অ্যালাইসা আর জেমসের কথা মনে আছে তো? নিজেকে সাইকোপ্যাথ বলে দাবি করে উদ্ভট ও অমানবিক কর্মকান্ডে মেতে থাকা সতেরো বছর বয়সী কিশোর জেমস আর আশেপাশের সব মানুষের উপর আকাশ সমান অভিমান মনে পুষে, সারাক্ষণ চেহারায় চরম বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে রাখা মায়াবী চেহারার কিশোরী অ্যালাইসাকে কি এত সহজে ভোলা সম্ভব? নিষ্ঠুর এ পৃথিবীটা যেন তাদের দুজনের বেলায় আরো বেশি নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল৷ তাদের শৈশবকাল পাড়ি দিয়ে কৈশোরকালে পা রাখার যাত্রাটা তাদের সমবয়সী অন্য যে কারো থেকে বেশ ব্যতিক্রম ছিল। অল্প বয়সে আপন কাউকে নিজের জীবন থেকে হারানোর মতো যন্ত্রণা দুজনেই বুকের ভেতর ধারণ করে বেঁচেছিল। এছাড়া সুন্দর ও সাজানো পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠার অভাব তো আছেই। ছোটকালে মাকে হারিয়ে বাবার চোখের মণি হওয়ার পরেও জেমস যেমন অনাদরে ভুগত, তেমনি বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর মায়ের নতুন সংসারে মায়ের ছায়াতে থাকার পরেও অসহায়ত্ব আঁকড়ে ধরে রেখেছিল অ্যালাইসাকে।
আর নিয়তির টানে যখন তারা দুজন একই সুতোর বাঁধনে আটকা পড়েছিল, তখন সূচনা হয়েছিল এক নির্মম পরিহাসের অধ্যায়৷ একটুখানি সুখ ও স্বাধীনতার সন্ধানে পরস্পরের হাত ধরে ঘর ছেড়ে গন্তব্যহীনভাবে ছুটতে থাকা এ জুটির কপালে স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোনো নামচিহ্নই যেন ছিল না। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে অতীতকে পেছনে রেখে অবিরত সামনে ছুটতে থাকতে থাসময় তারা এসে পৌঁছায় নিষ্ঠুর পৃথিবীর শেষপ্রান্তে! কিন্তু এটাই কি তাদের গল্পের সমাপ্তি ছিল? নাকি এ শেষপ্রান্তে এসে তাদের জীবনের নতুন কোনো গল্পের প্রারম্ভ ধ্বনি বাজতে শুরু করেছিল?
উপরে এতক্ষণ ধরে বলছিলাম গত বছরের বেশ আলোড়ন ধরা ডার্ক কমেডি ঘরানার ওয়েব সিরিজ ‘The End of the f**king world’ এর প্রধান দুই চরিত্রের কথা। সম্প্রতি সিরিজের দ্বিতীয় সিজন রিলিজ পেয়েছে৷ আর গত সিজনের কাহিনী যেখানে এসে ইতি টেনেছিল তার ধারবাহিকতা বজায় রেখেই নতুন সিজনের কাহিনী নতুন ছন্দে এগিয়ে গিয়েছে৷
গত সিজন যারা দেখেছেন, তাদের তো সিজনের শেষটা কেমন ছিল মনে থাকার কথা। জেমস আর অ্যালাইসার অদ্ভুত কিন্তু খাঁটি প্রেমের গল্পের পরিণতি নিয়ে কেমন যেন একটা ঘোলাটে ধারণা দিয়ে সিজনটার সমাপ্তি টানা হয়েছিল। যেহেতু সিরিজটির চিত্রনাট্য কমিক রাইটার চার্লস এস. ফোর্সম্যানের একই নামের গল্পের অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে, সেহেতু সেই গল্পের অনুরূপেই এর প্রথম সিজনটা সাজানো হয়েছিল৷ প্রথম সিজনের চিত্রনাট্যকার ছিলেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী, লেখিকা ও প্রযোজক চার্লি কোভেল৷ প্রথম সিজনের দর্শক ও সমালোচক উভয় শ্রেণীর মধ্যে সাড়া জাগানোর ফলে সিরিজের নির্মাতা জোনাথান এন্টউইসেল দ্বিতীয় সিজন নির্মাণের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠেন। কিন্তু বইয়ের গল্প তো সম্পূর্ণটাই প্রথম সিজনে তুলে ধরা হয়ে গিয়েছিল৷ তাই এবার তিনি চিত্রনাট্যকার কোভেলকে স্বতন্ত্রভাবে গল্প লেখার প্রস্তাব দেন। আর কোভেলের লেখা নতুন চিত্রনাট্য থেকেই নতুন সিজনের সৃষ্টি হয়। তবে পরিচালনার দায়িত্বে জোনাথান এন্টউইসেল ও লুসি চেমাইয়াকের পরিবর্তে এবার ছিলেন লুসি ফোর্বস ও ডেসটিনি।
এবারের সিজনের শুরুটা বেশ চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয়। সিরিজের গল্পে নতুন এক চরিত্রের আগমনের মধ্য দিয়ে নতুন এক আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন গল্পকার।
এ সিজনে দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে বনি নামের নতুন চরিত্রের সাথে। প্রথম সিজনে জেমস ও অ্যালাইসা যেমন দর্শকদের সামনে নিজেদের ভাষ্যে নিজেদের গল্প তুলে ধরেছিল, এ সিজনে বনির ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। বনি একে একে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের গল্প মেলে ধরতে থাকে। তার পরিবার, তার মা-বাবা, তার স্কুল জীবন ও তার স্বভাব চরিত্রের সাথে এ সময় বেশ স্পষ্ট ধারণা পেতে আরম্ভ করবেন দর্শক। এমনকি আমার মনে হয়েছে, জেমস ও অ্যালাইসা থেকেও অনেক বেশি গভীর ও বিশ্লেষিত করে বনির গল্প বর্ণনা করা হয়েছে।
মা-বাবার সংসারে একমাত্র কন্যা ছিল বনি। মায়ের মেয়েকে নিয়ে দুচোখ ভরা স্বপ্ন। মেয়ে বড় হয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। বনির মা নিজে অল্প বয়সে মা হতে চলেছিলেন বলে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই মেয়েকে দিয়ে নিজের অধরা স্বপ্ন পূরণে প্রাণপণে উঠে পড়ে লেগেছিলেন৷ তাই অন্যান্য শিশুদের মতো হেসে খেলে বড় হওয়ার সুযোগ পায় না বনি৷ সেই ছোটকাল থেকে তার রুটিনমাফিক জীবন। স্কুলে তো নিয়মনীতির মধ্যে থাকতেই হতো, বাসাতেও মায়ের নিয়ম কানুনের কোনো অন্ত ছিল না। পড়াশোনার ক্ষেত্রে তো তার কড়াকড়ি ছিলই, এমনকি খাওয়াদাওয়ার বেলাতেও তার বিশেষ নজরদারি ছিল। আর এভাবে মায়ের পরিচালনায় নিজের জীবনের চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে বনির আত্মিক সত্ত্বার অধঃপতন হতে শুরু করে। নিজের চারপাশের সাদাকালো সত্যকে ভুলে যেতে সে আশ্রয় নিতে শুরু করে রঙিন মিথ্যার জগতে। আর এ মিথ্যার জগতে চলতে চলতে কোনো এক মোড়ে এসে তার পরিচয় ঘটে প্রফেসর ডক্টর ক্লিভ কোচের সাথে৷ প্রথম সিজন যারা দেখেছেন তাদের এ নামটির সাথে পরিচিত থাকার কথা।
আজীবন খাঁচায় বন্দী থাকা পাখির মতো ছটফট করতে থাকা বনি প্রফেসর ক্লিভের প্রেমে বাঁধনহারা পাখির মতো উড়তে শুরু করল। বনি হয়তো মিথ্যা বলায় পারদর্শী ছিল, প্রচন্ড ঈর্ষাপরায়ণ ও ভয়ংকর প্রতিশোধপরায়ণ ছিল, কিন্তু দিনশেষে সে ছিল অতি সাধারণ এক মেয়ে। ক্লিভের প্রেমে সে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়েছিল যে অনেক স্বচ্ছ কাচের মতো সত্যও তার নজরে আসছিল না। আর যখন তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার কাছ থেকে চিরতরে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, প্রতিশোধের আগুন তার বুকে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। আর এভাবেই শুরু হয় নতুন এক গল্পের।
বনি মেয়েটার জীবনের গল্পটা জেমস ও অ্যালাইসা থেকেও বেশি দুর্দশাপন্ন ছিল। একটা শিশুর বেড়ে ওঠায় পরিবার ও পরিবেশের অবদান সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। বনির ক্ষেত্রে এ দুটোর সুস্থ ও স্বাভাবিক উপস্থিতি ছিল না বলে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ পরিলক্ষিত করা যায়। তার জীবনের করুণ বাস্তবতা তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছিল।
গত সিজনে জেমসের পরিণতি নিয়ে যে রহস্যের জট বেঁধেছিল, এ সিজনে এসে দর্শক এর খোলাসা পাবেন। জেমস সম্পর্কে কথা বলতে গেলে দর্শকদের গরম গরম নতুন সিজন দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হয়ে যাবে সেদিকে যাবো না৷ তার চেয়ে বরং অ্যালাইসাকে নিয়ে কথা বলা যাক।
এ সিজনে অ্যালাইসা চরিত্রের বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। গত সিজনে নিজের চারপাশের সবকিছুকে পেছনে ফেলে অজানার উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকা অ্যালাইসা এ সিজনে স্থির একটা জীবনের সন্ধান করছিল। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন চাকরি, সবমিলিয়ে তার অতীত থেকে সে যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। নিজের বেঁচে থাকার একটা কারণ অন্বেষণে মুখিয়ে থাকা অ্যালাইসা হুট করে মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেকটা ঝোঁকের মাথায় বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাওয়া অ্যালাইসা নতুন সম্পর্কে জড়ানো বা নতুন জীবনের প্রতি যতটা না আগ্রহ ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল অতীতের দুঃস্মৃতি থেকে মুক্তি পাবার বাসনা৷
আর এভাবে যার যার জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে থাকা বনি ও অ্যালাইসা এ সিজনে এসে মিলিতভাবে শুরু করবে নতুন এক অ্যাডভেঞ্চারের। এ অ্যাডভেঞ্চারের পেছনে বনির একান্ত ব্যক্তিগত লক্ষ্য থাকলেও আগের মতোই অ্যালাইসা ছিল দিকবিদিকশুন্য।
জেমসের ভূমিকায় অ্যালেক্স লোথার ও অ্যালাইসার ভূমিকায় জেসিকা বারডেনের অসামান্য অভিনয়ের প্রমাণ তো প্রথম সিজনেই দর্শক পেয়েছেন। জেমস ও অ্যালাইসা চরিত্র দুটোকে তাদের চেয়ে আরো নিখুঁতভাবে কেউ ফোটাতে পারত বলে মনে হয় না৷ এ সিজনেও তারা তাদের সেরাটাই দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এ সিজনের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন নাওমি অ্যাকি। বনি চরিত্রে তার অভিনয় এককথায় অপূর্ব ছিল৷ তিনি যে জাত অভিনেত্রী তা বনি চরিত্রে তার অভিনয় কয়েক মিনিট দেখলেই ধারণা পাওয়া যায়।
নিঃসন্দেহে এ সিজন বেশ দুর্দান্ত প্লট নিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে। গত সিজনের মতো এ সিজনেও কমেডির পাশাপাশি ডার্ক থিমকে আলোকপাত করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, সিজনের প্রথম দুই-তিন পর্ব গত সিজনের থেকেও ভালো হয়েছে। গত সিজনের মতো এবারও সিনেমাটোগ্রাফির কাজ ছিল দারুণ। সিনেমাটোগ্রাফার জাস্টিন ব্রাউন ও বেন ফোর্ডসম্যানের এমন অসাধারণ কাজ প্রশংসার দাবিদার। আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরগুলো তো এককথায় অতুলনীয় ছিল৷ প্রতিটা চরিত্র ও বিশেষ বিশেষ দৃশ্যের সাথে মিলিয়ে এমন অসাধারণ সাউন্ডট্র্যাক সিরিজের মিউজিকের দায়িত্বে থাকা গ্রাহাম কোক্সনকে সাধুবাদ না জানালেই নয়।
সর্বোপরি বলতে গেলে, এ সিজনটা না রিলিজ হলে জেমস ও অ্যালাইসার গল্পটা অসম্পূর্ণ ও অলিখিত রয়ে যেত। হয়তো দর্শকেরা যে যার মতো করে ওদের গল্পের পরিসমাপ্তি সাজিয়ে নিয়ে নিজেদের মনকে বুঝ দিতেন। কিন্তু এ সিজনের শেষটা আশানুরূপ হয়নি। হয়তো আরেকটু নাটকীয়ভাবে গল্পটাকে পরিপূর্ণতা দিলে আরও জমে উঠত। তবে এটুকু ধরে দেওয়া যায়, এ সিরিজের এখানেই উপসংহার টানা হয়েছে। কারণ পরবর্তীতে আর কোনো সিজন আসলে সিরিজের মূল গল্পকে অযথা টেনে লম্বা করে এর প্রকৃত স্বাদ নষ্ট করা ছাড়া সেটা আর কিছুই হবে না।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বই ও সিনেমা’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/