চারটি আলাদা গল্প নিয়ে একটি ইমোশনাল রোলার কোস্টার ‘সুপার ডিলাক্স’। কখনো চোখ ভিজে উঠবে, আবার তৎক্ষণাৎ হাস্যকর সংলাপে দর্শক নিজেই হেসে উঠবেন। ডার্ক কমেডি জনরার এই সিনেমাকে অনেকে সেরা বিদেশী চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে অস্কারের মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য বলেও মনে করেন।
ভেম্বু আর মুকিলের নতুন সংসারে সব মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু বিয়ের পরেও পুরনো প্রেমিকের সাথে ভেম্বুর যোগাযোগ ছিল। স্বামীর অবর্তমানে প্রেমিক, কান্নাম্মাকে বাড়িতে এসে ঘুরে যেতে বলে ভেম্বু। দুজন অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর কিছুক্ষণ পরই ভেম্বু বুঝতে পারে, কান্নাম্মা মারা গেছে। সে কিছুক্ষণ আগেই যার বুকে শুয়ে ছিল, এখন সে লাশ হয়ে তার পাশে শুয়ে আছে। স্বামী মুকিল বাড়ি ফিরে আবিষ্কার করে কান্নাম্মার লাশ ।
পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এ লাশের ব্যবস্থা করা যাবে, এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর তর্ক বিতর্ক চলতে থাকে। তবে কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যায় হয়। তেমনটাই হলো মুকিল আর ভেম্বুর ক্ষেত্রেও। স্বামী-স্ত্রীর এই লাশ লুকানোর অভিযান দিয়েই এগোতে থাকে গল্প।
দ্বিতীয় গল্পে আছে, পাঁচ বয়সন্ধিকাল পার করা বন্ধুর গল্প। সকলে মিলে একদিন ঠিক করে, পর্ন সিনেমা দেখবে। গ্রুপ স্টাডির নাম করে বেরিয়ে কেনা হলো চিপস আর সোডা। পাড়ার মোড়ের দোকানের আন্টির কাছ থেকে বেশ কষ্টে সিনেমা কিনেই চলে গেল বন্ধুর বাড়িতে। চোখে থ্রিডি চশমা লাগিয়ে টুডি সিনেমা দেখতেই বসে গেল সবাই।
সিনেমার শুরু হতে না হতেই বন্ধুমহলের একজন আবিষ্কার করল তার জীবনের সবচেয়ে বড় তেতো সত্য। বন্ধুদের সামনে এ সত্য উদ্ঘাটন সহ্য করতে পারছিল না সে। চিৎকার করে বেরিয়ে পড়ে, আর পা বাড়ায় জীবনের আরেক ভুলের দিকে। অন্যদিকে বন্ধুরা তাকে এ সমস্যা থেকে তুলে আনতে গিয়ে, নিজেরাই আরেক মৃত্যুফাঁদে আটকে যায়।
পাঁচ বছর বয়সী রাসকুট্টির আজ ভীষণ আনন্দের দিন। জন্মের পর থেকে সে তার বাবাকে দেখেনি। দীর্ঘদিন ধরে বাড়ির বাইরে কাজে ব্যস্ত বাবা আজ বাড়ি ফিরবে বলে রাসকুট্টির অনেক আয়োজন। বাবাকে স্কুলের বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে তার উপর হওয়া সকল মানসিক অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়া হবে আজ। রাসকুট্টির মা স্বামীর জন্য নিজেকে একটু তৈরি করে নিলেন। বাড়ি ভর্তি মানুষ, সবাই প্রতি বছর রাসকুট্টির বাবার অপেক্ষায় থাকেন, আজ তার আসার কথা। দিনের পর দিন মানুষটা ভরণ পোষণ করে গেছেন ঠিকই, কিন্তু জন্মের পর তার ছেলেকে দেখতেও একবারের জন্য আসেননি।
সাড়ে সাত বছর পর বাড়ি ফেরেন রাসকুট্টির বাবা। পরনে শাড়ি-গয়না, চোখে রোদ-চশমা, মাথা ভর্তি লম্বা চুল আর মুখ ভর্তি মেকাপ। সবার চোখ কপালে উঠে গেল এক মুহূর্তেই। একমাত্র খুশি রাসকুট্টি। বাবা কেমন দেখতে, বাবা কী পরে আছে, তাতে তার কিছু যায় আসে না। বাবা বাড়ি ফিরেছে, এটাই তার একমাত্র কথা।
কিন্তু সমাজ রাসকুট্টির বাবা, একজন তৃতীয় লিঙ্গকে এত সহজে মেনে নিতে নারাজ। গল্প এগোতে থাকে আর একজন তৃতীয় লিঙ্গের জীবনের দুর্দশা পর্দায় ভেসে ওঠে।
আরপুথামকে গ্রামে ঈশ্বরের ডানহাত হিসেবে গণ্য করা হয়। এক ভয়ানক ঝড়ে যখন কেউ বাঁচতে পারেনি, এক মূর্তি আগলে ধরে আরপুথাম বেঁচে ফিরেছিলেন মৃত্যুকে জয় করে। সে মূর্তিকেই ঈশ্বররূপে পূজা করতে শুরু করেন তিনি। আর সেই সাথে পুরো গ্রামের চোখে আরপুথাম হয়ে যান ঈশ্বরের দূত। প্রতিদিন অনেকেই তার কাছে আসে মৃত্যুপথযাত্রী স্বজনকে বাঁচিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে। কিছু অর্থের বিনিময়ে খোদ ঈশ্বর সকল রোগ নিরাময় করবেন, এ বিশ্বাস আরপুথাম আর তার চেলা রামাস্বামীর।
একদিন ঈশ্বরের এই দূতের নিজের ছেলেই এক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায়, অনেক অর্থের প্রয়োজন ছেলের অপারেশনের জন্য। একদিকে ছেলের জীবনরক্ষা, অন্যদিকে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রেখে চিকিৎসাশাস্ত্রে অবিশ্বাস করা আরপুথাম কি শেষ পর্যন্ত ছেলের জীবন ফিরিয়ে আনতে পারবে?
চার গল্পই শেষে এসে একে অপরের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে। ‘সুপার ডিলাক্স’ সিনেমার সিনামাটোগ্রাফি চমৎকার। প্রত্যেক দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডেই ভারতের কোনো না কোনো সিনেমার পোস্টার দেখা যায়। চরিত্র রাস্তায় হেঁটে চলেছেন, দূরের চায়ের দোকানের রেডিওর হালকা শব্দ ভেসে আসে কানে। সবমিলিয়ে পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন নির্মাতা।
থিয়াগর্জন কুমারারাজার আরেকটি বিখ্যাত সিনেমা ‘অরণ্য কান্দাম’-এর জন্য তিনি সেরা নির্মাতা হিসেবে পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। তারপরই নিজের লেখা গল্প ‘সুপার ডিলাক্স’ পর্দায় নিয়ে আসেন কুমাররাজা। এই সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছেন বিজয় সেথুপথি, যিনি ভাসকুট্টির বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আর সেই সাথে রাসকুট্টি চরিত্রের ছোট্ট অভিনেতা নোবেল কে. জেমস সবার মনে জায়গা করে নিয়েছে।
মুকিল চরিত্রে ছিলেন ফাহাদ ফাসিল; আর তার সাথে জুটি বেধেছেন দক্ষিণী নায়িকা সামান্থা। পর্দায় দুজনের রসায়ন ছিল বেশ জোরাল। সুপারহিট সিনেমা ‘বাহুবলি’র শিবগামী চরিত্রে অভিনয় করা রামা কৃষ্ণা এ সিনেমায় আবারো একজন মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে তার চরিত্রের বাঁকে রয়েছে বিশাল চমক। এমনিতে এ সিনেমায় সকলেই নিজ নিজ চরিত্রে শতভাগ সফলভাবে অভিনয় করেছেন, যা দর্শকের নজর কাড়তে বাধ্য।
‘সুপার ডিলাক্স’কে শুরুতে অ্যান্থলজি মনে হলেও এটি আদতে ইন্টারলিংকড সিনেমা। অর্থাৎ, সব গল্প শেষে এসে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। প্রত্যেক গল্পের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আর সুন্দর সমাপ্তি এ সিনেমাকে তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সফল সিনেমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৮+। সাউথের মুভিখোর হলে অবশ্যই সিনেমাটি দেখা হয়েছে, আর যদি না দেখা হয়ে থাকে তবে সময় করে দেখে ফেলতে পারেন।