বব ডিলান-মার্টিন স্করসেজি জুটির কথা জানতে পারার দেরি শুধু, দেখার দুর্দমনীয় ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে স্বভাবতই। স্বীয় ক্ষেত্রে কিংবা শিল্পে অবিসংবাদিত এই দুই মাস্টার একে অপরের ক্ষেত্রকে, তাদের নিজেদের ক্ষেত্রের সাথে নিগমবদ্ধ করেছেন বারবার। ডিলান তার গানে প্রায়ই সিনেম্যাটিক ধাঁচে গল্প বয়ান করেন। অপরদিকে সঙ্গীত ছাড়া স্করসেজির সিনেমার পূর্ণতাপ্রাপ্তিই হয় না। এবং সেটা শুধুমাত্র আবহসঙ্গীতের ব্যবহারেই নয়, বরং সম্পাদনার ছন্দে ও সামগ্রিক বাতাবরণে। স্করসেজি যেভাবে পেরেছেন, সেভাবে আর কোনো ফিল্মমেকারই বোধহয় ‘সিনেমা এবং সঙ্গীত’, দু’টি ভিন্ন শিল্পের মাঝে এমন সাযুজ্য ঘটাতে পারেননি।
খেয়ালে নাড়া দিয়ে ‘মিন স্ট্রিটস’, ‘গুডফেলাস’ সিনেমাগুলোয় ‘দ্য স্টোনস’ ব্যান্ডের গানগুলো যে উপায়ে স্করসেজি ব্যবহার করেছেন, তা ভাবতে গেলেই শিহরণ জেগে উঠবে যেকোনো সঙ্গীতপ্রেমীর মনে। আবার সঙ্গীত নিয়ে রক ব্যান্ড ‘দ্য ব্যান্ড’ এর ‘দ্য লাস্ট ওয়াল্টজ’, জর্জ হ্যারিসনকে ঘিরে ‘লিভিং ইন আ ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড’ এর মতো অনবদ্য ডকুমেন্টারিগুলো দেখলেই অনুধাবন করতে পারা যায়, শুধু সিনেমা নয়, সঙ্গীতের জ্ঞানেও স্করসেজি কতটুকু সমৃদ্ধ।
এবং স্করসেজির সঙ্গীতনির্ভর ডকুমেন্টারিগুলো যে তার ফিকশনাল কাজের মতোই শক্তিশালী হতে পারে, তার আরো একটি উদাহারণ বব ডিলানকে নিয়ে একদমই সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া ‘রোলিং থান্ডার রেভিউ’। বব ডিলানকে নিয়ে এবারই প্রথম কাজ করেননি স্করসেজি। এর আগে ‘নো ডিরেকশন হোম’ ডকুমেন্টারিতে, প্রথমদিককার সময়ে গ্রিনউইচ ভিলেজে লোকসঙ্গীত গায়ক ডিলানের বিশৃঙ্খল ঘুরে বেড়ানো এবং অবশেষে খ্যাতির চূড়ায় পদার্পণ করার গোটা চিত্র বর্ণিত হয়েছিল।
আর এবারের রোলিং থান্ডার রেভিউতে স্করসেজি দর্শককে নিয়ে গেছেন ১৯৭৫ সালে। আমেরিকার জন্য সুখকর সময় সেটি ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষত, তারউপর ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি গোটা আমেরিকাকে রীতিমতো দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল। ক্ষত শুকোনোর জন্য দরকার ছিল তখন ঐশ্বরিক কোনো মনোবলের। ঘাঁ ভালো করার ব্রত নিয়েই যেন এলেন ‘মি. টেম্বৌরিন ম্যান’ (বব ডিলান)।
ডিলানের জন্যও রূপান্তরিত একটি সময় চলছিল তখন। ধারা বদলে ইলেকট্রনিক সঙ্গীতে বড় বড় স্টেডিয়ামগুলোতে সাফল্য পাওয়ায় ডিলান ছোট ছোট ভেন্যুতে তার কণ্ঠ আরো বেশি হার্জে ছড়িয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেন। শ্রোতাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে ময়ূরের পালক খচিত টুপি মাথায় চড়িয়ে, মুখে মাস্ক পরে কিংবা কখনো কখনো সাদা রঙ সারা মুখে লাগিয়ে (ডিলান বলেন, ব্যান্ডদল ‘কিস’ এর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ মুখে সাদা রঙ পেইন্ট করেছেন তিনি) ডিলান; জোয়ান বায়েজ, ভায়োলিনিস্ট স্কারলেট রিভেরা, গিটারিস্ট মিক রনসন’কে বেরিয়ে পড়েন ‘রোলিং থান্ডার রেভিউ’ ট্যুরে। ১৯৭৫-১৯৭৬, এই সময়কালে ডিলান এবং তার দল ৫৭’টি কনসার্ট করেছেন গোটা আমেরিকার ছোট ছোট ভেন্যুগুলোতে।
ডিলানকে যখন প্রশ্ন করা হয়, এই প্লাস্টিকের মুখোশের আড়ালে তিনি কী লুকোচ্ছেন? ডিলান সোজাসাপ্টা উত্তর দেন, “কিছুই না। যখন তুমি একটা মুখোশ পরে থাকবে, শুধুমাত্র তখনই সত্যটা তুমি বলবে।” ডকুমেন্টারির ট্যাগলাইনের মাঝেই একটা ইঙ্গিত রয়েছে। ট্যাগলাইনে ‘দ্য বব ডিলান স্টোরি’ বলে স্পষ্টতা না বুঝিয়ে বরং খানিকটা দ্ব্যর্থবোধকতা রাখা হয়েছে ‘আ বব ডিলান স্টোরি’ বলে। ডকুটিতে নন-ফিকশনের ধাঁচ খানিকটা পাল্টে দিয়েছেন স্করসেজি, ফিকশনাল ন্যারেটিভ যোগ করে। ডকুমেন্টারির প্রচলিত সংজ্ঞাকে ফিকশন আর নন-ফিকশনের মাঝে ধূসর করে রোলিং থান্ডার রেভিউ’কে সুডো-ডকুমেন্টারির রূপ দিয়েছেন স্করসেজি।
ডকুমেন্টারিতে মূল দায়িত্বটা তিনি পালন করেছেন সম্পাদক হিসেবে। ১৯৭৫ সালের সেই ট্যুরে শ্যুট করা সিনেমা ‘রেনাল্ডো এন্ড ক্লেরা’-র কনসার্টের আর্কাইভ ফুটেজকে একরকম পুনরুদ্ধার করছেন স্করসেজি। সেইসাথে র্যাম্বলিন জ্যাক এলিয়ট, রজার ম্যাকগুইন, জনি মিশেলদের নতুন ইন্টার্ভিউ যোগ করে ফ্যাক্ট এবং ফিকশনের মাঝে একটা আমুদে ভাব নিয়ে এসেছেন স্করসেজি। ডিলান সেই সময়টায় তার নতুন এক অ্যালবাম ‘ডিজায়ার’ নিয়ে কাজ করছিলেন।
তখনকার ৩৪ বছর বয়সী এই মানুষটি ‘নকিং অন হেভেন’স ডোর’, ‘ওয়ান মোর কাপ অফ কফি’ দিয়ে যেমন শ্রোতাদের মন মাতাচ্ছিলেন, তেমনি রেকর্ডিং চলাকালীন ‘ডিজায়ার’ অ্যালবামের প্রতিবাদী গান ‘হারিকেন’ দিয়ে মুষ্টিযোদ্ধা রুবিন হারিকেন কার্টারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া খুনের মিথ্যা মামলা নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন সে গানের লিরিক আর তার শক্তিশালী গায়কী দিয়ে। তার গায়কী আগের চেয়েও আরো বলিষ্ঠ তখন, আরো স্পষ্ট। অন্যদিকে সে সময়টায় স্করসেজি ব্যস্ত ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ দিয়ে তার অগ্নিঝরা বক্তব্যে বিপ্লব আনতে।
দুই ক্ষেত্রে দু’জনের সেই প্রতিবাদের সম্মোহনী ক্ষমতা ফুটেজগুলোতে অনুধাবন করতে পারা যায় সচেতন মানসপটে। অপরদিকে, ব্যাকস্টেজে জোয়ান বায়াজের সাথে ডিলানের ক্ষণিকের নিবদ্ধ দৃষ্টি, মৃদু হাসির সংক্ষিপ্ত মুহূর্তগুলো প্রতিবাদের উত্তাপে খানিক ভালোবাসার আবেশ ছুঁইয়ে দেয়। এই সংক্ষিপ্তগুলো মুহূর্তগুলো (যা ধার করা হয়েছে পূর্বের ‘রেনাল্ডো অ্যান্ড ক্লেরা’ সিনেমা থেকে) কোনো অংশেই রোমান্টিক সিনেমার চেয়ে কম অন্তরঙ্গতা রাখে না।
রোলিং থান্ডার রেভিউ’র গল্প মাঝে মাঝে প্রবীণ ডিলান বর্ণনা করলেও মূল ন্যারেটিভ গড়ে দিয়েছে কনসার্টে অংশগ্রহণকারী ভিন্ন ভিন্ন শ্রোতাদের সাক্ষাৎকার। স্করসেজির এ সিদ্ধান্ত চমৎকৃত হওয়ার মতোই একটি সিদ্ধান্ত। ছোট ছোট এই সাক্ষাৎকারগুলো ফ্রেইসের মতো করে সাজালে তা স্করসেজির এই ন্যারেটিভের সর্বজ্ঞতার দিকটি প্রকাশ করে এবং কনসার্টের উন্মত্ততা’কে আরো রঙিন করে তোলে। সেইসাথে ফিকশনের ব্যাপারটা আরো ধাতস্থ হয়ে ওঠে এর মাধ্যমে। ফিকশনাল ন্যারেটিভের আরো নিদর্শন পাওয়া যায় বিভিন্ন জনের সাক্ষাৎকারে। এই ট্যুরের সাথে অনেকের সংযোগসূত্র খুব একটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, দ্ব্যর্থবোধকই থেকে গেছে।
শ্যারন স্টোনের কথাই ধরা যাক। ডিলানের সাথে তার দেখা হওয়ার বিবরণ এবং তার জন্য ডিলান একটি গানও রচনা করেছেন, এমন দাবি অতিরঞ্জিতই মনে হয়। ফিকশনাল ন্যারেটিভের বিষয়টি আরো মাথাচাড়া দেয়, যখন প্রবীণ ডিলানের কিছু কথায়ও দ্বান্দ্বিকতা ভেসে ওঠে। গভীরে গেলে দেখা যায়, কিছু ব্যক্তি, নিজেদের যে পরিচয়ে পরিচিত করেছেন ডকুর শুরুতে, সেখানটায়ও একটা ‘কিন্তু’ আছে। ন্যারেটিভে স্করসেজির এই ধূর্ততা প্রশংসনীয় বটে। সেইসাথে একইসময়ে ফিকশন আর নন-ফিকশনের এই নিখুঁত ভারসাম্য অবাক করে দেয়। এমনকি ডকুমেন্টারি শেষেও দর্শক ভাবতে বাধ্য হয়, আসলে কোন অংশটি সত্য, আর কোনটি গপ্পো! এবং তখনই ট্যাগলাইনটা আরেকবার মনে করিয়ে দিতে হয়, আ বব ডিলান স্টোরি।
নিখুঁত সম্পাদনার পাশাপাশি স্করসেজির ভিজ্যুয়াল মাস্টারির দিকটিও লক্ষণীয় এ ডকুমেন্টারিতে। স্করসেজি শুধু ‘রেনাল্ডো অ্যান্ড ক্লেরা’র ফুটেজই ব্যবহার করেননি, ‘চিল্ড্রেন অভ প্যারাডাইজ’ সিনেমার মতো বিশ্ব সিনেমার ভাণ্ডার থেকে আরো দারুণ কিছু সিনেমার ফুটেজ ব্যবহার করেছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে। কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সাক্ষাৎকারের বলিষ্ঠ ফুটেজগুলো দেখে বুঝতে পারা যায়, শব্দের জাদুকর চেনায় ইঞ্চি পরিমাণ ভুলও স্করসেজির হয়নি। ট্যুর চলাকালীন এবং ট্যুর শেষে উভয় অংশেই গিন্সবার্গের সাক্ষাৎকারগুলোতে, তার অতুলনীয় বাগ্মিতা এবং বুদ্ধিদীপ্ততা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে গোটা ডকুতে। সমাপ্তি অংশে, সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দেওয়া সেই ‘ফেয়ারওয়েল স্পিচ’ দর্শককে উদ্বুদ্ধ করে শিল্পময় এক যাত্রায় বেরিয়ে পড়তে।
তবে একথা বলতেই হয়, বব ডিলানের গান এই গোটা সফরকে এক সুতোয় ধরে রেখেছে। ফেইস পেইন্টিং যেমন তাকে ভিন্ন এক রূপ দিয়েছে, তেমনি ‘ওয়ান মোর কাপ অফ কফি’ গানে রিভেরার উপজাতিদের মতো মেকাপ, ভায়োলিনের বিলাপ আর ডিলানের কাঁপা কণ্ঠস্বর গানটির মাঝে আরো গভীরতা এনে দেওয়ার পাশাপাশি আবেগপ্রবণতা থেকে তার নিজের বিচ্ছিন্নতাকে আরো ভারি করে তুলছিল দর্শকের চোখে। ইলেকট্রিক সঙ্গীতে রথবদল করে ডিলান শুধু দর্শকদের নয়, নিজের গানগুলোকেও পরীক্ষা করছিলেন- এমন সূক্ষ্ম একটা প্রতিধ্বনিকে পুরোটা সময়ে ভাসমান করে তোলেন স্করসেজি। চমৎকার সুর, ফিকশন ও নন-ফিকশনের শক্তিশালী সংমিশ্রণকে একচ্ছত্র করে কাব্যিক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন তিনি। সেইসাথে সূক্ষ্ম অ-সামাজিক বক্তব্যের দিকটি স্করসেজির নিজের সেই তারুণ্যের সময়কারই প্রতিফলন যেন।
এক বাক্যে, রোলিং থান্ডার রেভিউ’কে বিশেষায়িত করা যায়, আংশিক ট্যুর ডায়েরি এবং আংশিক ট্রিকস্টার হ্যান্ডবুক বলে। শেষত, ডিলানকে যখন এ ট্যুর সম্বন্ধে তার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করতে বলা হয়, তখন ডিলান বলেন, কিছুই তার মনে নেই। কিছুই না। সব শুধু ছাই এখন। এবং জীবন সম্বন্ধে কষ্টে অর্জিত ধীশক্তির প্রমাণও পাওয়া যায় ডিলানের ওই উক্তিতে,
“জীবন মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া নয়। অন্যকিছু খুঁজে পাওয়াও নয়। নিজেকে সৃষ্টি করার মানেই জীবন।”