অবসরে বসে বই পড়ার কোনো বিকল্প হতে পারে না। বই পড়লে একদিকে যেমন মন প্রফুল্ল হয়, ঠিক তেমনই যান্ত্রিক জীবনের চিন্তাধারা থেকে খানিকটা মুক্তিও মিলে। কেননা, একজন লেখক তার পাঠককে বৈষয়িক আর যান্ত্রিক অভ্যস্ততার জীবনকেও ভিন্ন আঙ্গিকে দেখানোর ক্ষমতা রাখেন। প্রতিদিনকার একগুঁয়ে জীবন মানুষকে যান্ত্রিক করে তোলে। প্রতিদিনকার হত্যা-রাহাজানির খবরে মানুষ আতংকিত এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই, একটা ফিকশন বই যেমন পাঠকের সত্ত্বাকে আনন্দ দেয়, তেমনই একটা নন-ফিকশন বই জীবনে চলার পথে পাঠককে সৌজন্যমূলক উপদেশ দেয়।
বছর তো শেষ হয়ে গেল, কিন্তু বছরের সেরা ফিকশন নন-ফিকশন বইগুলো হয়তো এখনো পড়া বাকিই রয়ে গেল। কিন্তু পড়া তো দরকার। তাই, আজকের আয়োজনে থাকছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এর মতে ২০১৮ সালের সেরা দশটি বইয়ের বিবরণ।
ফিকশন
১. অ্যাসিমেট্রি, লিসা হ্যালিডে
প্রেম-ভালোবাসা, নিয়তি, শিল্প এবং জীবনের অন্তর্নিহিত বোধগুলোকে কেন্দ্র করে লেখা এক অসাধারণ উপন্যাস অ্যাসেমেট্রি। তিনটি ভিন্ন ধারার গল্পকে যুক্ত করে মানুষের সম্পর্কের মাঝে লুকিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ব্যাপার যেমন বয়সের পার্থক্য, অসম প্রেম, বুদ্ধিমত্তা, মূল্যবোধ ইত্যাদি তুলে ধরেছেন তিনি। তিনটি নভেলা মিলে একটা উপন্যাসে রূপান্তরিত হয়েছে, যার মধ্যে একটি নভেলার বর্ণনা দু’ভাগে এবং দুভাবে দেয়া হয়েছে।
প্রথম নভেলা- ফোলি। এলিস একজন সম্পাদক, বিশ বছরের তরুণী, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় মত্ত এবং জীবনের পথে সবেমাত্র পা বাড়িয়েছে। আর এজরা ব্লেজার যথেষ্ট খ্যাতিসম্পন্ন এবং বয়স্ক একজন লেখক। জীবনযুদ্ধে সফল একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজের জীবনের শেষ দিনগুলো বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটিয়ে দিচ্ছেন। ভিন্ন বয়সের এই দুটি মানুষের মধ্যে অসম এক প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের এই অসম সম্পর্কের সবকিছুই অসাম্যঞ্জস্যপূর্ণ, শুধুমাত্র দুটি বিষয়েই দুজনের সমান আগ্রহ আর মতের মিল আছে। বেসবল আর সাহিত্য। এলিসের জীবনে ব্লেজারের উপস্থিতি সরব বা নীরব, যা-ই হোক না কেন, তার জীবন এগিয়ে চলে, আর সে জীবনের মধ্য দিয়েই আমরা দেখি আসলে আমরা জীবন নিয়ে কী ভাবি, কী দেখি, কী লেখি এবং কী পড়ি।
দ্বিতীয় নভেলা- ম্যাডনেস। আমার জাফারী, একজন ইরাকি-আমেরিকান অর্থনীতিবিদ, ২০০৮ সালে শেষের দিকে কুর্দিস্থানে থাকা তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসারদের জেরার মুখে পড়েন। এবং সে বছরের শেষ সপ্তাহটা তার হিথ্রো বিমানবন্দরের একটি হোল্ডিং রুমেই পার করতে হয়। ফ্ল্যাশব্যাকে তার ইরাকি এবং আমেরিকান জীবনযাপনের ভিন্ন ভিন্ন চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে বর্ণনার মাধ্যেম।
তৃতীয় নভেলা- ডেজার্ট আইল্যান্ড ডিস্ক, যা মূলত এজরা ব্লেজারের বিবিসি রেডিও প্রোগ্রামের খানিকটা অংশ। রেডিওর উপস্থাপকের সাথে কথোপকথন এবং তার জীবনের আরো খানিকটা ভেতরের গল্প উঠে আসে।
উপন্যাসটির লেখক লিসা হ্যালিডে যে একজন উদীয়মান সাহিত্যিক, তার প্রমাণ দিয়েছেন অ্যাসিমেট্রি বইতে। একজন নতুন সাহিত্যিক হিসেবে অভিষেকেই এত দুর্দান্ত, অসাধারণ এবং ভালো লিখেছেন যে, যেকোনো পাঠকই বইটি পড়ে মুগ্ধ হবে।
২. দ্য গ্রেট বিলিভারস, রেবেকা ম্যাকাই
১৯৮৫ সালের কথা। শিকাগোর একটা আর্ট গ্যালারির নির্বাহী পরিচালক ইয়েল টিশম্যান। ১৯২০ সালের একটা অসাধারণ চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেন গ্যালারীর জন্য। এটি তার ক্যারিয়ারের গতিপথকে আকস্মিক সচল করে তোলে। ক্যারিয়ার এবং জীবন যখন ডানা মেলতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই এইডসের মহামারীতে ছেয়ে যায় তার চারপাশ। একের পর এক, তার বন্ধুদের মধ্যে সবাই, এইডসের মরণব্যাধিতে প্রাণ হারায়। তার বন্ধু নিকোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে মহামারীটা যেন আরো নিকটে চলে আসে তার। ইয়েলের চারপাশে যারা ছিল তাদের মধ্যে কেবল বেঁচে আছে, নিকোর ছোট বোন ফিয়োনা।
ত্রিশ বছর পরের কথা, ফিয়োনা তার গৃহত্যাগী মেয়েকে খুঁজতে প্যারিসে যান। শিকাগো সংকটের উপর ডকুমেন্টারি তৈরি করতে থাকা তার পুরানো বন্ধু বিখ্যাত ফটোগ্রাফারের সাথে থাকেন কিছুদিন। সে সময়টায় তিনি উপলব্ধি করেন এইডস কীভাবে তার জীবনটাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং তার আর তার মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল তৈরি করেছে। আশির দশকের মর্মবেদনা এবং আধুনিক যুগের বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে ইয়েল আর ফিয়োনা তাদের জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে কীভাবে বেঁচে ছিলেন সে কথাই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে রেবেকা ম্যাকাইয়ের দ্য গ্রেট বিলিভার উপন্যাসে।
২০০৮ থেকে ২০১১ সাল টানা চার বছর আমেরিকান শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী লেখক রেবেকা ম্যাকাইয়ের প্রথম উপন্যাস এটি। ২০১৮ সালের গুডরিডস চয়েজ অ্যাওয়ার্ড এবং ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডসের প্রতিযোগী ছিল এই বইটি।
৩. দ্য পারফেক্ট ন্যানি, লেয়লা স্লিমানি
তার কাছে ওদের এপার্টমেন্টের চাবি আছে। তিনি ওদের ব্যাপারে সবকিছুই জানেন। ওদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে তিনি নিজেকে এমনভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন যে এখন তাকে দূরে সরিয়ে দেয়াটাও অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
সন্তান হওয়ার পর মরিয়ম যখন পুনরায় তার আইনজীবী পেশায় ফেরত যেতে চায় তখন সে আর তার স্বামী দুজনে মিলে এমন একজন আয়ার খোঁজ করে যে কিনা ওদের ছেলে আর মেয়েকে দেখেশুনে রাখবে। ওরা কখনো কল্পনাও করেনি যে লুইসের মতো এমন একজনকে পাবে যে শান্তশিষ্ট, নম্র-ভদ্র, বাচ্চাদের জন্যে নিবেদিত প্রাণ। ঘরের টুকিটাকি কাজকর্ম করে, অতিরিক্ত সময়েও কাজ করে এবং বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের পার্টির আয়োজনও করে। কিন্তু যখনই সেই দম্পতি এবং আয়া একে অপরের উপর পূর্ণ মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে উঠে, তখনই সন্দেহ, অসন্তোষ, অবিশ্বাস এবং অভিনয়গুলো চোখে ধরা পড়ে এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে যেতে থাকে।
লেয়লা স্লিমানির দ্য পারফেক্ট ন্যানি এমন একটা বই যার প্রতিটা পৃষ্ঠা উত্তেজনায় ভরপুর। দুর্দান্ত রচনা, গৃহজীবন, মাতৃত্ব এবং মানসিক পাগলামি- সব মিলিয়ে লেখকের অসাধারণ অভিষেক। বইটি ফ্রান্সের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কার গনকোর্ট বিজয়ী এবং আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলারের খেতাব প্রাপ্ত।
৪. দেয়ার দেয়ার, টমি অরেঞ্জ
মারাত্মক, ভয়ংকর, মজার কিন্তু হৃদয়বিদারক। টমি অরেঞ্জের প্রথম উপন্যাসটা অসাধারণ এবং অদেখা ধ্বংসাত্মক আমেরিকার প্রতিচ্ছবি যেন, যা সচরাচর আমাদের চোখে পড়ে না। লেখক জীবনের শুরু হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা একটি দেশের জাতি-গোত্র ও সম্প্রদায়ের ইতিহাস নিয়ে বোনা গল্প এটি। সহিংসতা এবং মুক্তিলাভ, স্মৃতি এবং নিজস্বতা, আশা এবং হতাশাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এর গল্প। বারোটি চরিত্রের গল্প বলা হয়েছে এখানে যাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত কারণে বিগ অকল্যান্ডের পাওয়াও-তে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে।
জ্যাক রেড ফেদার একজন শান্তিবাদী-সংযমী। নিজের পেছনের লজ্জাজনক অতীতকে ভুলতে চায় এবং ফেলে আসা পরিবারের কাছে ফিরতে চায়। চাচার মৃত্যুর পর নিজের জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত ডেন অক্সেন্ডেন। ব্যস্ততা সত্ত্বেও চাচার স্মৃতিকে সম্মানিত করার লক্ষ্যে পাওয়াও-তে এসেছেন। অপাল ভায়োলা ভিক্টোরিয়া বিয়ার শিল্ড এসেছেন নিজের ভাতিঝি অরভিলকে দেখতে। সে ইউটিউবের ভিডিও দেখে দেখে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় নাচ শিখেছে এবং পাওয়াও-তে এসেছে প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে নাচাতে। সেখানে হবে উপভোগ্য কথোপকথন, পবিত্র ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির এক প্রদর্শনী। এবং সেখানে আরো থাকবে বিসর্জন, থাকবে বীরত্বগাঁথা এবং অপ্রত্যাশিত ক্ষতি।
শহুরে আমেরিকানদের নিয়ে লেখা হয়েছে এতে। তাদেরকে এমন একটা উপন্যাসে বন্দী করেছেন যার গল্পটা জটিল এবং বেদনাদায়ক ইতিহাসের সাথে জড়িত।
২০১৮ সালের ন্যাশনাল বুকস অ্যাওয়ার্ড, গুডরিডস চয়েস অ্যাওয়ার্ড এবং অ্যাস্পেন ওয়ার্ল্ড লিটারেসি প্রাইজের প্রতিযোগী ছিল এটি।
৫. ওয়াশিংটন ব্ল্যাক, এসি এডুগ্যান
২০১৮ সালের কানাডার সম্মানজনক গিলার প্রাইজ জয়ী এসি এডুগ্যানের উপন্যাস ওয়াশিংটন ব্ল্যাক। এটি মূলত ১১ বছরের এক দাসের গল্প। তার কাছে বার্বাডোসে চিনি রোপন ব্যতীত জীবনের অন্য কোন মানে নেই। তার জন্মও হয়েছে সেখানেই। যখন তার মনিবের অদ্ভুত স্বভাবের ভাই তাকে নিজস্ব পরিচারক হিসেবে নেয়, তখন সে নিজের জন্যে উপর আসন্ন নিষ্ঠুরতার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু অদ্ভুত স্বভাবেই ভাই ক্রিস্টোফার ওয়াইল্ড হচ্ছেন একজন প্রকৃতিবিদ, অনুসন্ধানকারী, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক এবং মৃত্যদণ্ড প্রথার বিলোপ পন্থী।
তিনি তাকে এমন একটা দুনিয়ার সাথে পরিচয় করান যেখানে একটা উড়ন্ত বাহন একজন মানুষকে নিয়ে আকাশজুড়ে চলাচল করতে পারে। দুজন মানুষ যেখানে অসম বিভাজনে বিভক্ত, যেখানে একে অপরকে সমান মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করে। কিন্তু ঘটনাক্রমে কেউ একজন সেখানে মারা যায়, অনুদানস্বরূপ ওয়াশের মাথা বলি দেওয়ার কথা উঠে। তখন টিচ সব কিছু ছেড়ে দেয় শুধুমাত্র ওয়াশকে বাঁচানোর জন্যে।
ওয়াশিংটন ব্ল্যাকের এই গল্পটা বন্ধুত্বের কথা বলে, বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলে, ভালোবাসা এবং মুক্তির কথা বলে। একটা জীবনের সমাপ্তি এবং নতুন করে সূচনার কথা বলে, কিন্তু সবশেষে একটাই প্রশ্ন রেখে যায় সবার কাছে- সত্যিকারের স্বাধীনতা কাকে বলে? ২০১৮ সালের ম্যান বুকার প্রাইজ, স্কচিয়া গিলার প্রাইজ, গভর্নাল জেনারেল লিটারেসি অ্যাওয়ার্ডের প্রতিযোগী ছিল এ বইটি।
নন-ফিকশন
৬. আমেরিকান প্রিজন, শেন বাউয়ার
শেন বাউয়ার ২০১৪ সালে লুসিয়ানার একটি অঞ্চলে বেসরকারিভাবে পরিচালিত একটি কারাগারে একজন গার্ডের পরিচয়ে গুপ্তভাবে নিযুক্ত হন। তার এই কৌশল ধরা পড়তে প্রায় চার মাসের মতো সময় পার হয়ে যায়। তবে ততদিনে একটা রিপোর্ট লেখার মতো যথেষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত তার যোগাড় হয়ে গিয়েছিল। এটি তাকে পরবর্তীতে ন্যাশনাল ম্যাগাজিন অ্যাওয়ার্ড এনে দেয় এবং অলাভজনক এই কারাগারের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার জন্যে ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পান।
এই বইয়ের মাধ্যমে, শেন বাউয়ার একটা আর্টিকেলকে এমন বিস্তীর্ণ বিশ্লেষণে নিয়ে গেছেন যে তা উপেক্ষা করা অসম্ভব। অনেকের মতে তার বইটি ভয়ের একটা নির্ভুল তালিকা। যার মধ্যে বন্দীদেরকে কর্মীবাহিনী হিসেবে ভাড়া দেয়া হতো- ফলে ব্যাপক সহিংসতা, উপেক্ষা এবং অনধিকার চর্চা হতো। যাতে ভর করে বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিব্যপ্ত হয় এটি। বইটি ২০১৮ সালের কারকাস প্রাইজের প্রতিযোগী ছিল।
৭. এডুকেটেড, তারা ওয়েস্টওভার
তারা ওয়েস্টওভার ১৭ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো কোন ক্লাসরুমে পা রাখে। আইডাহোর পাহাড়ি এলাকার এক নিম্নবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। তার এবং তার ভাই-বোনদের ব্যাকপ্যাকগুলা সবসময় তৈরি থাকতো যাতে করে নতুন করে কোথাও চলে যাওয়ার জন্যে দেরি না হয়। তার বাবা ছিলেন একজন ধর্মান্ধ গোঁড়া ব্যক্তি, তিনি সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে নিজের পরিবারকে আলাদা করে রাখেন। তার কাছে সবসময় খাদ্য, বন্দুকসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুই মজুদ থাকতো। তাদের না ছিল কোনো জন্মসনদ, না ছিল কোনো নাগরিকত্বের সনদ আর না ছিল কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা।
বাবা হাসপাতাল নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন যার জন্য সে জানতোই না একজন ডাক্তার কিংবা একজন নার্স দেখতে কেমন হয়! গভীর ক্ষত হোক আর সামান্য কাটাছেঁড়া কিংবা আগুনে দগ্ধ হওয়া সবকিছুই পারিবারিকভাবে ভেষজ চিকিৎসার আওতাধীন ছিল। তারার মা ভেষজ চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখতেন। পরিবারটা মূলধারার সামাজিক ব্যবস্থা থেকে এতটাই দূরে সরে গিয়েছিল যে তাদের কোনো সন্তান পড়াশুনা ঠিকমতো করছে কিনা অথবা মৌলিক চাহিদাসমূহ ঠিকমতো পূরণ হচ্ছে কিনা কিংবা কেউ বিপথে চলে যাচ্ছে কিনা এসব খবর নেওয়ার মতো কেউ ছিল না।
তারপর, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই, বইয়ের লেখক তারা নিজের ইচ্ছায় নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিগাম ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্যে নিজেকে গণিত আর ব্যাকরণে দারুণ দক্ষ করে গড়ে তুলেছিল। জ্ঞানের জন্যে তার স্পৃহা তাকে মহাসাগর আর মহাদেশ পাড়ি দিয়ে হার্ভার্ড এবং ক্যামব্রিজে নিয়ে আসে।
এডুকেটেড বইটি হচ্ছে স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার এক দারুণ উদাহরণ। বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত একটা জীবনকে কীভাবে টেনে পাহাড়ের চূড়ায় উঠাতে হয়, কীভাবে নিজের ইচ্ছাশক্তি একটা মানুষকে বদলে দেয় তা লেখকের জীবনের মাধ্যমে পাঠক জানতে পারে। ২০১৮ সালের গুডরিডস চয়েস অ্যাওয়ার্ড এবং রিডিং উইমেন অ্যাওয়ার্ড ফর নন-ফিকশন এর প্রতিযোগী ছিল এটি।
৮. ফ্রেডেরিক ডগলাস: প্রফেট অব ফ্রিডম, ডেভিড ডব্লিউ ব্লাইট
একজন অসাধারণ ব্যক্তির জীবনী নিয়ে একটা অসাধারণ কাজ। উনবিংশ শতাব্দীর আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি: ফ্রেডেরিক ডগলাস, একজন পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস যিনি পরবর্তীতে নিজের সময়ের অন্যতম সেরা বক্তা, সে যুগের বিদ্রোহী নেতা এবং লেখক হয়েছিলেন।
ফ্রেডেরিক ডগলাস (১৮১৮-১৮৯৫), ম্যারিল্যান্ডের বাল্টিমোর থেকে যুবক থাকাকালীন সময়েই পালিয়ে যান। তবে তার ভাগ্য ভালো ছিল বলা যায়। কারণ তার মনিবের স্ত্রী তাকে খানিকটা লেখাপড়া করিয়েছিলেন, এবং তিনি তার সময়ের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক হয়েছিলেন। তার জীবনকে তিন ধাপে ভাগ করে জীবনী লিখেছেন ডেভিড ডব্লিউ ব্লাইট। ডগলাসের এরকম উত্থান ক্রীতদাস মালিকদের জন্যে চরম অপমানজনক ছিল, নিজের বুদ্ধিমত্তায় তিনি দাসত্বের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিলেন।
উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসনের পরামর্শে, ক্রীতদাস প্রথার ধিক্কার জানিয়ে নিজের গল্পটিই জনসমক্ষে প্রকাশ করা শুরু করেন। গৃহযুদ্ধ এবং পুনঃসংস্কারকালীন সময়ে, পুরো দেশজুড়ে ঘুরে ঘুরে জনসভা করেন এবং দেশজুড়ে তার খ্যাতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তার অনন্য এবং গম্ভীর কন্ঠস্বর, তাকে আমেরিকার একজন তীব্র সমালোচক এবং খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
এই জীবনীতে, কয়েকজন ইতিহাসবিদের পরামর্শে ডেভিড ব্লাইট কিছু তথ্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ করেছেন, যা আগে কখনো কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। ডগলাসের দ্বিতীয় বিবাহ এবং তার একান্নবর্তী পরিবার সম্পর্কেও বিস্তারিত জানিয়েছেন ব্লাইট। ডগলাস কেবল একজন অসাধারণ মানুষই ছিলেন না, তিনি বাইবেলের গল্প এবং ধর্মতত্ত্বে প্রভাবিত একজন দার্শনিকও ছিলেন বটে।
অথচ শতাব্দীর এতগুলো বছর পেড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার জীবনী নিয়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য বই ছিল না। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং টাইম ম্যাগাজিনের ২০১৮ সালের সেরা দশটি বইয়ের তালিকায় এটি স্থান পেয়েছে।
৯. হাউ টু চ্যাঞ্জ ইউর মাইন্ড, মাইকেল পল্লান
সাইকেডেলিক মেডিসিন কি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে? ১৯৪০ সালে এলএসডি যখন আবিষ্কৃত হয়েছিল তখন গবেষক, বিজ্ঞানী এবং ডাক্তাররা ভেবেছিল এটা হয়তো মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লবের অন্যতম শুভসূচনা হতে যাচ্ছে। ধরে নেওয়া হয়েছিল এটা মানুষের চিন্তা-চেতনার গভীর অন্ধাকারে আলো ছড়াবে, মানুষদের মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু ১৯৬০ এর দশকে, বিপরীত সংস্কৃতির জঘন্য এবং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় সব ধরনের গবেষণাকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে সাম্প্রতিককালে, এলএসডি, সিলোসাইবিন এবং ডিএমটি’র বিস্ময়কর সম্ভাবনার উপর আবারো নতুন করে কাজ হচ্ছে। আদতেই কি এই মেডিসিনগুলো মানুষদের জীবনে উন্নতি বয়ে নিয়ে আসবে? এই অস্বাভাবিক জগতে গভীরভাবে ডুব দিয়ে এবং নিজেকে গিনিপিগের মতো জড়িয়ে নিয়ে, মাইকেল পল্লান এই সাইকেডেলিক মেডিসিনের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন এবং এই মেডিসিনের প্রভাবে মুগ্ধ নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্যে একটি আকর্ষণীয় বই লিখেছেন।
বলা যায়, মানুষের চিন্তাধারা ভবিষ্যতে ঠিক কতটা উন্নতি সাধন করবে তারই একটা প্রতিফলন হলো হাউ টু চ্যাঞ্জ ইউর মাইন্ড বইটি। ২০১৮ সালের গুডরিডস চয়েস অ্যাওয়ার্ডের প্রতিযোগী ছিল এই বই।
১০. স্মল ফ্রাই, লিসা ব্রেন্নান-জবস
লিসা ব্রেন্নানের জন্ম একটা খামারে এবং পিতামাতা তার নামও রেখেছিল খামারের নামেই। তার মা- ক্রিসান ব্রেন্নান একজন বোহেমিয়ান, অস্থির এবং দরিদ্র শিল্পী। অন্যদিকে, তার বাবা- স্টিভ জবস একজন ধনী ব্যবসায়ী এবং খানিকটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তাই, লিসা অবলোকন করেছে দুই ভিন্ন জগৎ। তার শৈশব কাটে সিলিকন ভ্যালিতেই।
তার তারুণ্যের সময়টাতে তার বাবা তার কাছে ছিলেন একজন পৌরাণিক চরিত্রের মতো। একই ছাদের নিচে থাকা সত্ত্বেও তার বাবা তাকে খুব কমই সময় দিতেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার বাবা অবশ্য তার প্রতি আগ্রহ দেখানো শুরু করেন, নতুন বাড়ি, অবকাশ যাপন এবং বেসরকারি স্কুলের সাথে তার নতুন জীবনের সূচনা ঘটে।
স্মল ফ্রাই হচ্ছে লিসা ব্রেন্নানের শৈশবকালের দুটি অসম্পূর্ণ কিন্তু অস্বাভাবিকতার কটু গল্প। তার পিতামাতার আকর্ষণীয় এবং বৈষম্যপূর্ণ জীবনের একটা গাইড এটা; যেটাকে লিসা লিপিবদ্ধ করেছে বিজ্ঞতা দিয়ে এবং মজা দিয়ে। ২০১৮ গুডরিডস চয়েস অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগী ছিল এটি।