মাঝেমধ্যে সংকটের মুহূর্তগুলোতেও রসিকতা কিছুটা হলেও পরিস্থিতি সহজ করে দেয়। ঠিক যেমনটা করেছেন পরিচালক মার্টিন ম্যাকডোনাহ তার সাম্প্রতিক থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি সিনেমাতে। সন্তানহারা মায়ের বিচার চাওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়কেও তিনি ‘ডার্ক কমেডি’র মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন দারুণভাবে। ইন ব্রুশ, সেভেন সাইকোপ্যাথসখ্যাত ব্রিটিশ এই পরিচালকের নিজেরই লেখা এই ছবিটি তার পরিচালনাজীবনের সেরা কাজ তো বটেই, নিঃসন্দেহে ২০১৭ সালের সেরা সিনেমাগুলোর মধ্যেও অন্যতম।
সিনেমা শুরু হয় এবিংয়ের নির্জন ড্রিংকওয়াটার রাস্তার ধারে তিনটি বিশাল পরিত্যক্ত বিলবোর্ডের ওপর ক্যামেরা ঘুরিয়ে। তারপরেই গাড়ি চালিয়ে পর্দায় চলে আসেন মিলড্রেডরূপী ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড। আর রাস্তার পাশের মলিন হয়ে যাওয়া বিলবোর্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মাথায় খেলে যায় এক অদ্ভুত চিন্তা। সাত মাস হয়ে যাবার পরেও নিজের মেয়ের খুনিকে ধরার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয়তাকে কটাক্ষ করে মিলড্রেড নির্জন রাস্তার তিনটা বিলবোর্ড ভাড়া করে নিয়ে তাতে লিখে দেন, ‘RAPED WHILE DYING’, ‘STILL NO ARRESTS’, ‘HOW COME CHIEF WILLOUGHBY’।
টকটকে লালের ওপর কালো লেখাগুলো নজর কাড়ে সবার, প্রশাসনের টনক নড়ে প্রায় সাথে সাথেই, টিভি ক্যামেরা চলে আসতেও দেরি হয় না।
কাহিনী কিছুদূর এগোনোর পরে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয় কীভাবে মিল্ড্রেডের ১৬ বছরের ফুটফুটে কিশোরী মেয়েটি মায়ের সাথে চরম তর্কাতর্কি করে চলে যায় বন্ধুদের সাথে পার্টিতে। এবং এর কিছুক্ষণ পরেই মেয়েটির ধর্ষিত পুড়ে যাওয়া লাশটি খুঁজে পাওয়া যায় এবিং, মিসৌরির এক পরিত্যক্ত রাস্তায়। গল্প এত তীব্রভাবে শুরু হলেও দর্শককে খুব নাড়া দিতে পারে কি? কে জানে, হয়তো পারে না। আজকাল তো ধর্ষণ পরবর্তী খুন সবারই প্রায় গা সওয়া হয়ে গেছে। ধর্ষণের পর খুন করে রেললাইনের কাছে টুকরো হয়ে পড়ে থেকে কিংবা ধর্ষণের বিচার চাওয়ার অপরাধে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করার পরে খুন হয়েও কোনো মেয়ে আদৌ দীর্ঘস্থায়ীভাবে প্রশাসনের মনোযোগ পায় কি?
যাকে উদ্দেশ্য করে বিলবোর্ডের কথাটা লেখা, সেই পুলিশ চিফ, উইলিয়াম উইলোবি, অবশ্য রগচটা কোনো মানুষ নন। মিলড্রেডের মেয়ে, অ্যাঞ্জেলা হেয়েসের খুনিকে খোঁজার জন্য নিজের চেষ্টায় মোটামুটি সন্তুষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত হয়ে মিলড্রেডের কাছে সরাসরি কথা বলেই এ ব্যাপারে মীমাংসার চেষ্টা করতে থাকেন। মিলড্রেডের অবশ্য তেমন কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশও নেই তার প্রতি। বিশেষ এক কারণে স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে সুখী জীবন যাপন করা উইলোবির প্রতি শহরের সবাই কিছুটা সহানুভূতিশীলও। নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান, কিংপিন, হাঙ্গার গেমস সিরিজ খ্যাত উডি হ্যারেলসন এমনিতে রুক্ষ চেহারার হলেও, সহানুভূতিশীল আর কিছুটা ক্লান্ত চিফ উইলোবির ভূমিকায় চমৎকার ছিলেন।
দর্শককে পুরোপুরি দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়ার জন্য একইসাথে পর্দায় থাকেন ডেপুটি জেসন ডিক্সন। সিনেমার কাহিনী যে কিছুটা তাকে কেন্দ্র করেও ঘুরছে তা বললে ভুল হবে না। মদ্যপ, গোঁয়ার, কিছুটা আহাম্মক এবং চরম মাত্রার বর্ণবাদী ডিক্সন মুখখারাপ করে গালি দিয়ে গেলেও দর্শককে তার চরিত্রের গভীরে যেতে সাহায্য করে স্যাম রকওয়েলের সুনিপুণ অভিনয়। মধ্যবয়সেও মায়ের প্রভাব থেকে বের হতে না পারা ডিক্সনের মধ্যে ষাটের দশকের ক্লাসিক সাইকো’র নরম্যান বেটসেরও ছায়া মেলে। কমিক বইয়ে ডুবে থাকা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে শিশুসুলভ বেয়াড়াপনা করা ডিক্সনের আক্রমণাত্মক চেহারার আড়ালের আসল মানুষটাকে চিনতেন চিফ উইলোবিই। তার অনুপ্রেরণাতেই মূলত ডিক্সনের প্রায়শ্চিত্তের কাহিনী শুরু হয়। এর আগেও বিভিন্ন মুভিতে ‘ব্যাড বয়’মার্কা চরিত্র করা রকওয়েল এই চরিত্রটির সাথে দারুণভাবে মিশে গেছেন।
তবে কাহিনী চলতে থাকে শোককে শক্তিতে পরিণত করা মিলড্রেডের কাঁধে ভর করে। সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে মিলড্রেডের মনের মধ্যে চলা রাগ, ঘৃণা, অসহায়ত্ব- সবকিছুর অসাধারণ রূপায়ন ঘটিয়েছেন ম্যাকডরম্যান্ড। কারো মুখের কথা মাটিতে পড়ার আগেই এমনভাবে তার ব্যঙ্গাত্মক জবাব দিয়ে দেন যে, বিপক্ষের কথা হারিয়ে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। স্পষ্টবাদী আর কিছুটা নির্বিকার মিলড্রেডের চাঁছাছোলা কথার হাত থেকে রেহাই নেই কারো, হোক সে পুলিশ কিংবা ক্যাথলিক গির্জার পাদ্রী। নিজের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোয় হরিণ কিংবা নিজের ফুলতোলা জুতোর সাথে কথা বললেও একবারও তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে দেখা যায়নি। ম্যাকডরম্যান্ডের মতে, চোখের পানি ফেলে হালকা হবার ক্ষমতাটাই নেই মিলড্রেডের, মনুষ্যত্বকে দমিয়ে দিয়েছে ঘৃণা আর আক্রোশ।
এই তিন মূল চরিত্রকে পর্দায় যোগ্য সমর্থন দিয়েছেন অন্য অভিনেতারা। গেট আউট আর এক্স-ম্যান: ফার্স্ট ক্লাসখ্যাত ক্যালেব ল্যানড্রি জোনসের রেড ওয়েলবি চরিত্রটি ছোট হলেও প্রভাব ফেলেছে সবার মনে। সম্প্রতি ম্যানচেস্টার বাই দ্য সি আর লেডি বার্ডের মতো সিনেমাগুলোয় অভিনয় করা সম্ভাবনাময় তরুণ অভিনেতা লুকাস হেজেস মিলড্রেডের বাধ্যগত এবং কিছুটা অবহেলিত ছেলে রবি হেয়েজের চরিত্রে নিখুঁত অভিনয় করেছেন। এছাড়াও উইন্টার’স বোন, মার্থা মার্সি মে মারলিনয়ের জন হকস, গেম অফ থ্রোনসের পিটার ডিংকলেজ কিংবা সাকার পাঞ্চখ্যাত অ্যাবি করনিশ সবাই ছিলেন নিজ নিজ চরিত্রে সাবলীল।
তবে ম্যাকডোনাহর লেখনীকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তার চিত্রনাট্যের মারপ্যাঁচে কোনো চরিত্রকেই দর্শক একনাগাড়ে সমর্থন করে যেতে পারবে না। সবগুলো চরিত্রই বহুমাত্রিক, কাউকেই যেমন মোটা দাগে বিচার করা যায় না, তেমনি কাহিনীও হয়ে পড়ে আনপ্রেডিক্টেবল। সেই সাথে সিরিয়াস আর কমেডি দুই ক্ষেত্রেই দারুণ ভারসাম্য বজায় রেখেছেন, তাই ১০৫ মিনিটের সিনেমাটি কখনোই একঘেয়ে হয়ে যায়নি।
সিনেমাটিকে অনবদ্য করে তুলতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে এর ধারালো এবং বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ। হয়ত ক্ষণে ক্ষণে অ্যাকশন বা টুইস্ট নেই, কিন্তু বিভিন্ন দৃশ্যে সংলাপের চালাচালি দর্শককে মনোযোগ হারাতে দেয় না একেবারেই। কার্টার বারওয়েলের দারুণ মিউজিক্যাল স্কোর ছাড়াও মুভিতে ব্যবহৃত বেশ কিছু গান বিভিন্ন দৃশ্যতে এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। বাকস্কিন স্ট্যালিয়ন ব্লুজ গানটি মুভির শুরুতে শোনা যায় টাউনস ভ্যান জ্যাটের কণ্ঠে, আর মুভির শেষে অ্যামি অ্যানেলের কণ্ঠে, নিরাশা আর আশার পার্থক্য যেন স্পষ্ট করে ধরিয়ে দেয় দর্শকের কাছে।
ডিক্সন রেডের অফিসে যাবার সময় বাজতে থাকে ‘রিরাইট দ্য বাইবেল’ গানটি, গানের কথাগুলোও তার মনের ভাব পুরোপুরি প্রকাশ করে দেয়, সে চিফ উইলোবির পক্ষে থাকার জন্যই খারাপ কাজটা করে। ঠিক তেমনই রাতের বেলায় ডিক্সনের থানায় যাবার দৃশ্যে ‘লাস্ট রোজ অফ সামার’ নামের শান্ত গানটিও শঙ্কা ফুটিয়ে তোলে। মুভির আরেকটি শক্তিশালী দিক এর সিনেমাটোগ্রাফি। মিসৌরির মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্যামেরায় ফুটে উঠেছে দারুণভাবে। লাল রঙের ব্যবহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে দারুণভাবে, হোক সে লাল বিলবোর্ড, টবে পোঁতা লাল ফুল কিংবা ডিক্সনের ঘরের লাল টেলিফোন।
সেলুলয়েডের পর্দায় দেখা এই কাহিনীর পেছনে বড় আকারে প্রভাব ফেলেছে ২৭ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা। ১৯৯১ সালের ১৪ই মে টেক্সাসের ভিডোরে ৩৪ বছর বয়সী দুই সন্তানের জননী ক্যাথি পেজ নিখোঁজ হন। পরে এক ডোবা থেকে তার গাড়িটি উদ্ধার করা হয়, ভেতরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ক্যাথিকে। তদন্তের পরে প্রশাসন ঘোষণা করে, ধর্ষণের পরে তাকে গলা টিপে হত্যা করে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়। তার কিছু পরেই ক্যাথির বাবা জেমস ফুলটন স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে কটাক্ষ করে বিলবোর্ড টানিয়ে দেন লস এঞ্জেলস থেকে ফ্লোরিডাগামী রাস্তায়। ২০০০ সালে ক্যাথির প্রাক্তন স্বামী স্টিভ পেজকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে ঘোষণা করা হলেও মামলার মীমাংসা হয়নি এখনও। জেমস ফুলটনের বয়স এখন ৮৬, বিলবোর্ডগুলোর বয়স হয়ে গেছে প্রায় ত্রিশ বছর। তিনি বলেছেন, যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন বিলবোর্ডগুলোও থাকবে।
গেল বছরের নভেম্বরে মুক্তি পাবার পরপরই দর্শক-সমালোচকদের কাছে দারুণভাবে সাড়া ফেলে দেওয়া এই মুভিটি সব মিলিয়ে পুরষ্কারের মনোনয়ন পায় ১৯৭টি আর জিতে নেয় তার মধ্যে ১০৭টি। মুভিজগতের সবচাইতে বড় সম্মান অস্কারে পায় ৬টি মনোনয়ন। ১৯৯৭ এ ফার্গোতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য প্রথম অস্কার জেতা ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড এবার মিলড্রেড হেয়েসের ভূমিকায় অতুলনীয় অভিনয় করে দ্বিতীয় দফায় বাগিয়ে নেন সেরা অভিনেত্রীর অস্কার। এর আগে মুন, সেভেন সাইকোপ্যাথস, কনফেশনস অফ এ ডেঞ্জারাস মাইন্ড, গ্রিন মাইলে দুর্দান্ত অভিনয়ের পরও সমালোচকদের দৃষ্টিচক্ষুর কিছুটা অন্তরালে থাকা স্যাম রকওয়েল অবশেষে জেসন ডিক্সন নামের রগচটা পুলিশের ভূমিকায় অভিনয় করে পেয়ে যান সেরা সহ অভিনেতার অস্কারটি। আইএমডিবিতে ১০ এ ৮.২ আর রটেন টম্যাটোসে ৯২% ফ্রেশ রেটিং পাওয়া মুভিটি অনেকের মতে বেস্ট পিকচার অস্কারের জন্যও যোগ্য দাবিদার ছিলো।
মাত্র ১২ মিলিয়ন বাজেটের মুভিটি বক্স অফিসে ১৫৮.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে প্রমাণ করে যে, যুগোপযোগী হলে ড্রামা মুভিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। মুভিতে দেখানো বিলবোর্ডের ভাষায় ফ্লোরিডায় স্কুল শুটিংয়ে নিহতদের জন্য বিচার চেয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। এদিকে ইউনিয়ন অফ মেডিকেল কেয়ার এন্ড রিলিফ অর্গানাইজেশনও জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিলবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে। জীবনঘনিষ্ঠ কোনো চলচ্চিত্রের সার্থকতা আসলে এখানেই।