ফ্রেন্ডস টেলিভিশন শো একটি আবেগের নাম, একটি ভালবাসার নাম। জনপ্রিয়তার বিচারে পশ্চিমা সিটকম (সিচুয়েশন কমেডি) সংস্কৃতির ইতিহাসে যে কয়েকটি টিভি শো’র আবেদন সময়ের ব্যবধানে কখনো মলিন হয়নি, তাদের মধ্যে অবশ্যই এই কমেডি ঘরানার সিরিজটি প্রথম দিকেই থাকবে। তবে আজকের এই আয়োজন ফ্রেন্ডস টিভি সিরিজের জনপ্রিয়তার কোনো ব্যবচ্ছেদ নিয়ে নয়। আজকের লেখায় জনপ্রিয় এই টিভি শো’টিকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে একটু ভিন্নভাবে।
তবে মার্কিন লেখক ও ছোটগল্পকার ডেভিড হপকিনসের লেখায় এই সিরিজের ভিন্নধর্মী এবং নেতিবাচক কিছু প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। আর আমাদের আজকের এই লেখাটি তারই একটি ফিচার থেকে সরাসরি অনুপ্রাণিত। তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এই শো’র প্রেক্ষাপটকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। লেখাটি এই টিভি শো’র প্রতি লেখকের ‘ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি’ সমর্থন করে না।
৯০’র দশকের মার্কিন পপ কালচারের একজন ভক্ত হয়ে থাকলে আমাদের কারোরই এই টিভি সিরিজের কথা অজানা থাকার কথা নয়। ১৯৯৪ সালে শুরু হওয়া এই সিরিজ শেষ হয় ২০০৪ সালে। প্রায় পুরো এক দশক ধরেই প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবারের প্রধান আকর্ষণ ছিল এই শো’র পর্ব। মার্কিন দর্শকদের কাছে ফ্রেন্ডসের প্রতিটি পর্ব দেখার বিষয়টি ছিল অনেকটা মোহের মতো, ঠিক এক অবাধ আকর্ষণের মতো।
মজার বিষয় হলো, তখনকার মার্কিন পপ কালচারের প্রতি জনগণের চাহিদাটা ঠিক যেমন ছিল, এই টিভি সিরিজের প্রতিটি চরিত্রের রূপায়ন করাও হয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে। একদল যুবক-যুবতী, সবাই মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি, সবাই শ্বেতাঙ্গ এবং সর্বোপরি সবচরিত্রই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু এই চরিত্রগুলোর যে পারিপার্শ্বিকতা আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাকে এড়িয়ে যায়, সেই বিষয়গুলো হচ্ছে- এই চরিত্রগুলো একই সাথে নৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ‘মসৃণ এবং গ্রহণযোগ্য’।
ফ্রেন্ডস টিভি শো পুরোপুরি একটি পারিবারিক গল্প। এই সিরিজের নায়ক (প্রোটাগনিস্ট) রস গেলার একজন পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ এবং তিনি তার পরিবারকে ভালবাসেন। তিনি বিজ্ঞানের মানুষ। কিন্তু তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কখনোই তার এই ‘বিজ্ঞানপ্রিয়তা’ সমর্থন করেনি। ব্যক্তিগত নানা কারণে ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে ওঠা রসকে আমরা পুরো সিরিজে কখনোই তার নিজের জগৎ কিংবা আত্মসম্মান বোধ থেকে বিচ্যুত হতে দেখা যায় না। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা রস চরিত্রটি কখনোই তার নিজের গণ্ডি বা সীমাবদ্ধতার উপরে উঠতে পারেনি।
ফ্রেন্ডস শো’কে সাধারণ বিশ্লেষণে পুরোপুরি কমেডি ঘরানার সিরিজ হিসেবে মনে হলেও ডেভিড হপকিনস এই বিষয়টি মানতে বেশ নারাজ! তিনি এই সিরিজকে ‘সনাতন মার্কিন অবুদ্ধিবৃত্তীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেখানে রসের মতো হাজারো রস গেলার শুধুমাত্র পরিবেশের অভাবে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির যথার্থ পরিস্ফুটন ঘটাতে পারেন না। হপকিনস এই সিরিজের আবহ হাসির শব্দের বিষয়েও কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন-
এই শো এর নকল হাসির শব্দ আপনার ‘স্বাভাবিক হাসি’কে নিরুৎসাহিত করবে। এই শব্দ অহেতুক এবং মজার মুহূর্তগুলোর প্রতি আমাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
হপকিনস এই সিরিজের আবহ সঙ্গীতের সমালোচনা থেকেও বিরত হননি। তিনি বলেন, এই আবহ সঙ্গীত অবশ্যই জীবনের প্রতি এক ‘নেতিবাচক ধারণা’র জন্ম দেয়। সবসময়ের হাসি-তামাশা এবং ঠাট্টার বাইরেও জীবনে উদযাপন করার মতো অনেক উপাদান আছে। জীবনে যদি উন্নতির করার কোনো চেষ্টা না করা হয় তবে সেই জীবন কোনো অর্থ বহন করে না। মানুষের জীবনে অবশ্যই বন্ধুবান্ধবের দরকার রয়েছে। কিন্তু তারা শুধু সবসময় হাসি কিংবা ঠাট্টা করার জন্য নয় বরং আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে আরও উন্নত এবং সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেন তারা। হপকিনস বলেন,
এই সিরিজের প্রতিটি চরিত্রই আদতে অসম্পূর্ণ, কেননা জীবন যুদ্ধের বিপরীত চিত্রগুলো এই চরিত্রগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয় নি।
বোকা জয়ী, ব্যঙ্গপ্রিয় চ্যান্ডলার, নিয়ন্ত্রণপ্রিয় মনিকা, স্বাধীন ফিবি এবং এক শপিংপ্রিয় র্যাচেল! আবার এই চরিত্রগুলোর বিপরীত বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে সাজানো হয়েছে রস চরিত্রটি। রস গেলার একধারে বুদ্ধিজীবী মার্কিন সমাজ এবং সংস্কৃতির এক আদর্শ প্রতিনিধি।
সঙ্গত কারণেই এই ছয়টি চরিত্রের মধ্যে ফ্রেন্ডস সিরিজের প্রায় ৫৩ মিলিয়ন দর্শক শেষ পর্যন্ত রস গেলারকেই নায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই সিরিজের প্রথম পর্ব থেকেই অন্য চরিত্রগুলো এবং রস চরিত্রটির মধ্যে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক পার্থক্য’ বেশ সুস্পষ্ট।
রস গেলার যখনই তার ক্যারিয়ারের সাফল্য বা তার স্বপ্নের কথা বন্ধুদের বলেন, ঠিক তখনি তাদের পক্ষ থেকে এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া যায়। জয়ী হোক কিংবা চ্যান্ডলার অথবা অন্য কোনো চরিত্র। পুরো সিরিজের প্রথম থেকে একদম শেষ পর্যন্ত রস গেলার এবং তার বন্ধুদের মধ্যে এই বুদ্ধিবৃত্তিক পার্থক্যের বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে ভাবলেই আমাদের সামনে উঠে আসে।
ঠিক গ্রিক ট্র্যাজেডির মতোই এই শো’য়ের রস গেলারের ভবিষ্যৎ কি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিলো? বুদ্ধিদীপ্ত মার্কিন যুবসম্প্রদায়ের প্রতীক রস গেলার কি র্যাচেল থেকে যোগ্য কোনো জীবনসঙ্গী পেতে পারতেন না? নাকি এই টিভি সিরিজের প্রযোজকদল এই বিষয়টি শুরু থেকেই এক প্রকার ঠিকই করে রেখেছিলেন যে রসের মতো শিক্ষিত, কেতাবি বিদ্যাপ্রাপ্ত কোনো মার্কিন পুরুষ তার চারিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন জীবন সঙ্গিনীর বদলে অন্তিম মুহূর্তে র্যাচেলের মতোই কোন আড়ম্বরপূর্ণ মেয়েকেই বেছে নেবেন? এই প্রসঙ্গে হপকিনস বলেন-
রস গেলার অবশ্যই র্যাচেল থেকে আরও ভালো কোনো জীবন সঙ্গিনীর যোগ্য ছিলেন। কিন্তু রস তার গণ্ডি বা বৃত্তের বাইরে কখনোই আসতে পারেননি। এটাই হয়তো রস গেলার চরিত্রের নিয়তি বা ‘ট্র্যাজিক ফ্ল’ হিসেবে নির্ধারিত ছিল।
ডেভিড হপকিনস ৯০’র দশকের ক্ষয়িষ্ণু মার্কিন পপ সংস্কৃতির জন্য পরোক্ষভাবে এই টিভি সিরিজকে দায়ী করেছেন। অনেকের কাছেই বিষয়টি নিছকই মজা বা পাগলামি মনে হতে পারে, কিন্তু হপকিনসের বিশ্লেষণী যুক্তিগুলো ফেলে দেবার মতো নয়। যুক্তি হিসেবে তিনি প্রথমেই এই সিরিজের পাইলট এপিসোডের সেই বিখ্যাত “It’s the End of the World as We Know It (And I Feel Fine)” গানের প্রতি আঙ্গুল তুলেছেন। জীবনের প্রতি শুভ কোনো ইঙ্গিতের বদলে কোনো সিরিজের আবহ সঙ্গীত যদি আমাদের প্রথমেই নেতিবাচক ইঙ্গিত প্রদান করে, হপকিনস সেই টিভি সিরিজকে স্বাগত জানাতে নারাজ।
ডেভিড হপকিনস ২০০৪ সালের দিকে একটি মার্কিন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। কাজেই ঐ সময়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের আচরণগত বিষয়গুলোর উপর তিনি বেশ ভালভাবেই নজর দিয়েছেন। উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীরা এই টিভি সিরিজের মাধ্যমে ঠিক কতটা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, তিনি সেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
একবিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর দিকে টিভি সংস্কৃতির মহাবিস্ফোরণের ফলে উঠতি শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশই তাদের নিজেদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টিই ভুলতে শুরু করে। পড়ালেখার বদলে স্কুল প্রাঙ্গণে মাস্তানি, টিভিতে দেখা চাকচিক্যের প্রতি অনেকের নজর চলে যায়। সেই সময়টায় শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশের এরূপ আচরণগত পরিবর্তনের উৎস হিসেবে হপকিনস এই টিভি সিরিজ এবং সংশ্লিষ্ট মার্কিন পপ সংস্কৃতির অধঃপতনকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কাঠগড়ায় তুলেছেন।
ফ্রেন্ডস টিভি শো হয়তো মার্কিন জীবনের এক নিরাপদ হাসি-ঠাট্টার উৎস হতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য পূরণে এই টেলিভিশন সিরিজ মোটেই ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু ফ্রেন্ডস টেলিভিশন শো যে শুধু অল্পবিস্তর কোনো হাসি বা ঠাট্টার উৎসের বাইরেও মার্কিন সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
ফিচার ইমেজ- Youtube