মালায়লাম সিনেমা মানেই যেন বৈচিত্র্য, নতুনত্ব আর শিল্পের মিশেল। বিগত দশকে উপমহাদেশের খুব কম চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিই একই সাথে এত শৈল্পিক ও ব্যবসাসফল হতে পেরেছে। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর বিস্তারের পর মালায়লাম সিনেমায় যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। পরিচালক, প্রযোজকরা এমন অনেক সিনেমা বানানোর সাহস পেয়েছেন যেগুলো হয়তো সিনেমাহলে মুক্তি পেত না বা পেলেও সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হতো। তেমন কিছু সিনেমা হলো মালিক, ইরুল, কুরুথি, চুরুলি ইত্যাদি। এ সকল সিনেমাই নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমের মতো জায়ান্ট প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছিল।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, গত বছরের অন্যতম আলোচিত সিনেমা দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন-কে এই জায়ান্টগুলোর কেউই নিতে চায়নি। অবশেষে সিনেমাটি তুলনামূলক কম জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম নীস্ট্রিম-এ মুক্তি পায়। মুক্তির একেবারে সাথে সাথে হুলস্থূল ফেলে না দিলেও, সিনেমাটি ধীরে ধীরে এর প্রাপ্য সাড়া পেতে থাকে। ২০২১ এর শেষাংশে একে নিয়ে বেশ ভালোই আলোচনা হতে থাকে। এরপরে নেটফ্লিক্স ও অ্যামাজন প্রাইম দুই টেক জায়ান্টই সিনেমা কিনতে চাইলেও জয়ী হয় শেষপর্যন্ত অ্যামাজনই। সিনেমাটি এখন যেকোনো সময় অ্যামাজন প্রাইমে স্ট্রিম করা যাবে।
সিনেমাটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন জিও বেবি। এটি তার পরিচালনা করা চতুর্থ সিনেমা। সিনেমার মূল দুই চরিত্র, স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নিমিশা সাজায়েন ও সুরাজ ভেঞ্জারামুদু। সিনেমাটি মূলত আবর্তিত হয়েছে স্ত্রীর চরিত্রকে ঘিরে। সেই চরিত্রের জন্য প্রয়োজন ছিল আটপৌরে ধরনের একজন অভিনেত্রীর, যিনি কিনা নিজেকে যেকোনো ছাঁচে ভেঙে ফেলতে পারেন। এর আগে মালিক সিনেমায় আলী ইক্কার স্ত্রী ও নায়াত্তুর মতো আলোচিত সিনেমায় আমরা তার অভিনয় নৈপুণ্য দেখেছি। স্বামীর চরিত্রেও সুরাজ তার শতভাগ দিয়েছেন। বুড়ো শ্বশুরের অভিনয়ও ছিল দুর্দান্ত। যখন কোনো চরিত্রকে পর্দায় দেখলেই বিরক্তি আসবে তখন বলাই যায়— তিনি তার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছেন।
সিনেমার শুরুতেই নৃত্যরত নিমিশাকে আমরা তার হাসিমুখে দেখি। এরই মধ্যে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। সে শ্বশুরবাড়িতে নতুন সংসার শুরু করে এবং তার হাসিমুখ ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকে। না, তাকে কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে কোনো অত্যাচার করা হতো না বা জোর-জবরদস্তিও করা হচ্ছিলো না। আবার এমনও না সে অন্য কিছু করতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে তার ‘গৃহিণী’ পরিচয়কে কখনোই দূরে ঠেলে দিতে চায়নি, বরং আপন করে নিতে চেয়েছিল। আসলে তার এই অবস্থার মূলে ছিল আমাদের প্রাচীন সমাজব্যবস্থা। পুরুষেরা বেশিরভাগ সময়েই শুধু প্রতিবেলা নানাবিধ সুস্বাদু খাবার খেয়েই অভ্যস্ত, কিন্তু সেই খাদ্য রান্নার পেছনে যে দিনব্যাপী অক্লান্ত শ্রম, অধ্যাবসায় দিতে হয় তা অনেকেরই চোখে পড়ে না। আমরা খুবই সহজে হয়তো কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদীতভাবেই রান্নাবান্নার মতো একটা মৌলিক লাইফ স্কিলকে জেন্ডার রোলে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছি। নিমিশাও কিন্তু তা মেনে নিয়েছিল, শুধু একটু সহযোগিতা ও সহমর্মিতা সে চেয়েছিল, যেটা সে পায়নি।
সিনেমায় জিও বেবি দর্শকদের, বিশেষত পুরুষ দর্শকদের, মনে অস্বস্তি তৈরি করতে চেয়েছিলেন; যাতে তিনি শতভাগ সফল। এই সিনেমা কোনো পুরুষ পুরোটা দেখে শেষ করবে, অথচ তার মনে একটুও অপরাধবোধ হবে না বা অস্বস্তি হবে না- এমনটা অসম্ভব। তবে পরিচালক কিন্তু এখানে সমগ্র পুরুষজাতিকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করেননি, তিনি শুধু আমাদের দৈনন্দিন যে সামাজিক আচার সেগুলোই দেখিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, বাড়ির সবচেয়ে বর্ষীয়ান মানুষটির কথা, বাড়ির মহিলারা যখন রান্নাঘরে খেটে মরছে, তখনও তিনি নিজের ব্রাশে পেস্টটুকু লাগাবেন না, বাইরে যাবার জন্য জুতোজোড়া বের করবেন না, তাকে সবই পাতে তুলে দিতে হবে, আর তার ছেলে পাশে ইয়োগা ম্যাটে শুয়ে ব্যায়াম করবে। আবার সেই আত্মীয়র দেখাও আমরা পাই যে অন্য বাসায় গিয়ে কষ্ট করে রান্না করা খাবার খেয়ে একটু প্রশংসা তো দূরে থাক; রান্নার যত রকম খুঁত ও তার পরামর্শ মেনে রান্না করলে কীভাবে সেটা অন্য উচ্চতায় চলে যাবে সেই বয়ানেই ব্যস্ত থাকে। আমরা কত সহজেই উচ্ছিষ্ট খাবার, চাবানো হাড় প্লেটের পাশে টেবিলের উপর রেখে দেই। একটাবার ভাবি না আরেকজনকে তো সেটা পরিষ্কার করতে হবে; তার তো অস্বস্তি হবে সেটা করতে, এই বিষয়টিও পরিচালক খুবই সূক্ষ্মতার সাথে দেখিয়েছেন। আবার দেখি নারীরাও একই পরিস্থিতির শিকার হবার পরেও সুযোগের ফায়দা ওঠাতে ভোলে না।
যেহেতু সিনেমার নাম ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’, তাই এই সিনেমার বড় অংশই চিত্রিত হবে রান্নাঘরে সেটাই স্বাভাবিক। আর এখানেই জিও বেবি তার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। বিশেষ করে রান্না করার ওভারহেড শটগুলো, তরকারি কাটা, রান্নার প্রস্তুতি নেয়া ও এ সবকিছু করতে নিমিশা ও কখনো কখনো তার শাশুড়ি যেভাবে জেরবার হয় তা খুবই বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রিত। এই সিনেমা তার সোশ্যাল ম্যাসেজের পাশাপাশি টেকনিক্যালিও অত্যন্ত চমৎকার একটি সিনেমা। বিশেষ করে, রান্নাঘরের যে সাউন্ড ইফেক্টগুলো ব্যবহার করেছে সেগুলো এত সুন্দর আর লাগসই যে দর্শক একরকম ঘোরের মধ্যে চলে যেতে বাধ্য। নারকেল কোড়ানো, তেলে পাঁচফোড়ন দেবার ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ, তরকারি কাটার শব্দ, ভাত ফোটার শব্দ, চুলার আগুনে লাকড়ির গিট ফাটার শব্দ, মশলা বাটার শব্দ, বাসন মাজার শব্দ, ফ্যানের শব্দ, ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ সবকিছুর সাথে অসাধারণ ভিজ্যুয়াল দর্শককে নিয়ে যাবে নিমিশার রান্নাঘরে, দর্শকের মনে হবে সে সেই রান্নাঘরেই আছে নিজে দেখছে সবকিছু। সিনেমার সাউন্ড ডিজাইনারকে সাধুবাদ দিতেই হয় এমন পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করতে পারার জন্য।
এই সিনেমার আরেকটি সুন্দর দিক হচ্ছে পরিচালক সংলাপের ব্যবহার ছাড়াই শুধু দৃশ্যায়নে অনেক কিছু বলে ফেলেছেন। তিনি চেয়েছেন একটা বার্তা দিতে এবং তা তিনি দিয়েছেন সূক্ষ্মভাবে কোনোরকম বাগাড়ম্বর ছাড়াই। কিছু দৃশ্যের কথা না বললেই নয়; সিনেমায় কিন্তু একবারের জন্যও বলা হয়নি বা এমন কোনো সংলাপ নেই যাতে ফুটে উঠবে সুরাজ যৌতুক নিয়েছে, কিন্তু আমরা দেখি বিয়েতে আসা সব অতিথি চলে যাবার পরেও সুরাজদের বাড়ির উঠোনে একটি চকচকে লাল গাড়ি যাতে উপহারের রিবন বাঁধা। আমরা বুঝে যাই গাড়িটি কোথা থেকে কী উদ্দেশ্যে এসেছে। আবার নিমিশার শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিন সুরাজকে চা বানিয়ে খাওয়ানোর পরে চায়ের কাপে অভুক্ত চা দেখে আমরা বুঝি সুরাজের চায়ের স্বাদ মনমতো হয়নি। আবার পুরুষেরা একদিন রান্নাঘরে রান্না করার পরে যখন নিমিশা যখন বলে বাকি কাজগুলো সেরে ফেলি তখন সবাই হাসতে হাসতে বলে, রান্না-খাওয়া সব শেষ, এখন আবার কী কাজ? পরের শটেই আমরা রান্নাঘরের অবস্থা দেখি- নোংরা বাসনকোসন, সবকিছু লণ্ডভণ্ড; কোনো সংলাপ নেই, তবুও আমরা বুঝে যাই রান্না করে খেয়ে ফেললেই সব কাজ শেষ হয়ে যায় না। এছাড়াও এই বিংশ শতাব্দীতেও ঋতুচক্রের মতো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে কূপমণ্ডুকতার পরিচয় আমরা পাই, দেখি একই প্রজন্মের দুই নারীর ভিন্ন ধরনের মানসিকতা।
সাধারণত আমরা বলিউড ও হলিউডে যে ধরনের নারীকেন্দ্রিক সিনেমা দেখি, সেগুলোয় মেরুকরণ প্রতীয়মান হয়। সেখানে বেশিরভাগ সময়েই সমাজের নারীদের সঠিক চিত্রায়ন হয় না। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ সিনেমার নিমিশা বা তার শ্বাশুড়ির মধ্যে আমরা আমাদের চারপাশের নারীদের প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাব। পরিচালক জিও বেবি খুবই সুনিপুণভাবে আমাদের চারপাশের সমাজকে পর্দায় চিত্রায়ন করতে পেরেছেন। পাশাপাশি এটাও প্রমাণ করেছেন, কন্টেন্ট যদি ভালো হয়, তবে একসময় সেটি তার সঠিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে। হ্যাঁ, হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু পাবে ঠিকই।