আবুল ফজল নিজেই বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কর্মজীবনে শিক্ষক হিসেবে কাটিয়ে দেওয়া মানুষটাকে সাহিত্য টানতো ভীষণরকম। তাই তিনি লিখতেন। তার লেখার মূল উপজীব্য ছিল সাহিত্য, প্রবন্ধ, সমকালীন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সম্পর্কে স্বচ্ছ এবং গভীর মতাদর্শ। তার লেখনশৈলীর সাবলীলতা এবং লেখার স্বচ্ছতার কারণেই তার প্রবন্ধগুলো এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কোনো সক্রিয় রাজনীতিক ছিলেন না, তবে দেশের কাজে এবং দেশের প্রয়োজনে তিনি বরাবরই দেশ ও দশের সাথে ছিলেন।
আবুল ফজল সম্পর্কে এত কিছু বলার কারণ, এই বইটি উনার স্মৃতির আলোকে লেখা। যে স্মৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কিংবা শেখ সাহেব। শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে যে কালো অধ্যায়ের সূচনা করা হয়েছিল এই ভূখণ্ডে, তা সমস্ত বাংলাকেই ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। সেই আলোড়ন স্পর্শ করেছিল আবুল ফজলকেও। প্রতিনিয়ত বিবেকের দংশন এবং একজন লেখক হওয়ার দায় থেকেই তিনি ২৫শে আগস্ট ১৯৭৫ সালে ‘বিবেকের সংকট’ নামে প্রবন্ধ লিখেন এবং পত্রিকা অফিসে পাঠান। কিন্তু বিধি বাম, সেই লেখা তখন ছাপা হয়নি।
এই বইয়ে মূলত আবুল ফজলের সাথে শেখ মুজিবের সাক্ষাতের সময়কার কথোপকথন লিপিবদ্ধ রয়েছে। শেখ মুজিব যখন একজন নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন থেকেই তিনি আবুল ফজলের লেখার একজন ভক্ত। উনি নিজে আবুল ফজলকে চিঠি লিখেছিলেন তার প্রবন্ধ পড়ে। তবে শেখ মুজিব এবং আবুল ফজলের মধ্যকার দেখা-সাক্ষাৎ এবং ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, এবং শেখ মুজিবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ঘনিষ্ঠতা বজায় ছিল।
আবুল ফজলের মতে, সবারই এই মহান নেতার জীবন ভালো করে অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, শেখ মুজিব যে ভুলগুলো করেছিলেন, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া খুবই জরুরী। তাছাড়া তার যথাযথ পরিচয় এবং মূল্যায়নও খুবই জরুরী। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখকের কথায় ফুটে উঠে যে, বাঙালি মধ্যবিত্তরা সুযোগ পেলেই উপরে উঠতে চায়। এই উপরে উঠার প্রতি দুর্বলতা তাদের স্বভাবে, যার প্রমাণ এই মহান নেতাকে হত্যা এবং আপামর বাঙালির দীর্ঘকালীন নীরবতা। আবুল ফজলের লেখায় ব্যক্তি মুজিব এবং নেতা মুজিব এই দুইয়ের দেখাই মেলে। ব্যক্তি হিসেবে যে তিনি চমৎকার ছিলেন, এবং কেন তাকে নেতা হিসেবে ‘মহান’ বলা হয়, তার কিছুটাও এখান থেকে ধারণা করা যায়।
বইটি পড়েই জানা যায়, শেখ মুজিব সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। যারা সাহিত্য নিয়ে কাজ করতেন, তাদের তিনি যথেষ্ট সম্মান করতেন। এর দেখা মিলে আবুল ফজলের সাথে তার ব্যবহারে, তার অনুরোধে কবি ফররুখ আহমেদের পরিবারকে অর্থ প্রদান এবং বাড়ি বিষয়ক সাহায্য করার ব্যাপারে। আবার নেতা হিসেবে তিনি যে কতটা মহান, তার হদিস পাওয়া যায় আবুল ফজলের সাথে একান্তে সাক্ষাতের সময়কার কথোপকথনে। যেখানে তিনি বলেন যে, পনের মাস ধরে তিনি কোনোরূপ বেতন নেন না।
বই থেকেই জানা যায় সেই সময়কার রাজনৈতিক এবং শিক্ষার হালচাল। কেননা, আবুল ফজল এবং বঙ্গবন্ধুর বেশিরভাগ কথাই ছিল রাষ্ট্রভিত্তিক এবং রাজনৈতিক নানা সমস্যা নিয়ে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ তার কাম্য নেতাকেই পেয়েছিল। তারপরও তাতে উন্নতির বদলে অবনতি দেখা দিয়েছে। কিন্তু কেন? দু’জনের আলাপচারিতার মাঝে মাঝেই এই প্রশ্নের উত্তর এসে যায়।
আবুল ফজল কখনো ইঙ্গিতে, কখনো বা সরাসরিই এই সময়ের সবচেয়ে প্রিয় নেতাকে বারবার সাবধান করেছিলেন। কখনো বলেছিলেন, “অনেক সময় স্বার্থান্বেষী অবুঝ আত্মীয় স্বজনেরা অসাধারণ প্রতিভাধর নেতৃত্বের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” আবার কখনো বলেছেন লাল বাহিনীর দৌরাত্ম্যের কথা। আবার বঙ্গবন্ধুর আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও অনেক কাজই করা হয়নি সাথে সাথে।
আবুল ফজল তার বিবেকের দংশন থেকে একজন মুজিবের এমন নৃশংস হত্যা মানতে পারেননি। তাই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নিজের যা সম্বল, সেই কলম তুলে নিয়েছিলেন।
তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় এই নেতার ব্যক্তিজীবন এবং রাজনৈতিক জীবন দুই ক্ষেত্রেই নিজ নিজ জায়গায় অসাধারণ উদাহরণ। আবুল ফজল অল্প সময় হলেও এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। যেভাবে উনি দেখেছেন, ঠিক সেভাবেই তিনি তুলে ধরেছেন এই বইতে। কিন্তু এই মহান নেতার ‘পতন’ যেন সব থেকে নৃশংস ঘটনাকেও হার মানায়।
কিন্তু আদৌ কি পতন হয়েছে এই নেতার? আবুল ফজলের ভাষাতেই বলতে চাই,
‘বাংলাদেশে শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তি যার সম্বন্ধে হেমিংওয়ের এ উক্তিটি পুনরাবৃত্তি করা যায়- Man is not made for defeat. Man can be destroyed, but not defeated.’
শেখ মুজিবকে জানতে আগ্রহী যারা, তারা পড়ে ফেলতে পারেন বইটি।
বইয়ের নাম: শেখ মুজিব, তাকে যেমন দেখেছি || লেখক: আবুল ফজল
প্রকাশনী: বাতিঘর || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি