![](https://assets.roar.media/assets/udTLS23VpDC41Nou_51375770_559430461221995_2559155073615659008_n.jpg?w=1200)
আরবান ফ্যান্টাসির নাম শুনেছেন কখনো? লর্ড অফ দ্য রিংস, হ্যারি পটারের বইগুলোর মতো অনেক বিখ্যাত ফ্যান্টাসি জনরার বই রয়েছে। সেই ফ্যান্টাসি জনরার একটি বিভাগ হলো আরবান ফ্যান্টাসি। বর্তমান সময়ে শহুরে প্রেক্ষাপটে ফ্যান্টাসি লেখাকেই আরবান ফ্যান্টাসি বলা হয়।
বাইরের দেশের সাহিত্যে আরবান ফ্যান্টাসির অনেক বিখ্যাত বই রয়েছে, যার মধ্যে জিম বুচারের ‘দ্য ড্রেসডেন ফাইলস’, নিল গেইম্যানের ‘নেভারহোয়্যার’ এবং জর্জ আর আর মার্টিনের ‘ফিভার ড্রিম’ উল্লেখযোগ্য।
আমাদের দেশে খুব কম লেখকই ফ্যান্টাসি জনরার বই লেখেন, আরবান ফ্যান্টাসি তো দূরে থাক। তা-ও গত কিছু বছর আদী এবং বাতিঘর প্রকাশনীর হাত ধরে বেশ কিছু নতুন জনরার বই পেয়েছে বাংলাদেশের পাঠকরা। এর মধ্যে আরবান ফ্যান্টাসির একটি হলো সৈয়দ অনির্বাণের লেখা আদী প্রকাশনীর ‘শোণিত উপাখ্যান’ সিরিজ, যা নিয়ে আজকের এই লেখার অবতারণা।
‘শোণিত উপাখ্যান: বর্তমান, অতীত এবং অতঃপর’ নামেই ট্রিলজির বই তিনটি সাজানো।
আধুনিক এই ঢাকা শহরের ভেতরে পিশাচ, স্কন্ধকাটা, চুড়েল, জাদুকরদের নিয়েই কাহিনীর বিস্তার! আরবান এবং হিস্টোরিক্যাল ফ্যান্টাসির কাতারে পড়া এই সিরিজ থ্রিলার পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
সিরিজের তিনটি বইয়েরই সারসংক্ষেপে বলা আছে,
ইতিহাস কথা বলে – বিজয়ীদের কথা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় – অতীত গৌরবের সাক্ষ্য। কিন্তু কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ঘটনাবলির কতটুকু তাতে অটুট থাকে?
শোণিত উপাখ্যান – বর্তমান
![](https://assets.roar.media/assets/tGAh4zzOwtgSWENh_12366107_1711710145730172_6815250621610275810_o-%281%29.jpg)
সিরিজের তিনটি বইয়ে নামের সাথে মিল রেখে তিন সময়ের গল্প বলা হয়েছে। ‘শোণিত উপাখ্যান : বর্তমান’ এই সিরিজের প্রথম বই এবং এই গল্পের বিস্তার বর্তমান সময়।
মোহাম্মদপুরে ঘটে যাওয়া অদ্ভুতুড়ে একটি কেস এসে পড়লো তুখোড় পুলিশ অফিসার কায়েস হায়দারের হাতে। অসামাজিক এই পুলিস অফিসার কেসটি সমাধান করতে গিয়ে দেখলেন, সাধারণ কোনো যুক্তিতর্ক খাটছে না এই অতিপ্রাকৃত কেসটির বেলায়।
তখন কায়েস সাহায্য চাইলেন বহু বছর আগে পরিচয় হওয়া রহস্যময় চরিত্র অবলালের কাছে, আগেও একবার অদ্ভুতুড়ে আরেকটি কেসে সাহায্য পেয়েছিলেন যার কাছ থেকে।
অবলাল আর কায়েস এই কেসটি সমাধান করতে গিয়ে দেখলেন, কাহিনীর বিস্তার অনেক বেশি! আধুনিক ঢাকা শহরেই বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার মুখোমুখি হতে লাগলেন দুজনে। অবলালের অতিপ্রাকৃত সত্ত্বারও নতুন করে পরিচয় পেলেন কায়েস।
তিনটি বইয়ের ভেতর প্রথমটিই বেশি চমকপ্রদ। এতে এত সাবলীলভাবে গল্পের বুনন করেছেন লেখক যে বোঝাই যাবে না এটি লেখকের প্রথম বই। এত সহজ ভাষায় থ্রিলার লেখায় এক বসায় বইয়ের অনেকটুকু শেষ করা যায়। রহস্যময় জাদুকর অবলাল চরিত্রটি যে কারোরই পছন্দ হবে।
এই চরিত্রটি ডিসি কমিকসের একটি চরিত্র জন কনস্ট্যান্টাইনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
![](https://assets.roar.media/assets/vLZCK5ZU4IfftlRC_wp2316267.jpg)
অবলাল ‘সাদা হাত’ নামের একটি সংগঠনের কর্মী। সহজ কথায়, ‘সাদা হাত’ হলো অতিপ্রাকৃত জগতের প্রতিরক্ষা বাহিনী। গল্পের মাঝের দিকে পরিচয় হয় ‘সাদা হাত’ এর এজেন্ট সুদর্শনা মীরানা মোরেস এবং বিশালদেহী আধা ভ্যাম্পায়ার ক্যাপ্টেন অ্যান্ড্রিয়াস এর সাথে, যে স্মিথ এন্ড ওয়েসন .৫০ ক্যালিবারের পিস্তল নিয়ে ঘোরে! এসব চরিত্রের ব্যাপারে লেখকের সাবলীল বর্ণনায় পাঠক কিছু সময়ের জন্য সিনেমা দেখার মতো অনুভূতি পাবেন, যা একজন নতুন লেখকের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
গল্পের মধ্যে পিশাচের সাথে জাদু দিয়ে খন্ডযুদ্ধ, স্কন্ধকাটার হামলা, ভ্যাম্পায়ার, চুড়েল অনেক কিছুই পাঠক নতুন পাবেন, যা বাংলা সাহিত্যে কমই পাওয়া যায়।
এই সম্পর্কে লেখক সৈয়দ অনির্বাণ বলেছেন,
আরবান ফ্যান্টাসি বেশ নতুন একটা ঘরানা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সাহিত্যে বেশ সাড়া জাগাচ্ছে এই ঘরানার বই-পুস্তক। এই লেখার শুরুতে শুধুই ছিলো আরবান ফ্যান্টাসি। পরে যোগ হলো ঐতিহাসিক ফ্যান্টাসি এবং স্বাভাবিকভাবে থ্রিল ও হরর। বইটি লিখে আমি যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি। পাঠক এর ভগ্নাংশও যদি পান, তাহলেই আমার পরিশ্রম সার্থক ধরে নেবো।
লেখক এই বইটিতে এমন কিছু রহস্য বাকি রেখেই শেষ করেছেন যে, পাঠকের তখনই পরবর্তী বইটি পড়তে ইচ্ছা করবে।
শোণিত উপাখ্যান – অতীত
![](https://assets.roar.media/assets/RhGNOhgNiuI2TJQD_16602335_1900249503542901_1605356104130515985_o-%281%29.jpg)
এই বইটির গল্প মূলত প্রথম বইটির গল্পের পূর্ববর্তী সময়ে বিস্তার। সিরিজের এই বইটিতে পাঠকগণ প্রথম বইতে রেখে আসা রহস্যের জবাব হয়তো পাবেন না, কিন্তু রহস্য সৃষ্টি করা চরিত্রগুলোর পেছনের গল্প জানতে পারবেন।
এই বইটিতে দুটো গল্প একত্রে এগিয়েছে। একটি সদূর অতীতের আলেক্সান্ডার, আটিলা দ্য হান, চেঙ্গিস খান আর বাবরের দরবারে, আরেকটি অবলালের শৈশব কালে। বাবরের সময়কালের গল্পটিতে মূল ইতিহাসের সাথে কাল্পনিক গল্প বলেছেন। এ সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য,
এই বইতে যেসব ঐতিহাসিক রেফারেন্স টানা হয়েছে তার কিয়দংশ সত্য হলেও বেশিরভাগই কল্পনাপ্রসূত। এই কাহিনীর মাঝে বাস্তবতা খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা।
কাহিনীর একদিকের বিস্তার সম্রাট বাবরের দরবারের বীর যোদ্ধা বাঘাতুর এবং শোণিত মন্দিরের দুই পুরোহিত লোহিত, অবলোহিতের গল্পে। জানা যাবে সম্রাটদের বিশেষ অতিপ্রাকৃত শক্তির কথাও।
গল্পের আরেক ভাগে অবলালের সাদা হাতের সাথে সম্পৃক্ত হবার কাহিনী পাওয়া যাবে, যেখানে অবলাল এবং মীরানা মোরেসের সম্পর্ক বোঝা যায়। ‘সাদা হাত’ এর সাথে কেনই বা আধা ভ্যাম্পায়ার ক্যাপ্টেন অ্যান্ড্রিয়াসের তিক্ত সম্পর্ক সেই ব্যাপারেও জানা যাবে।
লেখক প্রথম বইয়ের মতো সাবলীল লেখা ধরে রেখেছেন এই বইটিতেও। অবলালের পরিবারের সাথে ‘সাদা হাত’ এর সম্পর্ক বেশ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গল্পে। তার যৌবনকালেই ঘটে যাওয়া পিশাচের গ্রামের গল্প বইটিকে স্বতন্ত্র করে তুলতে বেশ সহায়তা করেছে।
বইটিতে লেখক দুই সময়ের গল্পকে চমৎকারভাবে এক করে দিয়ে শেষ করেছেন। কোনো পাঠক চাইলেই এই বইটি আগে পড়ে সিরিজের বাকি বই পড়তে পারেন। তবে লেখকের মতে, কাহিনীর মূল উদ্দেশ্য এবং রস আস্বাদন করতে চাইলে প্রথমে বর্তমান, তারপর অতীত এবং সবশেষে অতঃপর পড়া উচিত।
শোণিত উপাখ্যান – অতঃপর
![](https://assets.roar.media/assets/q9N5o59mVU89zFE8_50597951_2237172433223210_3369311864147148800_n.jpg)
প্রথম বইটির পরবর্তী ঘটনা কী হয় তার জবাব এই বইয়ে পাওয়া যায়। সিরিজের তিন নাম্বার এই বইটি মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় বইয়ের কাহিনীর মিলনমেলা। সিরিজের সত্যিকার সিক্যুয়েল বলা যায় ‘শোণিত উপাখ্যান – অতঃপর’-কে।
অতীতের বাবরের সময়কার বাঘাতুর আর শোণিত মন্দিরের পুরোহিত অবলোহিতের কী হলো? তা এই বর্তমান সময়ের ঘটনার উপর কী-ই বা প্রভাব ফেলবে? এবং বর্তমানের ঢাকা শহরে ঘনিয়ে আসা এই কঠিন সমস্যার সমাধানে ‘সাদা হাত’ কী পদক্ষেপ নেবে? অতি ধুরন্ধর শৈলন ভট্টাচার্যের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে যাচ্ছে? মীরানা এবং অবলালের সম্পর্কেরই বা কী হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরই এই বইতে পাওয়া যায়।
অন্য বই দুটির তুলনায় সিরিজের শেষ বইটিতে গল্পের গতি অনেক বেশি। আগের বই দুটির গল্পের কিছু ধোয়াশা কাটাতে কাটাতেই গল্প অনেক দ্রুতগতিতে এগোয়।
সমালোচনা
সিরিজের তিনটি বই পাশাপাশি কেউ পড়লে খুব ভালোলাগা কাজ করবে। শোণিত উপাখ্যানের নিয়মিত পাঠকদের যে সৌভাগ্য ছিল না। লেখক বেশ বিরতি দিয়ে বই তিনটি লিখেছেন। প্রথম বই ২০১৫ সালে, দ্বিতীয় বই ২০১৭ এবং তৃতীয়টি ২০১৯ সালের বইমেলায় বের হয়েছে! এই বিরতির জন্য কিছুটা হলেও মূল গল্পের স্বাদ কমে গিয়েছে।
সিরিজের দ্বিতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক চাইলে ঐতিহাসিক বর্ণনা একটু কমিয়ে রাখতে পারতেন। কিছু কিছু জায়গায় একঘেয়ে লেগেছে বর্ণনায়।
তৃতীয়টি একটু তাড়াহুড়া করে শেষ করা হয়েছে বলে মনে হয়। গল্পটি কিছুটা আন্দাজ করা যাচ্ছিলো বইতে চমক কম থাকায়।
লেখক পরিচিতি
![](https://assets.roar.media/assets/4026zD9ZDSKT9EzT_14379964_1485329818149165_6030609088590475354_o.jpg)
সাবলীলভাবে এরকম অসাধারণ গল্প লিখে যাওয়া মানুষটি বেশ সাধারণ। ‘৯০ এর দশকে জন্ম নেয়া সৈয়দ অনির্বাণ ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন। কিছু সময় প্রবাসে কাটানোর পর আবার দেশে ফিরে আসেন। এই বইটি লেখা শুরু প্রবাসে থাকাকালেই।
প্রচুর বই পড়বার অভ্যাস থেকেই লেখার ইচ্ছা জেগে ওঠে। তরুণ এই লেখকের শোণিত উপাখ্যান ট্রিলজি ছাড়াও ‘যকৃত’ নামে আরেকটি হরর উপন্যাস রয়েছে।
আশা করি ভবিষ্যতে পাঠকদের আরো ভালো কিছু উপহার দেবেন সৈয়দ অনির্বাণ।
কেন পড়বেন এই ট্রিলজি
এরকম বই বাংলা সাহিত্যেই খুব কম লেখা হয়েছে। ড্রেসডেন ফাইলস পড়ে ভালো লেগে থাকলে, ডিসির কনস্ট্যান্টাইন চরিত্র চিনে থাকলে এবং ভালো লেগে থাকলে এই বই অবশ্যই আপনার জন্য। ছোটবেলায় দেখা ‘ভ্যান হেলসিং’ সিনেমার কথাও মনে পড়বে এই সিরিজ পড়তে গিয়ে!
তিনটি খন্ডে একটি বড় কাহিনী বলা বাংলা সাহিত্যে বিরল। শরীফুল হাসানের লেখা ‘বাতিঘর’ এর ‘সাম্ভালা’ ট্রিলজি এর আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আশা করি প্রকাশক ‘সাম্ভালা’ ট্রিলজির মতো ‘শোণিত উপাখ্যান’ ট্রিলজিকেও এক মলাটে আনবেন।
![](https://assets.roar.media/assets/zBIO0er93h0COXrc_27748099_1557935644323207_3699026318164132508_o-%281%29.jpg)