Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রং দে বাসন্তী: হাসতে হাসতে জীবন দেয়া ক’জন তরুণের গল্প

তরুণরা চাইলেই যে সবকিছু বদলে দিতে পারে সেটা ইতিহাস বার বার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। ২০১৮ তে এসেও এদেশের সূর্যসন্তান কিশোর-তরুণ স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আরেকবার তা দেখিয়ে দিল আমাদের। আজকের দিনে তাই বারবার ‘রঙ দে বাসন্তী’ মুভিটার কথা মনে পড়ছে। বর্তমান সময়ের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে এই মুভির চিত্রনাট্য অনেকটাই মিলে যায়। আর তাই ২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির রিভিউ ২০১৮-তে এসে নতুন করে লিখতে বসা। 

বাসন্তী মানে হচ্ছে জাফরান। ভারতে এই বাসন্তী অর্থাৎ জাফরান হচ্ছে ত্যাগের প্রতীক। আর তাই রঙ দে বাসন্তী হলো মহান কিছুর জন্য আত্মোৎসর্গ করা। এই রঙ দে বাসন্তী শুধু বলিউডের নকশাই পাল্টে দেয়নি, সেই সাথে ভারতে দেশপ্রেমের নতুন এক ধারণার জন্মও দিয়েছিল। এর সুবাদে দেশপ্রেমকে নতুন করে বুঝতে শিখেছিল ভারতের তরুণেরা।

‘রং দে বাসন্তী’ মুভির পোস্টার; সোর্স: আইএমডিবি

পাঁচজন তরুণ ডিজে (আমির খান), কারান (সিদ্ধার্ত), সুকি (সারমান জোসি), আসলাম (কুনাল কাপুর) এবং পান্ডে (অতুল কুলকার্নি); তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া গল্প নিয়েই ‘রং দে বাসন্তী’র চিত্রনাট্য। ডিজে, কারান, সুকি ও আসলামের কাছে দুনিয়া হচ্ছে মাস্তি কি পাঠশালা। জীবনটা উপভোগ করে যাওয়াই তাদের কাছে সব। মৌজ মাস্তি, রং তামাশাই তাদের কাছে তারুণ্যের উদযাপন। এর বাইরে রাষ্ট্র-রাজনীতি, দেশ এসব নিয়ে ভাববার সময় তাদের নেই। বরং দেশ-রাজনীতি এসব তারা হাসি-ঠাট্টার বিষয় মনে করে। এভাবেই আনন্দ, হৈ-হুল্লোড় করে ওদের জীবন কাটছিলো। সিনেমায় মাস্তিতে মেতে থাকা এই তরুণদের পাশাপাশি দেখানো হয় আরেক চরিত্র, যার নাম পান্ডে। পান্ডে এক রাজনৈতিক দলের সদস্য। সে মনে করে, এই মৌজ-মাস্তি করা তরুণেরাই দেশকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে, দেশের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বিদেশি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে।

রঙ দে বাসন্তী সিনেমার একটি দৃশ্য; সোর্স: The University of Iowa

এদিকে দাদার ডায়েরিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ৫ শহীদের সংগ্রামের কাহিনী পড়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরির উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসে সু (এলিস)। সু’র ভারতীয় বন্ধু সোনিয়ার (সোহা আলী খান) মাধ্যমে এই পাঁচ তরুণের সাথে পরিচয় ঘটে সু’র। ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসা সু এদেরকে দিয়েই নিজের ডকুমেন্টারি ফিল্ম করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফিল্ম বানানোকে কেন্দ্র করে ভিন্ন আদর্শের পান্ডেও ধীরে ধীরে ডিজেদের কাছাকাছি আসতে শুরু করে। এভাবেই এগোতে থাকে সিনেমার কাহিনী। কিন্তু ছবির কাহিনী ভিন্ন বাক নেয় বিমান বাহিনীর মিগ-২১ ক্র্যাশে সোনিয়ার বয়ফ্রেন্ড ফ্লাইট লেফটেনেন্ট অজয়ের (মাধাবান) মৃত্যুতে। অজয়ের মৃত্যু মোড় ঘুরিয়ে দেয় ডিজেদের জীবনেও। 

অজয়ের মৃত্যুর পর সরকার ঘোষণা করে, পাইলটের ত্রুটির কারণেই মিগ-২১ ক্র্যাশ হয়। কিন্তু মূলত দক্ষ পাইলট অজয় শহরের অসংখ্য লোকের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলো। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও আমলাদের দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশ থেকে কেনা সস্তা ও ত্রুটিযুক্ত মিগ-২১ এর কারণেই ঘটে সেই দুর্ঘটনা। আর এর সাথে জড়িত ছিলো দুর্নীতিবাজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী শাস্ত্রী (মোহন আগাসে) ও কারানের বাবা রাজনাথ সিংনিয়া (অনুপম খের)।

ডিজে ও কারানরা শুরু করে এক নতুন আন্দোলন। কিন্তু পুলিশের লাঠিচার্জে প্রতিবাদ সভা ভেঙে যায়। অজয়ের মা (ওয়াহিদা রেহমান) গুরুতর আহত হন এবং কোমায় চলে যান। ন্যায়বিচার না পেয়ে ডিজে, কারান, সুকী, আসলাম ও পান্ডে সিদ্ধান্ত নেয় তারা নিজেরাই এর বিচার করবে। তারা নিজেদের হাতেই আইন তুলে নেয়। অজয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা হত্যা করে প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে, কারান নিজ হাতে খুন করে তার দুর্নীতিগ্রস্ত বাবাকে।

কিন্তু একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীকে হত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না। তারা বুঝতে পারে, বদলাতে হলে বদলাতে হবে পুরো সিস্টেম, বদলাতে হবে নিজেদের। মুভির একটি উক্তি মন ছুঁয়ে যায়, “নেতা আসমান থেকে টপকে পড়ে না, আমাদের মধ্য থেকেই তারা আসে। আমরাই তাদের নেতা বানিয়েছি। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে আমরাও দুর্নীতিগ্রস্ত!” 

অজয়ের মৃত্যুর ন্যায় বিচারের দাবিতে আন্দোলনের দৃশ্য; সোর্স: moviekoop

রং দে বাসন্তী’ ছিল রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি। এটি ২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে মুক্তি পায়। ২.৫০ মিলিয়ন রুপি বাজেটের চলচ্চিত্রটি ভারতের বক্স অফিসের আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেয় এবং প্রথম দিনে সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। রাকেশ মেহরা তার প্রথম ছবির পর  দীর্ঘ একটা বিরতি নিয়ে পাঁচ বছর পর ‘রং দে বাসন্তী’ নিয়ে হাজির হন তিনি এবং এই ছবিতেই দর্শকদের অভূতপূর্ব সাড়া পান

প্রথম দফায় সিনেমাটির নাম কিন্তু ‘রং দে বাসন্তী’ ছিলো না। প্রথমে ‘আহুতি’ নামটা পছন্দ ছিল পরিচালক রাকেশ ওম প্রকাশ মেহরার। সেখান থেকে ‘দ্য ইয়ং গানজ অব ইন্ডিয়া’ নামটি পছন্দ হয়। পরবর্তীতে চিত্রনাট্যে কিছুটা পরিবর্তন এনে নাম রাখা হয় রং দে বাসন্তী।

মুক্তির আগেই সিনেমাটি নিয়ে যথেষ্ট আপত্তির সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ‘মিগ-২১’ কেলেঙ্কারির ইস্যুতে বেঁকে বসে। এমনকি বেঁকে বসেছিল খোদ সেন্সর বোর্ডও। শেষপর্যন্ত ভারত সরকারের তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখার্জী, যিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, তার জন্য বিশেষ স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রণব মুখার্জী সিনেমাটি দেখে কোনো আপত্তি করেননি, আর তাই সেন্সর বোর্ড ও পরে তাদের সকল আপত্তি তুলে নেয়। 

ছবিটি মুক্তির পর ভারতের সামাজিক জীবনে তা গুরুত্বপূর্ণ এক প্রভাব ফেলে। এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম সবজায়গায় তরুণরা রাজনীতি, দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে নিজেদের অংশগ্রহণ বাড়াতে থাকে ও সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এছাড়া ভারতের সে সময়কার চাঞ্চল্যকর মার্ডার কেস মডেল জেসিকা লাল হত্যা মামলাতেও ভূমিকা রাখে রং দে বাসন্তী। এই সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জেসিকার বন্ধুরা ইন্ডিয়া গেটে মোমবাতি হাতে নিয়ে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এর পরে অবশ্য এই জেসিকা হত্যাকান্ড নিয়ে ২০১১ সালে ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’ নামে নতুন একটি সিনেমাও নির্মিত হয়।

মুভির এক দৃশ্যে সোনিয়া ও অজয়ের সাথে তার বন্ধু ডিজে ও কারান রা; সোর্স: pallavisinghal

‘রং দে বাসন্তী’ সিনেমায় রাজনীতি, ইতিহাস, বন্ধুত্ব, কমেডি সবই আছে। কিন্তু যেটা সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে সেটা হলো তারুণ্য, তারুণ্যের জয়গান। হাসতে হাসতে জীবন দিতে প্রস্তুত এই পাঁচ তরুণের গল্পের মাধ্যমে ভারতের তরুণেরা আবার নতুন করে জেগে ওঠে। এক নতুন দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয় তারা।

রঙ দে বাসন্তী চলচ্চিত্রে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির সাবেক অফিসার ম্যাককিনলের ডায়রির একটা উদ্ধৃতি দর্শকদের হৃদয় নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

‘আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম, পৃথিবীতে দুই প্রকার মানুষ আছে- এক. যারা আর্তনাদ করতে করতে মৃত্যুবরণ করে আর দুই. যারা নীরবে মৃত্যুবরণ করে। তারপর আমি তৃতীয় প্রকারের দেখা পেলাম। এই তিন নম্বর হচ্ছে তারা, যারা  ত্যাগের আনন্দে হাসতে হাসতে মৃত্যুবরণ করে।  

Related Articles