সময়টা ২০১০; ইথিওপিয়ার উত্তরে ওয়েলো ওপাল খনির ঘটনা, হীরার খনি। প্রারম্ভিক দৃশ্যের ট্র্যাকিং শটে ফুটে উঠা হীরার সম্মোহনী ক্ষমতায় ঘায়েল হয়ে পড়ে দর্শকচোখ। চকিতেই পরিষ্কার বোধ জাগে, কেন অন্যান্য প্রাকৃতিক পদার্থ থেকে শক্ত এই পাথরকে ঘিরে মানুষের এত উন্মাদনা? কিন্তু মূল্যবান এই রত্ন একবার ছুঁয়ে দেখার আশায় ঝরতে পারে প্রাণ, এতটাই বিধ্বংসী এই রত্ন। এবং প্রারম্ভিক এই দৃশ্যেই হীরার ঔজ্জ্বল্যে সম্মোহন জাগানোর পাশাপাশি খনি হতে হীরা উত্তোলনের প্রক্রিয়া কতটা বিপদজনক সেই সম্বন্ধে সুস্পষ্টভাবে ওয়াকিবহাল রাখা হয় আমাদের।
ছোট্ট এই খনিজের গাত্রে জড়িয়ে আছে যতটা অপার সৌন্দর্য, ততটাই বিপদসংকুল ছায়া। সেই ছায়া ‘ব্ল্যাক ওপাল’ এর ভেতরকার রূপকে আমাদের চোখে আরো কাছ থেকে কাছে আনতে আনতে কাট করে চলে যায় হাসপাতালের মনিটরে। এবং এই দৃশ্যেই প্রথম সিনেমার প্রধান চরিত্র হাওয়ার্ড র্যাটনারের সাথে পরিচিত হই আমরা। তবে তা হাওয়ার্ডের পায়ুপথের ভেতরকার চিত্র মনিটরে দেখানোর আগ অব্দি নয়। (ডার্ক কমেডির সূক্ষ্ম আভাস পাওয়া যায় এই দৃশ্যটিতে।)
কোলনস্কপি (পায়ুপথের একটি পরীক্ষা) করতে এসেছে হাওয়ার্ড। হাসপাতালের মনিটরের এই চিত্র ওপালের ভেতরের খাঁজসমূহের চিত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আসল ওপাল যেন হাওয়ার্ডের ভেতরেই আছে, রূপকতায় তেমনটাই আমাদের বলে এই দৃশ্য। হাওয়ার্ডের এই উন্মত্ততা একেবারে শিকড় থেকে এসেছে। শত বৎসর ধরে হীরার প্রতি মানুষের উন্মত্ত আকর্ষণের ইতিহাস থেকে এসেছে।
খনির ঘটনা থেকে গল্প আমাদের নিয়ে যায় ২০১২ সালে। ম্যানহাটনের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ এভিনিউয়ের মাঝে অবস্থিত ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্টে। সিনেমার মূল গল্প এই ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্ট থেকেই শুরু। এই ডিস্ট্রিক্টেই দোকান হাওয়ার্ডের। ছোট্ট, আবদ্ধ পরিবেশের মাঝে তার অবস্থান। হাওয়ার্ড পেশায় জহুরি। জুয়ার প্রতি আছে তার ভয়ানক আসক্তি। পাক্কা জুয়াড়ি সে। ধীরতা বলতে কোনো কিছু তার অভিধানে নেই। এই ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্টের এদিক-ওদিকে সর্বদাই ছুটে বেড়াতে দেখা যায় হাওয়ার্ডকে।
‘বিপদ’ শব্দটা তো স্বভাবতই যে কারো মাঝে দুশ্চিন্তার উদ্রেক ঘটাবে। কিন্তু হাওয়ার্ডের নিজস্ব অভিধানে এই বিপদ শব্দটা যেন আশীর্বাদের অর্থ বহন করে। স্বেচ্ছায় নিজেকে ধ্ধংসের মুখে ঠেলে দেয় সে। বাজি জেতা অসম্ভব, এমন বাজিতে টাকা লাগায় হাওয়ার্ড। নিজের স্বভাবের মতো টাকার ক্ষেত্রেও ধীরতার নীতির অস্তিত্ব নেই হাওয়ার্ডের কাছে। মহাজনের টাকা দালালের কাছে, দালালের টাকা জুয়াতে- এভাবে এখানের টাকা ওখানে, ওখানের টাকা সেখানে লাগিয়ে ক্রমাগত টাকার স্রোত ধরে রাখছে হাওয়ার্ড। এমন স্বভাবের জন্যই দেখতে দেখতে সুদের সাগর বানিয়েছে। আর সাগরের সেই পানিতে রক্তের গন্ধ পেয়ে পাগলের মতো তেড়ে আসছে সুদখোর হাঙ্গরেরা।
গোটা ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্টের কাছেই যেন দেনা আছে হাওয়ার্ডের। দেনাদাররা রীতিমতো নরক বানিয়ে ছাড়ছে তার জীবনকে। নরকের আগুনের আঁচ আরো বাড়িয়ে দিতে তার জীর্ণ বৈবাহিক জীবন তো আছেই। তবে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সব ঠিক করে তোলার মতোই ব্ল্যাক ওপাল নামক এক জাদুর কাঠি হাতে পায় সে। ইথিওপিয়ার কালো বাজার থেকে নানা ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে এই ওপাল হাতে পেয়েছে হাওয়ার্ড। খাঁটি জহুরি খাঁটি হীরা চিনে তো নেবেই। হাওয়ার্ড ব্ল্যাক ওপালটি হাতে নিয়ে চিনতে পেরে তো সাত রাজার ধন হাতে পাওয়ার মতোন উল্লাস শুরু করেছে। এই হীরার সম্মোহনে আটকে যায় হাওয়ার্ড। তাই তো সকল ধার-দেনা এই মূল্যবান রত্নটি শোধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে জেনেও হাওয়ার্ড নিজের কাছেই রাখতে চায় ওপালটি। এবং হাওয়ার্ডের এই চাওয়া পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে।
নিস্তার পাওয়ার সরু গলি সরু হতে হতে অদৃশ্যই হয়ে গেছে এবার। গোটা ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্ট কোমরে গোঁজা পিস্তল হাতে নিয়ে কিংবা শার্টের আস্তিন গুটিয়ে যেভাবেই পারছে তেড়ে আসছে হাওয়ার্ডের উদ্দেশ্যে। পাওনা টাকা বুঝে পেতেই হবে, তা প্রাণ দিয়ে হোক কিংবা কেড়ে নিয়েই হোক।
পরিচালক জোশ এবং বেনি সফদির এই কাজে দুটো বিষয় বেশ স্পষ্ট চোখে পড়ে। একটি হলো ‘হাসলিং’, প্রচলিত বাংলায় হৈ-চৈ, তাড়াহুড়ো, ধস্তাধস্তি যা-ই বলি না কেন আমরা। এই হাসলিংকে শৈলী মিশিয়ে উপস্থাপন করতে সফদি ব্রাদার্স উন্মুখ হয়ে থাকে বরাবরই। তাদের ‘হেভেন নৌজ হোয়াট’ (২০১৪) সিনেমায় যেমন প্রধান চরিত্রের উপর সামাজিক ম্যানিপুলেশনের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, তেমনই ‘গুড টাইমস’ (২০১৭) সিনেমায়ও দেখা যায়, একটি সারা সন্ধ্যাবেলা গোটা নিউ ইয়র্কে এপ্রান্ত থেকে ও’প্রান্তে এক ভাই মরিয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় আরেক ভাইকে জেল থেকে বের করবে বলে।
এই দুটো সিনেমার দুটো চরিত্রই সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের কাছে এই হাসলিং কোনো দক্ষতা নয়, বরং বেঁচে থাকার একটি অস্ত্র। এবং এই শ্রেণীর সেই ‘মরিয়া’ স্বভাবকেই পরিচালক সফদি ব্রাদার্স তাদের স্টাইল তৈরিতে ব্যবহার করেন (যার নেপথ্য কারণ হিসেবে রয়েছে, ছেলেবেলায় তাদের নিজ বাবা-মায়ের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনার মানসিক সেই আঘাত)।
আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো- ঐ হাসলিং থেকে জন্ম নেওয়া বেদনা। একটা প্রগাঢ় দুঃখ, বেদনা বয়ে বেড়ায় সফদি ব্রাদার্সের চরিত্ররা। সেই বেদনা চেপে রেখে ছুটে বেড়ায় অবিরাম তারা। এবং সেই বেদনা নিয়ে লড়তে গিয়েই স্বার্থপর হয় তারা। স্বার্থপরতা আর অহম চারপাশ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের। ‘গুড টাইমস’ সিনেমার সেই কনি চরিত্রটিকেই যদি দেখা হয়, কনির নিজ গন্ডিতে পা রাখা একজন মানুষও নেই যাকে কনি স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেনি। নতুন এই সিনেমা ‘আনকাট জেমস’ হলো এই দুটি বিষয়েরই সবচেয়ে বিশুদ্ধ পাতন। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এই দুটো বিষয়কেই নিজের মাঝে ধারণ করে এই সিনেমার হাওয়ার্ড চরিত্রটি।
হাসলার তো সে আদ্যোপান্তই। তড়িৎ এবং উচ্চস্বরে কথা বলায় দারুণ পারদর্শী হাওয়ার্ড। এবং তার এই কথার প্যাঁচে জড়িয়ে যেকোনো প্রকারের মধ্যস্থতায় রাজি হয়ে যায় অপরপক্ষের লোকজন। নানাজনের সাথে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে যে টোপগুলো সামনেরজনের উদ্দেশ্যে হাওয়ার্ড ফেলে, তাতেই বোঝা হয়ে যায় এই লাইনে খেলার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা হাওয়ার্ডের আছে।
বাস্কেটবল খেলোয়াড কেভিন গার্নেট (যিনি এই সিনেমায় স্ব-চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত হলেও, সিনেমার গল্প ২০১২ সালের কয়েকটি দিনের বৃত্তে, যখন তিনি অবসর গ্রহণ করেননি।) এর সাথে ঐ দৃশ্যটির কথাই ধরা যাক। গার্নেট বিশ্বাস করে এই ব্ল্যাক ওপাল তার সৌভাগ্যের প্রতীক। চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে সেই ওপাল তাই গার্নেট সাথে রাখতে চায়। হাওয়ার্ড, গার্নেটের সাথে মধ্যস্থতা করে তার চ্যাম্পিয়নশিপ রিংটি নিজের কাছে গচ্ছিত রেখে ওপালটি কিছু সময়ের জন্য গার্নেটকে দেয়। এবং পরমুহূর্তেই ওই রিং নগদ টাকায় বিনিময় করে বাস্কেটবল খেলায় বাজি ধরে হাওয়ার্ড। হাওয়ার্ডের সেই জুয়াড়ি স্বভাব আর হাসলিংয়ে পারদর্শিতার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই দৃশ্যটি। তবে তার এই সিদ্ধান্তের ফলাফল আরো সুদূরপ্রসারী, সিনেমার গল্প এগিয়ে চলার সাথে সাথে যার গভীরে যেতে থাকি আমরা।
ধূর্ত, দ্রুতভাষী, উচ্চকন্ঠী হাওয়ার্ড চরিত্রে অ্যাডাম স্যান্ডলার তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ (তর্কসাপেক্ষে) কিংবা অন্যতম শ্রেষ্ঠ (নির্দ্বিধায়) অভিনয় করেছেন। একবার ফিরে দেখা যাক, ‘পাঞ্চ ড্রাংক লাভ’ (২০০২) সিনেমার দিকে। ওই সিনেমাতেই কমিক পারসোনা আগাগোড়া ঝেড়ে সর্বপ্রথম কোনো গুরুগম্ভীর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে স্যান্ডলারকে। সেই সিনেমায় অফিসে বিচলিত হয়ে পায়চারি করার সেই দৃশ্যটির কথা মনে করতে গেলে অবসাদগ্রস্ত স্যান্ডলারের মুখাবয়ব মনে ফুটিয়ে তোলাটা দুরূহ কিছু নয়। সেই দৃশ্যের কথা আসছে, কারণ ‘আনকাট জেমস’-এ ঐ অবসাদ নিয়েই সর্বক্ষণ দৌড়ে বেড়াতে দেখা যায় স্যান্ডলারের হাওয়ার্ড চরিত্রটিকে।
হাওয়ার্ডের কোনো কিছু ঘটানোর প্রবৃত্তি দমন করতে না পারা, বারবার ভুল সিদ্ধান্তের বেড়াজালে নিজেকে আটকে ফেলার দৃশ্যগুলোই সিনেমায় ড্রামাটিক কোণ তৈরি করে দিয়েছে এবং কৌতুকাবহের সৃষ্টি করেছে। এবং এই চরিত্রটিকে রূপায়ন করতে গিয়ে স্যান্ডলার শরীরী অভিনয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশ। অভিনয়ের শারীরিক ভাষাকে ব্যবহার করে ‘হাওয়ার্ড’ চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। সেই সাথে বিভিন্ন মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে স্যান্ডলারের আতংকিত হয়ে পড়া, অনিশ্চয়তায় ভোগার দৃশ্যগুলো এই চরিত্রটির প্রতি আমাদের সহমর্মিতা জাগিয়ে তোলে।
রোনাল্ড ব্রনস্টেইন এবং সফদি ব্রাদার্সের সম্মিলিত লেখনীর এই চিত্রনাট্য খুবই গভীর ক্যারেক্টার স্টাডি হয়ে ওঠার পাশাপাশি পুঁজিবাদ এবং লালসা দ্বারা পরিচালিত এই সমাজের দিকে তর্জনী তাক করে কড়া বিদ্রুপাত্মক বক্তব্যও রাখে। এবং খানিকটা শেক্সপিয়রীয়ান ট্র্যাজেডির ভাবও পাওয়া যায় চিত্রনাট্যে। প্রধান চরিত্রের তাড়াহুড়ো, অস্থিরতা, বদ্ধ পরিবেশকে যথাযথভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে ‘দ্যারিয়াস খোন্দজি’র সিনেমাটোগ্রাফিতে ক্লোজআপ শটের আধিক্যে হাওয়ার্ডের আশপাশের দুনিয়াকে ক্লস্ট্রোফোবিক করে তুলেছেন সফদি ব্রাদার্স, পূর্বেকার ‘গুড টাইমস’ সিনেমার মতো।
স্যাচুরেটেড নিয়ন আলোয় সিনেমাটোগ্রাফার খোন্দজি নিউ ইয়র্ককে এক জীবিত নরকের রূপ দিয়েছেন। তবে বরাবরের মতোই সফদি ব্রাদার্স তাদের সিনেমার নিউ ইয়র্ককে সেই ‘৭০ দশকের মতো করে তৈরি করেছেন। সিনেমার আমেজে একটা জীর্ণশীর্ণ ভাবের উপস্থিতি রয়েছে। আর আবহসঙ্গীতে ইলেকট্রনিক স্কোরের ব্যবহার উত্তেজনাকে আরো চড়িয়ে দিয়েছে।
সিনেমার গোটা সময়জুড়ে দর্শকের মাঝে উত্তেজনাকে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করায় হাত তো ইতোমধ্যেই পাকিয়ে ফেলেছেন সফদি ব্রাদার্স এবং তার সর্বাপেক্ষা সুনিপুণ উদাহারণ হয়ে থাকতে চলেছে ‘আনকাট জেমস’। সিনেমার শেষ অংকে হাওয়ার্ডের প্রতিটি ভুল সিদ্ধান্তে ভর দিয়ে উত্তেজনার পারদকে চরমে তুলে আমাদের হৃৎপিন্ডের স্পন্দনকে রীতিমতো ঘোড়ার দৌড়ের গতিতে ছুটিয়েছেন সফদি ব্রাদার্স। এবং ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো সমাপ্তি-দৃশ্যে শান্তি যখন অবশেষে নেমে আসে তা যথেষ্ট হৃদয় বিদারক হয়েই ধরা দেয়। এবং সমাপ্তি দৃশ্যটি আরেকবার নিশ্চিত করে যায়- চটকদার, দুঃসাহসী থ্রিল রাইডে কতটা সহজাত উপায়ে খাঁটি মানবিক বিরহগাঁথা উপহার দিতে পারেন এই পরিচালক ভ্রাতৃদ্বয়। নিঃসন্দেহে ২০১৯ এর সবচেয়ে এনার্জেটিক ও উত্তেজনাপূর্ণ সিনেমা ‘আনকাট জেমস’।