শুরুটা এভাবে করা যেতে পারে-
যদি কেউ আপনাকে প্রশ্ন করে যে, “আয়নাতে কী দেখা যায়?” তাহলে উত্তর কী হবে? প্রতিবিম্ব। তাই তো?
মিররে আদতে হয়েছেও তা-ই। নির্মাতা তার হারানো দিনগুলোর প্রতিবিম্ব তৈরি করেছেন অপ্রচলিত প্লট কাঠামোয়। অপ্রচলিত বলার কারণ এই যে, প্রচলিত অর্থে চলচ্চিত্র বলতে যা বোঝায়, তারকোভস্কির সৃজন প্রক্রিয়াতে আমরা ঠিক তা দেখি না। আমরা দেখি দীর্ঘশটের মাধ্যমে গঠিত হওয়া নাটকীয় কাঠামো। সাদাকালো, রঙিন আর সেপিয়াতে ফ্রেমের আশ্রয়ে সময়ের ছন্দহীন গলন। গিওরগি রিয়ারবার্গের সিনেমাটোগ্রাফির মন্থরতা, যেখানে শূন্যফ্রেমও হয়ে ওঠে অগাধ তাৎপর্যময়। আধ্যাত্মিকতার সাথে জীবনের চিত্রকল্পের অভূতপূর্ব আত্মীকরণ। অজ্ঞাত এক করুণ হাহাকার। তারকোভস্কি এখানে নিজেকে খুঁজেছেন, খুঁজেছেন তার বাবাকে। বাবার কবিতার মধ্য দিয়ে তারকোভস্কি স্মরণ করতে চেয়েছেন তার ফেলে আসা শৈশবকে। তিনি সব অচলায়তন ভাঙতে চেয়েছেন চলচ্চিত্র মিররে। অতঃপর তিনি ভেঙেছেন, জ্বালিয়েছেন ঘরবাড়ি, পুড়িয়েছেন মারুসির অন্তরাত্মা, বাধ্য করেছেন দেহ থেকে ধড় আলাদা করতে। ফলস্বরূপ, মিরর হয়েছে সোভিয়েত চলচ্চিত্র ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। তারকোভস্কির মাস্টারপিস।
মিররের পুরোটা দেখার পরও অদেখা থেকে যায়। কারণ, টাইম বা স্পেসের ফ্রেমিং ছাড়াই নির্মাতা তার বিবরণী সাজিয়েছেন। সারগেই আইজেনিস্তাইনের পর রাশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি। অবশ্য কারো কারো মতে আবার তিনিই প্রথম। তিনি একাধারে সিনেমার কবি, সিনেমার গৌতম বুদ্ধ। তিনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই করেন না, নির্মাণ করেন আধ্যাত্মিক সাধনাও। ট্রায়াল এন্ড এররে নির্মাতা মোট ৩২ বারেও যুতসই কাঠামোয় রূপ দিতে পারছিলেন না আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্রকে। অবশেষে ৩৩ তম সংস্করণে এসে সম্পন্ন হয় ছবির পোস্ট প্রোডাকশন। এখানে তারকোভস্কি, রবার্ট ব্রুসের মাকড়সা গল্পকেও হার মানিয়েছেন। মিরর এক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। খণ্ড খণ্ড দৃশ্যের একত্র সম্মিলন। বৃষ্টি, নদীর পানির কলকল শব্দ, জঙ্গল, আগাছা, প্রচণ্ড ঝড়ে ফসলের ক্ষেতে প্রবাহিত বাতাসের শব্দ কেন যেন ভীষণ তোলপাড় সৃষ্টি করে। জীবনকে স্মৃতির আয়নায় পুনরায় দেখা, এবং সেই স্মৃতিতে অবাধ যাতায়াতের মাঝেই বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে তার সম্পর্ক এখানে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। ননলিনিয়ার মিররে ইতিহাসের পাঠ চারিত হয়েছে নানাভাবে নানা লেয়ারে, কখনো বা নিউজ রিলের ফুটেজে। আবার কখনো তারকোভস্কিই জানান দেন,
The division of churches separated us from Europe. We remain excluded every great event that had shaken it.
চলচ্চিত্রটিতে শ্লথ লং টেইকের দৃশ্য সব। রয়েছে মুভিং ইমেজের প্রাচুর্য। আছে দুর্বোধ্যতা, আছে আপেক্ষিকতা। একে যেদিক থেকে দেখতে চাওয়া হোক না কেন, তা ভাবনার খোরাক যোগাবেই। তারকোভস্কি নিজেও হাজির হয়েছেন সেখানে। ন্যারেটর এলেক্সির মৃত্যুশয্যায় পাখিকে হাতের মুঠোতে রেখে যিনি উড়িয়েছেন তিনি যে পরিচালক নিজেই। শুরুতে বাবার অপেক্ষায় একা বসে ধূমপানরত মা। ট্রেন থেকে নেমে এসে যদি কেউ বাড়ির দিকে ঘোরে, তাহলে সে বাবা, আর না হয় অন্য কেউ। সেদিন অন্য কেউই এসেছিল। মধ্যবয়স্ক এক অপরিচিত ডাক্তার। ভুলপথে এসে খাতির জমাতে চেয়েছিল মায়ের সাথে। সিগারেট চেয়ে নিয়ে আলাপ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছিল। অতঃপর সেখানে দমকা হাওয়া বয়ে গেলে, মাচা ভেঙে পড়ে গেল মা আর ঐ অপরিচিত ব্যক্তি। তাদের পেছন থেকে ঘটনা অবলোকন করে যাচ্ছে এলেক্সি আর ছোট বোন মারিনা। হয়তো তাদের বাবা কোনো একদিন এই পথেই ফিরে আসবে!
সুইডিশ চলচ্চিত্রকার ইঙ্গমার বার্গম্যান ছিলেন তারকোভস্কির অনুপ্রেরণা। যদিও তাকে তিনি অনুসরণ করেননি। উল্টো বার্গম্যানের চোখে তারকোভস্কিই ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ফিল্ম চলচ্চিত্রকার। কারণ তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন নিরুপম নিজস্বতা। যে নিজস্বতা সর্বযুগের সকল চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের বিমোহিত করে। সেই বিবেচনায় মিররকে বলতে হবে তার নিজস্বতার শ্রেষ্ঠতম দালিলিক প্রমাণ। প্রায় শ’খানেক শটের আত্মজীবনীমূলক ছবিতে তিনটি কাল ফ্রেমবদ্ধ করেছেন পরিচালক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ১৯৩৫ সালের তার বাল্যকাল, যুদ্ধের সময় (১৯৪০), আর যুদ্ধপরবর্তী সত্তরের দশকের জীবনযাপন। প্রিন্টিং প্রেসের প্রুফ রিডার মা মারিয়ার জীবন সংগ্রামের গল্পও সেখানে স্থান করে নিয়েছে। কখনও দারিদ্র্য এড়ায়নি ক্যামেরার ফ্রেম থেকে। স্মৃতির আরশীতে তিনি দেখিয়েছেন অপূর্ব সব বিষয়বস্তু। গোলাকার দর্পণে দুধের জগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এলেক্সি, কিংবা ক্যামেরা একটু পিছিয়ে এসে ধূলিধূসর আয়নার প্রতিবিম্ব তৈরি করে আগুনের কুণ্ডলীর। সাথে দরজায় দাঁড়ানো ভয়ার্ত বাচ্চা দুটোকে দেখা যায়। এরপর ডিপ ফোকাসে কুয়োর পাশে বেঁধে রাখা বালতি থেকে জল তুলে নেয়ার দৃশ্য!
মুগ্ধকর বিচিত্র দৃশ্যাবলীর সমারোহ পারিবারিক এই ফিল্মে। হিপনোটিজমের আচানক এক দৃশ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের শুরু। পরবর্তীতে জাদুবিদ্যার প্রথম সিনে উপর থেকে প্লাস্টার খসে পড়ার দৃশ্যে মারিয়ার যে এক্সপ্রেশন, তা অপ্রত্যাশিত অথচ দুর্দান্ত! অনুরূপভাবে মুরগির শিরশ্ছেদের পর মারিরার সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দেয়া এক্সপ্রেশনটিও অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, এবং ভয় জাগানিয়া। একপর্যায়ে নকল গ্রেনেড দিয়ে বিস্ফোরণ আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু সময় যুদ্ধের উত্তেজনাও উপলব্ধি করা গেছে। তবে ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি বলে টুকরো টুকরো চিত্রের যোগসূত্র তৈরিতে দর্শক হিসেবে বেগ পেতে হয়েছে বেশ। কিন্তু এমন ভিন্নতা চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলীতে যোগ করেছে নতুন পালক। পছন্দ নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে একে কাহিনীচিত্র কিংবা বিমূর্তের সুনির্দিষ্ট তকমা দেয়ার কাজটি হয়ে গেছে কঠিন। নিজ দেশে নির্মাতার অটোবায়োগ্রাফিক্যাল ফিল্ম রিলিজের সময় ছিল প্রতিকূলতার নানা খড়গ। তথাপি এক্সপেরিমেন্টাল আর্টফিল্ম হিসেবে বিশ্বদুয়ারে পরিচিতি পেয়েছে রাশিয়ান এ সিনেমা। বিশ্বের গ্রেটেস্ট ফিল্মের বিভিন্ন জরিপে বিভিন্ন সময়ে মিরর স্থান দখল করে নিয়েছে। ২০১২ সালে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন সাইট এন্ড সাউন্ডে মিররকে রাখা হয়েছে গ্রেটেস্ট ফিল্মের তালিকার নবম স্থানে।
মিরর পরিমিতবোধের নিরিখে হয়ে উঠেছে বুদ্ধিদীপ্ত এক নির্মাণ। এই চলচ্চিত্র আবেগের, আক্ষেপের, হাহাকারের। এই চলচ্চিত্র হারানোর, বেদনার, অপেক্ষার। গল্পটি সময় পরিবর্তনের, জীবন সংগ্রামের। একদিকে আধুনিক ফিল্মস্কুলগুলোতে ব্যক্তি তারকোভস্কির শৈশব সার্বজনীন পাঠ্য হয়েছে চলচ্চিত্রটির কল্যাণে, অন্যদিকে বিশ্বসমাদৃত হয়েছে পরিচালকের নির্মাণকৌশল। ফলস্বরূপ, কালের আবর্তে তার নির্মাণশৈলী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন ডেনমার্কের লারস ভন ত্রেয়ার, হাঙ্গেরিয়ান বেলাতার, ভারতের আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত, ফরাসি ক্লেয়ার ডেনিসসহ অন্যান্য খ্যাতিমান বিশ্ব-চলচ্চিত্রের নির্মাতাগণ।
চলচ্চিত্র: Зеркало (Mirror)
পরিচালক: আন্দ্রেই তারকোভস্কি
জনরা: বায়োগ্রাফিকাল ড্রামা
সাল: ১৯৭৫