![](https://assets.roar.media/assets/gg41Z7IFXfGddJNt_p17072578_b_h6_ac-678x381.jpg?w=1200)
গত কয়েক বছর ধরেই হলিউড ছাড়াও টিভি নেটওয়ার্ক এবং স্ট্রীমিং সার্ভিসগুলো আমাদেরকে একের পর এক ইসরায়েলি চলচ্চিত্র এবং সিরিয়াল উপহার দিয়ে আসছে। “দ্য স্পাই”, “দ্য এঞ্জেল”, “অপারেশন ফিনালে”, “দ্য রেড সী ডাইভিং রিসর্ট”, “ফাউদা”, “সেভেন ডেজ ইন এনতেবে”… এই তালিকার শেষ নেই। গুণগত মানের দিক থেকে যেমনই হোক না কেন, কিংবা সত্য ঘটনাকে যত বেশি বিকৃত করুক না কেন, এগুলো নিয়ে গণমাধ্যমের মাতামাতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে নেটফ্লিক্সের “দ্য স্পাই” ওয়েব সিরিজটা নিয়ে।
কিন্তু সেই তুলনায় প্রায় একই সময়ে এইচবিও চ্যানেলে প্রচারিত আরেকটি ইসরায়েলি টিভি সিরিজ “আওয়ার বয়েজ” (Our Boys) নিয়ে বলতে গেলে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি। রটেন টমাটোজ ওয়েব সাইটে যেখানে দ্য স্পাইয়ের রিভিউ দিয়েছেন ৩৯ জন সমালোচক, সেখানে আওয়ার বয়েজের রিভিউ দিয়েছেন মাত্র ১৩ জন সমালোচক।
![](https://assets.roar.media/assets/PRli2FgvMQ0NwiOT_our-boys-featured.jpg)
কেন এই বৈষম্য? অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যে কারণটা সবচেয়ে প্রকটভাবে চোখে পড়ে, সেটা হচ্ছে দুই সিরিয়ালের মূল ম্যাসেজের মধ্যকার পার্থক্য। দ্য স্পাইসহ সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত অধিকাংশ সিনেমা এবং টিভি সিরিজের বিষয়বস্তু যেখানে ইসরায়েলি গোয়েন্দাসংস্থা মোসাদের এজেন্টদের সাফল্য, শ্রেষ্ঠত্ব এবং মহত্ত্ব, সেখানে দ্য বয়েজের বিষয়বস্তু হচ্ছে দখলকৃত জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক, নিপীড়নমূলক, শোষণমূলক আচরণ। সঙ্গত কারণেই পশ্চিমা গণমাধ্যমে এ ধরনের নির্মাণ খুব বেশি ফোকাস পাওয়ার কথা না।
আওয়ার বয়েজ সিরিয়ালটাও ইসরায়েলিদের দ্বারাই নির্মিত। এর তিন নির্মাতার মধ্যে দুজন ইহুদী এবং একজন আরব-ইসরায়েলি। কিন্তু তারপরেও এটা ইসরায়েলিদের অনেকেরই পছন্দ হয়নি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি এর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চ্যানেল-১২-কে ফেক চ্যানেল বলে দাবি করেছেন এবং একে অ্যান্টি-সেমেটিক ট্যাগ দিয়ে বয়কটের দাবি জানিয়েছেন।
![](https://assets.roar.media/assets/A9w8ATLoEgXXpXUg_CreditRan-Mendelson-HBO.jpg)
আওয়ার বয়েজ টিভি সিরিজটির কাহিনী নির্মিত হয়েছে সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের কিছু সদস্য তিন ইসরায়েলি কিশোরকে অপহরণ করে এই আশায় যে, তারা তাদের মুক্তিপণ হিসেবে ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসন বন্ধ করতে পারবে এবং প্রতিবাদ মিছিল থেকে আটককৃত হাজার হাজার নিরপরাধ বন্দীর মুক্তির জন্য দেন দরবার করতে পারবে। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তারা তিন কিশোরকে হত্যা করে।
ইসরায়েলি কিশোরদের অপহরণের সংবাদের সাথে সাথেই ইসরায়েল বিশাল অপারেশন শুরু করে। পরবর্তী দিনগুলোতে ইসরায়েল ৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে এবং আরো ৮০০ জনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এর কয়দিন পরেই যখন তিন আল্ট্রা অর্থোডক্স ইহুদী কিশোর মিলে মোহাম্মদ আবু খেদির নামের পূর্ব জেরুজালেমের এক ফিলিস্তিনি কিশোরকে কিডন্যাপ করে এবং নৃশংসভাবে হত্যা করে, তখন ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া হয় সম্পূর্ণ বিপরীত।
![](https://assets.roar.media/assets/S91PNUvgyIeZCZGV_cq5dam.web.1200.675-%281%29.jpeg)
ইসরায়েলি প্রশাসন শুরু থেকেই প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগকে পাত্তা না দিয়ে অপহরণের পেছনে ইহুদী সেটলারদের পরিবর্তে আরবদের উপর দোষ খোঁজার চেষ্টা করতে থাকে, মোহাম্মদ আবু খেদিরের বাবা আবু আইয়্যাদকে তদন্তের নামে আটকে রেখে হয়রানি করতে থাকে এবং ইহুদীদেরকে নিষ্পাপ প্রমাণের জন্য পাল্টা ভিক্টিমের এবং তার ফ্যামিলির বিভিন্ন দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। এমনকি মোহাম্মদ আবু খেদিরের লাশ পাওয়ার পরেও এবং ইহুদীদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পরেও তারা তদন্তকে রাজনৈতিক খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে।
প্রতিক্রিয়ায় জেরুজালেমের বিক্ষুব্ধ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। শুরু হয় ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিনিদের ৫০ দিন ব্যাপী দীর্ঘ সংঘর্ষ। হামাসও গাজা থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ শুরু করে। ইসরায়েল পাল্টা গাজায় বিশাল অভিযান শুরু করে। তবে জাতিসংঘ, ইইউ, আমেরিকার নিন্দায় এবং আন্তর্জাতিক চাপে শেষপর্যন্ত ইসরায়েলিরা বাধ্য হয় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদেরকে গ্রেপ্তার এবং বিচার করতে।
![](https://assets.roar.media/assets/pgNFLTFvQJQsAnFH_Jony-Arbid_Cred_RanMendelson2.jpg)
১০ পর্বের এই মিনি সিরিজের প্রথম পর্বে তিন ইসরায়েলি কিশোরের অপহরণের কাহিনী দেখানো হলেও পরবর্তী পর্বগুলোতে উঠে এসেছে মোহাম্মদ আবু খেদির অপহরণের ঘটনা, তাদের পরিবারের বিচারের দাবি এবং ইসরায়েলি প্রশাসনের বৈষম্যমূলক আচরণের চিত্রগুলো। একইসাথে উঠে এসেছে ইসরায়েলের রেসিজম, আরবদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা, এবং তাদের মধ্যকার ধর্মীয় উগ্রপন্থার কিছু দৃশ্য, যা সাধারণত খুব কমই গণমাধ্যমে ঠাঁই পায়।
সিরিয়ালের ভাষা আরবি এবং হিব্রু। এর প্রধান চরিত্র একদিকে মোহাম্মদ আবু খেদিরের বাবা আবু আইয়্যাদ এবং অন্যদিকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শাবাকের ইহুদী বিভাগের পরিচালক সিমন। সিমন চরিত্রটি মূলত কাল্পনিক। এই তদন্তের দায়িত্বে থাকা একাধিক শাবাক কর্মকর্তার সমন্বয়ে চরিত্রটিকে তৈরি করা হয়েছে। সিমনের দক্ষতা এবং আন্তরিকতায়ই শেষপর্যন্ত মোহাম্মদ আবু খেদিরের খুনিরা ধরা পড়ে।
![](https://assets.roar.media/assets/EOipaCmpgOiHuccG_merlin_159475698_6c86927b-ad7b-4580-9f79-e3c7f60dcea2-superJumbo.jpg)
![](https://assets.roar.media/assets/w9gxUJgi916804T3_Ammar-Awad-Reuters.jpg)
সিরিয়ালে ইসরায়েলের অ্যাপার্টহায়েড চরিত্রটা পরিষ্কারভাবেই উঠে এসেছে। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে অরিজিনাল ফুটেজ এবং নিউজ ক্লিপের ব্যবহার সিরিয়ালটিকে আরো জীবন্ত করে তুলেছে। মোহাম্মদ আবু খেদিরের মা সুহা সিরিয়ালটি দেখে মন্তব্য করেছেন, এটি তার স্মৃতিতে সেই দিনগুলোকে ফিরিয়ে এনেছে। তার মনে হচ্ছিল, স্ক্রিনের ভেতরে প্রবেশ করে যদি তিনি তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে পারতেন।
কিন্তু ফিলিস্তিনিদের এবং সমালোচকদের কাছে প্রশংসনীয় হলেও ইসরায়েলিরা এই সিরিয়ালকে মোটেও পছন্দ করেনি। নির্মাতারা সিরিয়ালটার শ্যূটিং করেছেন অত্যন্ত গোপনে। প্রচার শুরু হওয়ার পর তারা ইহুদীদের কাছ থেকে একাধিকবার হুমকি পেয়েছেন। সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত (রটেন টমাটোজে ৯২% ফ্রেশ) হওয়া সত্ত্বেও ইন্টারনেটে IMDB সহ চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যে সিরিয়ালটার রেটিং খুবই কম (আইএমডিবিতে 6.8), ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে কারণে তার পেছনে সংঘবদ্ধ এবং পরিকল্পিত প্রচেষ্টা কাজ করেছে।
![](https://assets.roar.media/assets/1Hl3q7TwualUOE26_The-co-creators-of-%E2%80%9COur-Boys%2C%E2%80%9D-from-left%2C-Hagai-Levi%2C-Tawfik-Abu-Wael-and-Joseph-Cedar.jpg)
সিরিয়ালটির প্রথম পর্ব দর্শকদের কাছে একটু ধীরগতির মনে হতে পারে। কিন্তু পরবর্তী পর্বগুলো ড্রামা হওয়া সত্ত্বেও যেকোনো পলিটিক্যাল থ্রিলারকে হার মানায়। বিশেষ করে শাবাকের পরিচালক সিমন যখন ছদ্মবেশে ইহুদীদের উপাসনালয়ে গিয়ে কিডন্যাপারদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করে, সেই দৃশ্যগুলো দেখলে সিরিয়ালটিকে স্পাই থ্রিলার বলে ভ্রম হতে পারে। শাবাকের গোয়েন্দা কার্যক্রম, তাদের ফেস রিকগনিশন সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহারও সিরিয়ালটির আকর্ষণীয় কিছু দিক।
হলিউডে কিংবা নেটফ্লিক্সেই ইসরায়েলিদের অন্যায় এবং ফিলিস্তিনিদের উপর তাদের শোষণমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরা চলচ্চিত্র বা সিরিয়াল খুব বেশি দেখা যায় না। সেদিক থেকে এই সিরিয়ালটা বেশ ব্যতিক্রম। বামধারার ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজের মতে, এটি সারা বিশ্বের সামনে ইসরায়েলের চরিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে। সিরিয়ালপ্রেমীদের সবারই তাই ভিন্নধর্মী এই সিরিয়ালটি দেখা উচিত।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি: