ক্যাপারনিয়াম নামের লেবানিজ এই সিনেমাটি শুরু হয় জেলখানায় বন্দী ১২ বছর বয়সী বালক জেইনকে দেখানোর মধ্য দিয়ে। ১২ বছর বয়সটা অবশ্য জেলখানার চিকিৎসকদের অনুমান। তার প্রকৃত বয়স বা জন্ম তারিখ কেউ জানে না। কারণ তার বাবা-মা এতই দরিদ্র যে, অর্থের অভাবে তারা তার জন্মের রেজিস্ট্রেশনই করাতে পারেননি। আর তার ভাইবোনের সংখ্যাও এত বেশি যে, তার বাবা-মায়ের পক্ষে কার জন্ম কত সালে, সেটাও মনে রাখা সম্ভব হয়নি।
জেইনকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন বিচারকের সাথে তার কথোপকথনের মাধ্যমে জানা যায়, কিছুদিন আগে কোনো এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাতে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। বিচারক যখন জানতে চান জেইন তার শাস্তির কারণ হিসেবে অবগত আছে কিনা, বিন্দুমাত্র অনুতপ্তের বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে সে উত্তর দেয়, এক ‘কুত্তার বাচ্চাকে’ হত্যাচেষ্টার কারণে!
তবে এবার জেইন আদালতে হাজির হয়েছে ভিন্ন একটি কারণে। এবার সে নিজেই পাল্টা মামলা দায়ের করতে চায় তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে। আদালতে তার বাবা-মায়ের উপস্থিতিতেই বৃদ্ধ বিচারক যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন কেন সে তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে চায়, দৃঢ় কণ্ঠে জেইন উত্তর দেয়, “আমাকে জন্ম দেওয়ার জন্য!”
ক্যাপারনিয়াম শব্দটি (আরবি এবং হিব্রুতে কাফার নাহুম, হিব্রুতে অর্থ নাহুম গ্রাম) মূলত বর্তমান ইসরায়েলের একটি প্রাচীন শহরের নাম, বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী যে শহরটিকে যীশু খ্রিস্ট অভিশপ্ত নরকে পরিণত করেছিলেন। কালের আবর্তনে শব্দটি ‘বিশৃঙ্খলা’ শব্দের প্রতিশব্দে রূপান্তরিত হয়েছে।
সিনেমাটি দেখতে শুরু করার পর বুঝতে খুব বেশি দেরি হয় না, কেন সিনেমাটির এই অদ্ভুত নামকরণ করা হয়েছে। ফ্ল্যাশব্যাকে যখন বৈরুতের একটি ঘিঞ্জি বস্তিতে জেইন এবং তার পরিবারের জীবনযাপনের চিত্র উঠে আসতে থাকে, তখনই দর্শকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠতে বাধ্য যে, তাদের জীবন, তাদের বাসস্থানই মূলত ক্যাপারনিয়ামের নরক।
জেইনের বয়স ১২ বছর হলেও, দেখতে তাকে আরও ছোট বলে মনে হয়। কিন্তু তার ঘাড়ে এসে পড়া রাজ্যের দায়িত্ব যেন তাকে পরিণত বয়সী এক যুবকের মতোই দায়িত্বশীল করে তুলেছে। দারিদ্রের কষাঘাত থেকে বাঁচতে প্রতিদিন সকালে তাকে ভাইবোনদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় কাজ করার জন্য।
বাড়িওয়ালার দোকানে মালপত্র আনা-নেওয়া করা, রাস্তায় শরবত বিক্রি করা, এমনকি অবৈধভাবে ড্রাগ পাচার করাসহ এমন কোনো কাজ নেই, যা তাকে করতে হয় না। আর এর ফাঁকে ফাঁকে তাকে আগলে রাখতে হয় তার ছোট ভাই-বোনদেরকে। বিশেষ করে তার আদরের ছোটবোন সাহারকে, যাকে বাড়িওয়ালার ছেলে আসাদ প্রায়ই জ্বালাতন করার চেষ্টা করে।
এই ১১ বছর বয়সী সাহারকেই যখন একদিন তার বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় আসাদের সাথে, তখন জেইনের জীবন যেন মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বাড়িঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে সে। এলোমেলোভাবে ঘোরার পর এক অ্যামিউজমেন্ট পার্কে গিয়ে সে আশ্রয় খুঁজে পায় এক ইথিওপিয়ান নারী, রাহিলের কাছে। পরিচয়পত্রহীন অবৈধ অভিবাসী রাহিল তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় তার বিবাহ বহির্ভূত শিশুপুত্র ইউনেসকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য, যাকে কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়া রাহিলের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
রাহিলের বাসায় ইউনুসের সাথে জেইনের বন্ধুত্বপূর্ণ দিন অতিবাহিত হতে থাকে। কিন্তু কয়দিন পরে সেই রাহিলই যখন হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায়, তখন ইউনেসকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে জেইন। ইউনুসকে সাথে করে সে বৈরুতের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে রাহিলের খোঁজে। চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলোর চরিত্রের মতো বিশাল এক শহরের রাস্তায় রাস্তায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য এগিয়ে যেতে থাকে জেইনের জীবন।
সিনেমার শেষের দিকে একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন জেইন ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, তখন আমরা জানতে পারি সে কাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল এবং কেনই বা সে তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সিনেমার শেষের দিকের অনেকগুলো দৃশ্য অনেক কঠিন হৃদয়ের দর্শকের হৃদয়কেও দ্রবীভূত করতে বাধ্য। ক্যাপারনিয়াম নিঃসন্দেহে ২০১৮ সালের সেরা সিনেমাগুলোর একটি। একইসাথে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম ইমোশনাল সিনেমা।
ক্যাপারনিয়াম চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন লেবানিজ পরিচালক এবং অভিনেত্রী নাদিন লাবাকি। শুধু পরিচালনাই না, জেইনের উকিলের চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি। একইসাথে অন্য দুজন চিত্রনাট্যকারের সাথে মিলে এর চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন তিনি। দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যের জন্য গবেষণা করার স্বার্থে নাদিন লাবাকি এবং তার দলকে বারবার ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল লেবাননের বস্তিগুলোতে এবং অবৈধ অভিবাসীদের ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে।
নাদিন লাবাকি এর আগে আরও Caramel এবং Where Do We Go Now? নামে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেগুলোও প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু তার এই কাজটি ছাড়িয়ে গেছে শুধু তার অতীতের সব কাজকেই নয়, বরং সাম্প্রতিক সময়ের আরব বিশ্বের অন্য সকল কাজকেও।
সিনেমাটি শুধু অস্কারে বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ক্যাটাগরিতেই নমিনেশন পায়নি, এটি একইসাথে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানজনক জুরি পুরস্কারসহ আরও দুটি পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। কান উৎসবে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হওয়ার পর উপস্থিত দর্শকরা দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে চলচ্চিত্রটিকে সম্মান জানিয়েছেন।
নাদিন লাবাকির সবচেয়ে বড় সাফল্য অপেশাদার কলাকুশলীদের কাছ থেকে তাদের সেরা অভিনয়টুকু আদায় করে নিতে পারা। সিনেমাটির অভিনয় শিল্পীদের কেউ জীবনে কখনও ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি। জেইন চরিত্রে অভিনয় করা কিশোর জেইন আল-রাফিয়াকে কাস্টিং ডাইরেক্টর খুঁজে বের করেছেন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা এক শরণার্থী শিবির থেকে। একইভাবে রাহিল চরিত্রে অভিনয় করা ইওরদানোস শিফরাও সত্যি সত্যিই একজন ইথিওপিয়ান অবৈধ অভিবাসী। হয়ত বাস্তবেই দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার কারণেই তারা সিনেমার দুর্দশাময় জীবনকে সহজে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।
ক্যাপেরনিয়াম সিনেমাটির কাহিনী কাল্পনিক, কিন্তু এটি যে একাধিক বিচ্ছিন্ন চরিত্রের সমন্বয়ে গঠিত, সেরকম চরিত্রের প্রায় সবগুলোই পরিচালক নাদিনের বাস্তব পরিচিত। প্রায় প্রতিটি ঘটনা নাদিন তার গবেষণার সময় প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সেগুলোকে একত্রিত করেই তিনি এবং তার দল চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। কাল্পনিক কাহিনী হয়েও তাই ক্যাপারনিয়াম সমাজের বাস্তব সমস্যাকেই তুলে ধরছে। নাদিন লাবাকির মতে, জেইন যখন তার বাবা-মা’র বিরুদ্ধে মামলা করে, তখন বাস্তবে সে সমাজের অবিচারের বিরুদ্ধেই মামলা করে।
ক্যাপারনিয়াম চলচ্চিত্রটি দর্শক এবং সমালোচক উভয় গোষ্ঠীর কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। IMDB-তে সিনেমাটির বর্তমান রেটিং ৮.৪। অন্যদিকে রটেন টম্যাটোস ওয়েবসাইটে সমালোচকদের দৃষ্টিতে এটি ৮৮% ফ্রেশ। বিভিন্ন সমালোচক একে বিখ্যাত ইতালিয়ান পরিচালক ভিট্টোরিও ডি সিকার বাইসাইকেল থিভ্স, শুশাইন, শন বেকারের দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট, গার্থ ডেভিসের লায়নসহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রের সাথে তুলনা করেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের রিভিউতে বলেছে, ক্যাপারনিয়াম শুধু একটি চলচ্চিত্র না, এটি সচেতনতা সৃষ্টির উদাত্ত আহ্বান।
দারিদ্র্য কিংবা দুঃখ-দুর্দশাকে চলচ্চিত্রায়নের ব্যাপারে সব সময় একটা ঝুঁকি থাকে যে, তা ‘পোভার্টি পর্ন’ হিসেবে সমালোচনার মুখে পড়তে পারে। পোভার্টি পর্ন বলতে সে ধরনের চলচ্চিত্র বা অন্যান্য সৃজনশীল কর্মকেই বোঝানো হয়, যেখানে দারিদ্র্যকে ব্যবহার করা হয় ভোক্তার সহানুভূতি আদায় করার উদ্দেশ্য। এটা নির্মাতাদের জন্য উভয় সংকট। দারিদ্র্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন না করলে তা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে, আবার মাত্রাতিরিক্ত আবেগের ব্যবহার করলে তা সমালোচিত হবে। কিন্তু এই দুইয়ের মাঝখানে যে সূক্ষ্ম ব্যবধানের সেতু, নাদিন লাবাকি অত্যন্ত সফলভাবে তার উপর দিয়ে হেঁটে পার হতে পেরেছেন।
সিনেমাটি সম্পর্কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাদিন লাবাকি নিজেই বলেন, কোনো সমালোচক যদি এরকম সমালোচনা করেই, তবে তার উচিত হবে যে ক্যাফেতে বসে তিনি সমালোচনাটি লিখেছেন, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব জগতের দিকে তাকানো। কারণ নাদিনের মতে, সিনেমাতে তিনি যা দেখিয়েছেন, বাস্তব জীবনের দুর্দশার তুলনায় সেটা কিছুই না।