দুই হাজার পাঁচশো বছর আগের কথা। ভয়ানক এক দানব দুনিয়া আর দোজখের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে চাচ্ছিল, যাতে মানুষ ভোগ করবে সীমাহীন যন্ত্রণা। দানবটির একটা চোখ লাল; অন্যটি কালো। এই দুই চোখেই সমস্ত ক্ষমতা। কাজ শুরু করেছে, এমন সময় আবির্ভূত হলেন বুদ্ধ। উপড়ে ফেললেন তার দুই চোখ। বিপদমুক্ত হলো মানবজাতি। কিন্তু দুটি চোখই বুদ্ধের হাত ফসকে পালাতে থাকে। কালো চোখকে ফের ধরে ফেলতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। বুদ্ধ তাকে শরীর ঘটিতে আবদ্ধ করে রাখলেন।
কিন্তু রক্তচক্ষু বা লাল চোখ বেশ ধূর্ততায় দূরে সরতে সক্ষম হলো। বদল করতে থাকলো মানুষের শরীর থেকে শরীর। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারল টানা সাত রাত। অষ্টম রাতে থেমে পেছনে তাকাল চোখটা। ভেবেছিল- যথেষ্ট দূরে চলে গেছে। কিন্তু বুঝতে দেরি হলো না, তার পালানোর পথটা আসলে অগভীর স্রোতের উপর সাতটি ধাপের একটা সেতু মাত্র। এটাও বুঝল, বুদ্ধের থেকে পালিয়ে থাকা অসম্ভব। ফলে নিজে থেকেই আত্মসমর্পণ করল। সত্যিকার আত্মসমর্পণ না। পরের কোনো সুযোগের অপেক্ষায় আত্মসমর্পণের ভান। বুদ্ধ উভয় ঘটিই বন্ধ করে দিলেন। একটিকে পশ্চিমের বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে, আর অন্যটিকে প্রাচ্যের দুর্গম কোনো স্থানে রাখার ব্যবস্থা হলো। শিষ্যদের বলে দিলেন,
এই দুই চোখ যেন আর মিলিত না হতে পারে, সেটা তোমরা নিশ্চিত রাখবে সব সময়। এটাই তোমাদের কর্ম।
বৌদ্ধধর্মে প্রচলিত এই আখ্যান। মহাযান বৌদ্ধধর্মে। সেই সাথে আরো কিছু কথা যুক্ত। এমন একটা সময় আসবে, যখন পশ্চিমের মরুভূমিতে আবদ্ধ সেই লাল পাথর পাবে একজন সাহায্যকারী। মুক্ত হয়ে যাবে কোনো এক রাত্রিতে। তারপর সাতটি ধাপ অতিক্রম করে মিলিত হতে চাইবে কালো চোখের সাথে। যেদিন দুই চোখ একত্রিত হবে, সেদিন দানব হবে অপ্রতিরোধ্য। দুনিয়া হয়ে উঠবে দোজখ। বুদ্ধ তাই দুই শিষ্য- একজন ভিক্ষু ও একজন কুমারি শামানকে কালো চোখের তত্ত্বাবধানে রাখেন। কোরিয়ার গভীর জঙ্গলে। এই গল্পকে পেছনে রেখে আধুনিক পৃথিবীর ফ্রেমে নির্মিত হয়েছে রিলিজিয়াস হরর ‘দ্য এইটথ নাইট‘। ২০২১ সালের দাক্ষিণ কোরিয়ান সিনেমা। পরিচালক কিম তাই হিয়ুঙ।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের দিকে চীন থেকে ফেরত আসা পণ্ডিতদের দ্বারাই কোরিয়ার মাটিতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে। পরবর্তীতে কগুরিয়ু রাজ্য ৩৭২ সালে, পেইকচি রাজ্য ৩৮৪ সালে এবং সিলা রাজ্য ৫২৭-৩৫ সালের মধ্যে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেন। যদিও চীনের সাথে কোরিয়ার সাংস্কৃতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার সেতু হিসেবে কাজ করেছে বৌদ্ধধর্ম। শামানিজম, তাওবাদ, কনফুশীয় ধর্ম এবং স্থানীয় মতবাদও বেশ জোরেশোরেই পালিত হতো। জন্ম সেখানে না হলেও কোরিয়া বৌদ্ধধর্মকে নিজের মতো করেই রূপান্তরিত করে নিয়েছে। ভারত এবং চীনের মতো সেখানেও জন্ম হয়েছে নানা শাখা-প্রশাখা। ফলে জনগণের চর্চিত বৌদ্ধধর্মে ক্রমে প্রবেশ করেছে লোককথা, দেবতা, আধাদেবতা, দানব এবং অন্যান্য শামান উপাদান।
গল্প শুরুর সময় ২০০৫ সাল। প্রফেসর কিম জুন চিওল একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। বুদ্ধের শরীর ঘটি নিয়ে তার বিস্তর জানাশোনা। প্রমাণ দেখতে চান বজ্রচ্ছেদিকা প্রজ্ঞাপারমিতা বা ডায়মণ্ড সূত্রের সেই আখ্যানের। গবেষণার সূত্রেই অবশেষে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে মরুভূমিতে খুঁজে পেলেন ঘটি। প্রফেসর কিম বুদ্ধের লুকানো ঘটি পেয়েছেন বলে দৃঢ়বিশ্বাসী। কিন্তু ল্যাব টেস্টে দেখা গেলো পাত্রটি মোটেই অত পুরাতন না। কার্বন ডেটিং করে ফলাফল এলো উল্টো। প্রফেসরের নামে অভিযোগ আসলো ইচ্ছাকৃত তথ্য জালিয়াতির। পণ্ডিত মহলেও হলেন অপমানিত।
এদিকে প্রফেসরও নাছোড়বান্দা। ঠিক ১৪ বছর পর অর্থাৎ ২০১৯ সালের পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের রাত। কিংবদন্তি অনুসারে এই সময় দানবকে জাগানো সম্ভব। মিথ্যাবাদীর অপবাদ গলায় ঝোলানো ক্রুদ্ধ প্রফেসর এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। নিজেকে প্রমাণের এই একটা মাত্রই পথ তার কাছে- লাল চোখ মুক্ত করে দিয়ে দানবকে জাগানো। সেই ভয়ানক কাজই করলেন প্রফেসর। আর জেগে উঠল হাজার বছর আটকে থাকা দানব। শুরু হলো কালো চোখের সাথে একত্রিত হবার মিশন। শুরু হলো পৃথিবীকে নরক বানানোর প্রক্রিয়া।
বহু বছর ধরে কালো চোখের ঘটির তত্ত্বাবধান করে আসছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলে মঠের ভিক্ষুগণ। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মঠপ্রধান জিয়ং। প্রফেসরের হাতে দানব মুক্ত হবার বিষয়টা আঁচ করতে পারেন তিনি। চিন্তিত হয়ে পড়েন। দানব তার মিশন শুরু করে দিয়েছে। একে একে সাত রাতে সাতটা শরীরকে ব্যবহার করে অষ্টম রাতে লাল চোখ কালো চোখের সাথে মিলিত হবে। তাকে বাধা দেয়ার একটা উপায় আছে অবশ্য। লাল চোখের যে সাতটা ধাপকে চলার পথে ব্যবহার করবে, সেসবের কোনো একটাকে সরিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ দানব যে সাতটি শরীরকে ব্যবহার করবে, তাদের কোনো একজনকে আগেই শনাক্ত করে হত্যা করতে হবে। ফলে লাল চোখের চলার রাস্তা ভেঙে পড়বে। সে এগোতে পারবে না। এই পরিকল্পনা দিয়েই জিয়ং তার তরুণ শিষ্য চঙ সিয়ককে পাঠান জিন-সুর কাছে।
জিন-সু ভিক্ষু হয় ১৯৯৯ সালের এক সড়ক দুর্ঘটনার পর। সেখানে তার স্ত্রী আর পাঁচ বছরের কন্যা মারা যায়। অন্য গাড়ির চালক ছিলেন এক মদ্যপ মহিলা। দুঃখে বিপর্যস্ত জিন-সু আশ্রয় নেয় এসে মঠে। মঠের হয়ে মোকাবিলা করতো ভূত-প্রেতের বিষয়গুলো। কোনো একটা ঘটনায় বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে কোরিয়ান বৌদ্ধ সংঘ কেস ঠুকে দেয় তার নামে। জেলও খাটতে হয়েছে সেজন্য কয়েক বছর। এখন সব ছেড়েছুড়ে কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করে। জীবন নিয়েও বিস্তর অনীহা। কিন্তু নিয়তির পরিকল্পনা অন্য রকম। নিয়তিই তাকে নির্বাচন করেছে দায়িত্ব নিতে। দানব মোকাবিলার দায়িত্ব। জিয়ং মারা যান। চঙ সিয়ক চলতে থাকে জিন-সুকে খুঁজতে। সাথে সেই কালো চোখের ঘটি। সমান্তরালে এগিয়ে যেতে থাকে গল্প। একদিকে লাল চোখের অগ্রযাত্রা। অন্যদিকে তাকে আটকে ফেলার চেষ্টা জিন-সু আর চঙ সিয়কের। আট রাত অব্দি।
প্রথমদিক থেকেই বেশ মেটাফোর এবং সিম্বল ব্যবহার করা হয়েছে মুন্সিয়ানার সাথে। চোখ দুটির কথাই বলা যাক। মানুষ যখন ভবিষ্যতের ভয়ে থাকে, তার ভেতর জন্ম নেয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভবিষ্যত কেউ জানে না, তাই সে প্রাণহীন অন্ধকার। তার রঙ কালো। আবার যখন অতীতের বিষাদে থাকে, তখন তার ভেতর থাকে অন্তর্জ্বালা। হতাশ অন্তর পুড়ে চলে প্রতিনিয়ত। তাই তার রঙ লাল। মানুষের সমস্ত দুঃখের এই দুটো উৎস। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা কিংবা অতীতের বিষাদ। এদের যেকোনো একটাই মানুষের জীবনকে নরক বানিয়ে তুলতে পারে। দুই চোখ একত্র হওয়ার মানে এমন এক পৃথিবী, যেখানে কেবল হতাশা আর ক্রোধ, অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ। ফলে লাল আর কালো চোখ কেবল লোককথা না। প্রতিটা মানুষকে তাড়া করে বেড়ানো এক দানব। আর দুই চোখের মিলিত হওয়ার মানে এক চিরন্তন রাত। অনন্ত জাহান্নাম।
জিন সু চরিত্রে দেখা যায় লি সাং মিনকে। ২০১২ সালের গোল্ডেন টাইম, ২০১৪ সালের ব্রোকেন এবং মিসাং: ইনকমপ্লিট লাইফ তার ইতোপূর্বের উল্লেখযোগ্য কাজ। তরুণ শিষ্য চঙ সিয়ক চরিত্রে থাকা ন্যাম দা রিউম ২০১৯ সালের বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে পরিচিত। পুলিশ অফিসার জেমসের চরিত্রে দেখা যায় পার্ক হ্যায়-জুনকে। ইতিপূর্বে থিয়েটার ও মুভিতে দেখা গেলেও খ্যাতি লাভ করেন মূলত ২০১৮ সালের সিরিজ মাই মিস্টার-এর মাধ্যমে। ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড অব দ্য ম্যারিড সিরিজে স্থানীয় পুলিশ অফিসারের চরিত্রে তিনি সেই খ্যাতিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। রহস্যময় তরুণী চরিত্রে কিম ইয়ু জাং। শৈশব থেকে অভিনয়জগতে থাকা এই অভিনেত্রীর কাজ এবং সম্মাননা- উভয় তালিকাই বেশ ভারি।
এখানে কিছু প্রশ্নের উত্তরের সাথে পরিচিতি প্রয়োজন। লাল চোখ কালো চোখের সাথে মিলিত হবার পথে শরীরগুলো ঠিক কীভাবে বাছাই করেছে? প্রফেসরের ভাগ্যে কী হলো? রহস্যময় সেই তরুণী এয়ি-রেন কি আসলেই কুমারী শামান? নাহলে তার পরিচয় কী? জিয়ং-এর মৃত্যুর পর মঠের প্রধান কে? শরীর ঘটির রক্ষকই বা কে? দানব লিয়ঙ-কে কেন ধরল? জিন-সু কী নিয়ে বিব্রত? শেষমেশ কী হলো? সিনেমা শেষ হলে অবশ্যই উত্তরগুলো আপনার কাছে থাকতে হবে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র জিন-সু। দানবকে জয় করাই তার নিয়তি। কিন্তু পর্দায় কিংবদন্তী দানবকে প্রতিহত করার পেছনে এটি জিন-সুর একান্ত নিজের গল্পও। নিজের ক্রোধ আর হতাশাকে জয় করার গল্প। যে মদ্যপ মহিলার গাড়ির ধাক্কায় জিন-সু সবকিছু হারিয়েছে, তরুণ শিষ্য চঙ সিয়ক তারই একমাত্র ছেলে। জিন-সুকে তাই অবিরাম নিজের অতীত এবং ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে চঙ সিয়কের সামনে। উপরন্তু, চঙ সিয়কের দায়িত্ব নিতে হয়েছে, তাকে রক্ষাও করতে হয়েছে বজ্রচ্ছেদিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের মাধ্যমে। অন্যদিকে, সার্বিক মঙ্গলের জন্য বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে নিজের মৃত্যু। যেন অনিশ্চয়তার ভয়কে জয় করলো এটা দিয়ে। অর্থাৎ, জিন-সুর ব্যক্তিগত লাল চোখ এবং কালো চোখ। জিন-সুর মৃত্যু তাই যেন নির্বাণকেই প্রতীকায়িত করছে।
কিংবদন্তি অনুসারে অশুভ দানবের ধ্বংস নেই। প্রত্যেক যুগে তাদের অবরোধ করে রাখতে হয়। রক্ষা করতে হয় নিজেকে এবং দুনিয়াকে। যেভাবে দুনিয়া থেকে দুঃখ কষ্ট নিঃশেষ হয় না। অতীতের হতাশা আর ভবিষ্যতের উদ্বেগ সব সময়ই অপেক্ষা করে বাক্স থেকে মুক্ত হবে বলে। প্রতি যুগে তাকে দমন করতে হয়। ফলে লাল চোখ আর কালো চোখের গল্পও শেষ হয় না কখনো।
দর্শককে আশ্বস্ত করার মতো হরর থ্রিলার তৈরি করা কঠিন। লোককথা, পুরাণ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসাবে আসে প্রায়ই। ফলে একদিকে যেমন দুর্বোধ্য হয়ে ওঠার ভয় থাকে, অন্যদিকে থাকে সারহীন সস্তা কিছু হয়ে ওঠার। এর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে একটা গল্প নির্মাণে পরিচালক কিম তাই হিয়ুঙকে সফলই বলতে হবে। আর ‘দ্য এইটথ নাইট’ জায়গা পাবে সফল রিলিজিয়াস হরর সিনেমার তালিকায়।
দক্ষিণ কোরিয়া অনেক আগেই ট্রেন টু বুসান কিংবা দ্য হোস্ট-এর মতো হরর ক্লাসিক উপহার দিয়ে অবাক করেছে। সেই ঐতিহ্যকে ‘দ্য এইটথ নাইট’ ম্লান হতে দেয়নি। এজন্যই নাইটম্যারিশ কনজুরিং-এর চিফ এডিটর সারাহ মুশনিকি লিখেছেন,
এটি দুর্দান্ত; তবুও বিষাদময়। ভেতরে বহন করছে যন্ত্রণা। দর্শকের জন্য এখান থেকে কিছু না নেয়াটা হবে একেবারেই অসম্ভব। অংশত তা পরিচালকের প্রতিভাময় স্ক্রিপ্টের কারণে। দর্শককে যা বিভিন্ন টুইস্ট ও বাঁকের মধ্যে নিয়ে যায়। পাশাপাশি গল্পের রহস্য উন্মোচনের সাথে সমান তালে ধরে রাখে।