর যেমন তার অধিকার আদায় করতে আসলে তাকে বলা হয় ‘পাজি’; তেমনি ‘পাজি’ বলা হয় সচেতনভাবে আওয়াজ তুলতে চাওয়া ব্যক্তিদের।
রুহুলের মামার দোকানে বিদেশে কর্মরত এক বাংলাদেশীর সাথে ফোনে কথা বলে তার আত্মীয়। তাকে দেশে টাকা পাঠাতে বলা হয়। তার টাকা পাঠানোর উপর নির্ভর করছে তার সেই আত্মীয়ের পরিবারের পরিকল্পনা। আমাদের দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে কাজ করা মানুষেরা সেখানে থাকা অবস্থায় তার পরিবার কী ধরনের চাপ পেয়ে থাকেন তা এত ক্ষুদ্রভাবে না দেখিয়ে আরও বিশদ আকারে চিত্রায়নের দাবি রাখে।
রিকশা করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে রুহুল। হুট করেই রিকশার সামনে থাকা প্রাইভেট কার থেমে যাওয়াতে রিকশা গিয়ে আঘাত করে প্রাইভেট কারের পেছনে। গাড়ি থেকে নেমে আসেন সমাজের উঁচুশ্রেণীর একজন প্রতিনিধি। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তিনি রুহুলকে আঘাত করেন। রক্ত বের হয় তার মুখ থেকে। যদিও তার দোষ ছিলো না। এমনকি রিকশাচালকেরও দোষ ছিলো না।
এরপর যে দৃশ্য দেখানো হয়, তা হয়তো রূপক হিসেবে ব্যবহারের জন্য সেরা একটি উদাহরণ। বিমান উড়ে যাচ্ছে ভূমি থেকে বেশ উপরে, সুদূর আকাশে। সেখানে তার নেই কোনো বাধা। এমনিভাবে দুর্বলকে পিটিয়ে, ঠকিয়ে, স্বচ্ছন্দে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে উড়ে বেড়ায় সবলেরা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তারা হাসের মতো করে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেন। স্বচ্ছন্দে চলতে থাকেন ঝামেলাহীন পথে।
কিন্তু তাদেরকে এত আরামে থাকতে দিয়ে চায় না দুর্বলেরা। সরাসরি এই সবলদের স্বচ্ছন্দে আঘাত হানতে না পারলেও তাদের ভেতরে থাকা প্রতিবাদের ভাষা ফুটে ওঠে বিভিন্ন রুপে। বিমান আকাশে উড়ছে এমন দৃশ্যের পর দেখানো হয় একটি ছোট্ট ছেলে গুলতি দিয়ে সেই বিমান তাক করে হাতের গুলতি ছুঁড়ে দিচ্ছে। তার চেহারায় হতাশা আর প্রতিবাদ করতে না পারার চিহ্ন।
এ সিনেমাতে আরিফ এবং তার সাবেক স্ত্রীর আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে আমাদের সিনেমার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনার সুযোগ মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু বিশদ পরিসরে আলাপ করা হয়তো হয়ে ওঠেনি। তবে মানুষের শিখতে থাকা আদর্শের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব থাকে, তা খানিক হলেও বোঝাতে পেরেছেন পরিচালক।
রাশিয়ায় যখন সেখানকার রাজারূপী জারদের অনিয়ম, বঞ্চনা আর নির্যাতনের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছিলো, যখন তাদের দেশে জারদের পতনের পরেও চলছিলো অনিয়ম, তখন সেদেশের মানুষদের পরিচয় করানো হয় প্রতিবাদের সাথে। দেখানো হয় ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’(১৯২৫) নামের এক অনন্যসাধারণ সিনেমা, যা তাদের মননে প্রতিবাদের বীজ বুনে দেয়।
কিন্তু আমাদের দেশে গার্মেন্টস কর্মীদের সাথে অনিয়ম করা হলেও তাদের মধ্যে নির্মাণ করা হয় না প্রতিবাদের মানসপট। তাদেরকে বিনোদনে বুঁদ করে রাখা হয়, যাতে করে তারা প্রতিবাদ করতে ভুলে যান। তাদেরকে বলা হয় ‘কিছু কিছু মানুষেরর জীবনে, ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’ কিংবা কোনো অবহেলিত নারীর অবাস্তব প্রতিশোধের চিত্র।
এদেশে জঙ্গিদের কর্মকান্ডকে দেখানোর ক্ষেত্রে পরিচালক যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। একটি হতাশাগ্রস্থ ভালো মনের, ভালো ছেলেকে কী করে দ্রুত উগ্রতার দিকে নেয়া যাওয়া হয় তার চিত্র দেখিয়েছেন তিনি। এতকিছুর পরেও পরিচালক সফলতার আশা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, রুহুলরা সবাই মারা যায় না। তাদের অনেকেই ফিরে আসে পরিবারের কাছে। অনেকেই ফিরে এসে দেখতে চায় তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া ছোট্ট জলের ধারাকে, দেখতে চায় গাছে গাছে প্রজাপতির খেলা। সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকা হাঁস কিংবা মুরগীর দলকে।
রুহুল তার মনের সাথে সংঘাতে ইতিবাচকের দিকে ফিরে চলে আসে বাড়িতে। তার আসার পর মা তাকে দুধ দিয়ে গোসল করান। পরিশুদ্ধ করতে চান তার সন্তানকে। পরিচালক ফিরে পেতে চেয়েছেন আমাদের বিলীন হতে থাকা ঐতিহ্যকে। যেভাবে বিলীন হতে থাকা রুহুল ফিরে এসেছে তার মায়ের কাছে। শেষদিকে নির্মাতা আরও সফলতার বীজ বুনেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশীরা তাদের কঠিন সমস্যা থেকে বেঁচে ফিরে আসবে তাদের কাছের মানুষের কাছে। যেমনটা ফিরে এসেছে রুহুলের বাবা। দৃশ্যটি বাস্তব ভাববেন নাকি কল্পনা? এ ধারণা করার ইচ্ছেটা সম্পূর্ণ দর্শকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন তারেক মাসুদ।
সিনেমাটির গান নির্বাচন এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে দেখা গেছে কেমন যেন আমাদের গ্রামীণ এক টান। হাজার বছর ধরে গাইতে থাকা আমাদের ইতিহাসের অন্যতম ঐতিহ্য পুঁথির সাথে এর সুর মিলে যায় যেন। তারেক মাসুদ তার অন্যান্য সিনেমার মতো এখানেও আমাদের গ্রামীণ হারাতে থাকা মাটির টান নিয়ে এসেছেন। আর তার সহকারী মিশুক মুনীর বরাবরের মতো ক্যামেরার পেছনে ছিলেন অনবদ্য।