বাংলাদেশের ইতিহাসের রাতের অন্ধকার যদি হয় পঁচাত্তর থেকে স্বৈরশাসকের পতন পর্যন্ত সময়, তাহলে স্বাধীনতার পরের সময়টুকু হবে ধূসর গোধুলি। নতুন দেশ, স্বাধীনতার রঙিন চশমা চোখ থেকে নামার পর থেকেই সবকিছু কেমন বিবর্ণ হতে থাকে; কমতে থাকে আশা, বাড়তে থাকে দীর্ঘশ্বাস। ‘আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক’ সেই অস্থির সময়কেই আবর্তন করে লেখা। ঠিক সেই সময়ের এক কিশোরের তরুণ হয়ে ওঠার গল্পই আমাদের বলেছেন ইমতিয়ার শামীম।
বাংলাদেশের সাহিত্যে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, কিন্তু সাধারণ পাঠকের কাছে পরিচিতি পাননি, তাদের মধ্যে ইমতিয়ার শামীম অন্যতম। এ ব্যক্তির ব্যাপারে পরিচিত হননি অপেক্ষা বলা উচিত পরিচিতি চাননি। সুখ্যাতি চাইলে তার অভাব ইমতিয়ার শামীমের কস্মিনকালেও হতো না। নিজের অনন্য লেখনশৈলী দ্বারা পাঠককে একদম ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দুর্লভ লেখকদের মধ্যে ইমতিয়ার শামীম অন্যতম। দীর্ঘদিন প্রিন্ট আউট থাকার পর বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। চোখে লেগে থাকা সুন্দর প্রচ্ছদটি করেছেন সব্যসাচী হাজরা। বর্তমান প্রচ্ছদটি বইয়ের বিষয়বস্তু ও শিরোনামের সাথে বেশি উপযুক্ত হলেও আমার কাছে আগের প্রচ্ছদটিই অধিকতর ভালো লেগেছে। মাত্র ১০৪ পৃষ্ঠার ছোটখাট, শক্তপোক্ত এই বইটি একবসায় পড়ে ফেললেও একে মাথা থেকে সহজে ঝেড়ে ফেলা যায় না। চরিত্রগুলো বারবার তাদের উপস্থিতি জানান দিতে থাকে; শক্তভাবে বলতে থাকে— আমাদের কালের অতলে হারিয়ে যাওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি; আমরা আছি, থাকবো।
উত্তমপুরুষে লেখা এই উপন্যাসে কথকের নিজের দৈনন্দিন জীবন, তার মনের ভাবনা, আক্ষেপ, কষ্ট-ভালোবাসা সবকিছুই উঠে এসেছে। বইটি পড়ার সময় মনে হতে পারে, কারো ডায়েরি পড়ছি। উপন্যাসের শুরু কথকের সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়া বড় ভাই আমিনুর রহমানকে সামরিক বাহিনীর ধরে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এই ধরে নিয়ে যাওয়া কীভাবে কথককে আলোড়িত করে তার চিত্র আমরা দেখি। এরপরেও কীভাবে জীবন চলতে থাকে; কথকের শারীরিক ও মানসিকভাবে বড় হওয়া গল্পের সমান্তরালে পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়। লেখক এমনভাবে কাহিনীর বর্ণনা করেছেন যে, ভ্রম হয়, কেউ বুঝি পাশে বসিয়ে গল্প শোনাচ্ছে।
বইতে কলেজপড়ুয়া একজন ছেলের জীবন খুবই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার মানসিক দোদুল্যমান অবস্থা, বড় ভাইয়ের জন্য চাপা কষ্ট, মা-বাবার জন্য শ্রদ্ধা, ছোট ভাই-বোনদের জন্য স্নেহ, কিশোর বয়সের প্রথম প্রেম, নিজেকে নিয়ে অনিশ্চয়তা সবই অত্যন্ত জলজ্যান্ত। লেখক আমাদের খোঁজ দিয়েছেন এমন এক ডাকঘরের, যেখানে চিঠি ফেলে শুধু আপনজনেরা, কথকের বড় ভাইয়ের আকস্মিক প্রস্থানে সেই ডাকঘরে তালা পড়লেও আবার খুলে যায় পাশের বাড়িতে একগুচ্ছ বেলিফুলের আবির্ভাবে। এছাড়াও ঐ আশির দশকের মফস্বল শহরের অবস্থা, সামরিক জান্তার শাসনের মধ্যেও মানুষের নিষ্প্রভ জীবনযাপন সবই পাঠ-পটে উঠে আসে ছবির মতো।
ইমতিয়ার শামীমের লেখার নিজস্ব এক অনন্য স্টাইল আছে। ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসের মতো অত তীব্রভাবে না হলেও এই বইয়েও লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাপ রয়ে গিয়েছে। যদিও তিনি সেটা প্রচার করার চেষ্টা করেননি, তবে সেটা লুকানোর চেষ্টাও তিনি করেননি।
ইমতিয়ার শামীম তার লেখায় সময়কে একদম বন্দি করে ফেলতে পারেন। ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসে যেমন তিনি পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসনকে তুলে ধরেছেন তথাগত জবানীতে, তেমনি এই বইতেও সেটা করেছেন। তবে সময়ের ব্যাপ্তি কমেছে অনেকটাই। সেই বইতে আমরা এক দশকেরও বেশি সময়ের ছবি পাই, সে তুলনায় এই বইতে পাওয়া যায় বছরখানেকের। সেকারণেই হয়তো এ বইতে নামহীন কথকের জীবনই বড় হয়ে ওঠে সেই অস্থির সময়ের সামগ্রিক বর্ণনার চেয়ে। বইতে আমরা আরো দেখি সেই বয়সে বন্ধুদের সাথে করা খুনসুটি, দুষ্টুমি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কাজের সুন্দর উপস্থাপনা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে বইয়ের পুরোটায়, প্রতিটা বাক্যে জড়িয়ে থাকে এক আশ্চর্যরকম নিঃসঙ্গতা। যেভাবে ইমতিয়ার শামীম কথকের ভেতরের এই নিঃসঙ্গতাকে সরাসরি উল্লেখ না করে, বরং সূক্ষ্ম ও স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করেছেন; নিজের লেখনীর ওপর অমন নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ভাবনার সে মূর্ত প্রকাশ সম্ভব নয়। বন্ধু, পরিবার, ভালোবাসার মানুষ দ্বারা বেষ্টিত থাকার পরেও কথককে আশ্চর্যরকম নিঃসঙ্গ মনে হয়— যা মনে করিয়ে দেয় হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ এর তরু ওয়াতানাবেকে। প্রিয়জন হারিয়ে ফেলার ফলে যে প্রচ্ছন্ন একাকিত্ববোধ তার পরিচয় আমরা এই দুজনের থেকে পাই।
ইমতিয়ার শামীমের লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সম্ভবত গল্পের মধ্যে গল্প বলা। এই বইও তার ব্যতিক্রম নয়। মূল লেখা এগিয়ে নিতে নিতেই অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে লেখক তার অনুভূতি, ধারণাগুলো প্রকাশ করে ফেলেন। এই উপন্যাসে ইমতিয়ার শামীমের শব্দশৈলী যেন বাক্যগুলোকে জীবন দান করেছে! তার সাথে যুক্ত হয়েছে তার স্বভাবসিদ্ধ অনন্য রূপকের ব্যবহার। যেমন- চাপা কান্না বোঝাতে তিনি লিখেছেন, “ফোঁপানির শব্দ কোনো বুদবুদ না তুলে মিলিয়ে যাবে বাতাসের মধ্যে”; ভোরের কুয়াশার অস্বচ্ছতা বোঝাতে লিখেছেন, “আত্মহত্যার মতো বিষণ্নতা মেশানো কালচে আভা”। এছাড়াও মফস্বল এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, শহুরে মধ্যবিত্তের শেকড়ে ফিরে যাবার আকুতি, ছোট ঘটনা ডালপালা মেলে মহীরূহ হয়ে যাওয়া সবকিছুই লেখক তুলে ধরেছেন নিপুণভাবে। ইমতিয়ার শামীমের শক্তিশালী কলম এমন এক অনবদ্য রচনা সৃষ্টি করেছে যা বাংলা সাহিত্যে টিকে থাকবে এক ধূসর সময়ের জলজ্যান্ত দলিল হয়ে। আবার বইয়ের শেষে পুনরায় আরেক বাহিনীর আবির্ভাবে লেখক আমাদের জানান দেন, সময় আসলে কখনোই পাল্টায় না, শুধু তার রং বদল হয়। তিনি বলেন, “কেননা ক্রসফায়ারেই মারা যেতে হয়। কেননা ক্রসফায়ারই গন্তব্য আমাদের সকলের। কেননা চিঠিযুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, থেমে গেছে কুউউ ঝিকঝিক।”
বইয়ে যে সময় দেখানো হয়েছে, সেই সময়ে লেখক নিজেও কথকের বয়সীই ছিলেন। কে জানে- হয়তো কথকের আয়নায় লেখক নিজেকেই দেখেছেন। ইমতিয়ার শামীমের প্রায় তিন দশক বিস্তৃত লেখকজীবনের সব লেখাই প্রশংসার দাবিদার হলেও এই বইটি এক আলাদা জায়গা নিয়েই থাকবে। গুণী এই লেখক কথাসাহিত্যে তার অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার লাভ করেন। আশা করা যায় ভবিষ্যতে তার থেকে আমরা এমন আরো অনেক শক্তিশালী লেখা পাব।