দর্শকদের জন্য পর্যাপ্ত অ্যাড্রেনালিন রাশের ব্যবস্থা রাখা- এই ব্যাপারটি ম্যাড ম্যাক্স সিরিজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখন সবাই ফিউরি রোড নিয়ে মত্ত থাকলেও ম্যাড ম্যাক্সের শুরু একটি ট্রিলজির মাধ্যমে। তা নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
জর্জ মিলার এগিয়েছেন সোজাসাপ্টা ফর্মুলায়। এতে আছে প্রচুর মারামারি এবং চেইস সিকোয়েন্স। গল্পের উপস্থাপনও এমনভাবে করা হয়েছে যেন চোখের দেখাতেই সবকিছু বুঝে ফেলা যায়, মাথা খাটাতে না হয়। সিরিজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক সম্ভবত কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তিতেও ঐ ঘটনাগুলোকে ক্লিশে মনে না হওয়া। সবগুলো অ্যাকশন সেটপিসে একধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে। আর শেষে কী ঘটতে চলেছে তা আন্দাজ করা যায় না।
ট্রিলজির সূচনা ১৯৭৯ সালে ‘ম্যাড ম্যাক্স’-এর মাধ্যমে। কম বাজেটের এ সিনেমায় মিলার মূল চরিত্রে কাস্ট করেন আনকোরা, অপরিচিত মেল গিবসনকে। আমেরিকায় সিনেমাটি কিছুদিন চলে, এবং অ্যাকশন জনরার পাঁড় ভক্তদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। দুই বছর পর আসে সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তি ‘ম্যাড ম্যাক্স ২: দ্য রোড ওয়ারিয়র’ (১৯৮১)। এবারের প্রজেক্টে বাজেট যেমন ছিল বড়, তেমনি আশাও ছিল বেশি। ওয়ার্নার ব্রাদার্স এর প্রচারণায় অনেক অর্থ খরচ করে, এবং বড় পরিসরে মুক্তির ব্যবস্থা করে। রাতারাতি বদলে যায় খোলনলচে। ম্যাড ম্যাক্স কাল্ট হিরো থেকে মেইনস্ট্রিম হিরোতে পরিণত হয়। আর মেল গিবসন বনে যান অ্যাকশনের নতুন আইকন। ১৯৮৫ সালে ‘ম্যাড ম্যাক্স: বিয়ন্ড থান্ডারডোম’ মুক্তির আগে ওয়ার্নার কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ এই প্রজেক্টে বিনিয়োগ করে, যেন মিলার আর তার পার্টনার তাদের যা খুশি তা করতে পারেন। আর এর মাধ্যমেই শেষ হয় ম্যাক্সের কাহিনী। গিবসন পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, অভিনয় করেন আলোচিত-সমালোচিত বহু সিনেমায়। তবে তার উত্থান এই ম্যাড ম্যাক্স ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়েই।
টোনের দিক থেকে তিনটি সিনেমায় পার্থক্য রয়েছে। এগুলোর ভেতর সবচেয়ে নির্মম ম্যাড ম্যাক্স। এতে আমরা ম্যাক্সকে এমন একটি ক্যারেক্টার আর্কের ভেতর দিয়ে যেতে দেখি, যেখানে সে তার প্রিয় সবকিছু হারিয়ে ফেলে। টিপিক্যাল অ্যাকশন/অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে শুরু হওয়া গল্পটি রূপ নেয় প্রতিশোধের আখ্যানে। সমাপ্তিও করাল। ম্যাক্সের প্রতিশোধস্পৃহা যখন চরিতার্থ হয়, তখনও দর্শক বা ম্যাক্স কেউই শান্তি পায় না। ‘ম্যাড ম্যাক্স: দ্য রোড ওয়ারিয়র’ সেই তুলনায় আরো গতানুগতিক অ্যাকশন ফ্লিক। এখানে ম্যাক্সকে দেখা যায় একটি রহস্যময় চরিত্রে, যাকে না চাইতেও রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে হয়। হ্যান সোলোকে মরুভূমিতে নামিয়ে দিলে যেরকম হওয়ার কথা, এখানে ম্যাক্স অনেকটা সেরকম। অন্যদিকে, ‘ম্যাড ম্যাক্স: বিয়ন্ড থান্ডারডোম’-এ আরো শান্ত, পরিশীলিত ম্যাক্সের দেখা মেলে। তাকে গতানুগতিক হিরোর ট্রোপের দিকে গমন করতে দেখা যায়। এবারও সে দুর্বলের আশা-ভরসার শেষ বাতিঘর। তবে এবার সে তাদের রক্ষা করে আরো কম অনাগ্রহের সাথে। ট্রিলজির শেষে ম্যাক্স চরিত্রের বৃত্ত পূর্ণ হয়। সে হয়তো তার প্রিয় সবকিছু হারিয়েছে, তবে ফিরে পেয়েছে নিজের আত্মাকে।
সিনেমাসমূহের প্রেক্ষাপট অদূর ভবিষ্যতের পোস্ট অ্যাপোক্যালিপ্টিক দুনিয়ার অস্ট্রেলিয়া। কীভাবে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা পুরোপুরি স্পষ্ট না। তবে বলা হয়- কোল্ড ওয়ারের সমাপ্তি ঘটেছে পারমাণবিক যুদ্ধের মাধ্যমে, যাতে আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অন্যান্য দেশসহ অস্ট্রেলিয়াতেও এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। আইন-কানুন, সভ্যতার সিংহভাগ হয়ে গেছে নিশ্চিহ্ন। যুথবদ্ধ মানুষরূপী পশুদের বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু করার সাধ্য নেই পুলিশের লোকেদের। আবার, সাধারণ মানুষ নিজেরাও নিজেদের রক্ষা করতে অক্ষম। এ ধরনের দৃশ্যকল্প মৌলিক কিছু না। আগের দশকের প্ল্যানেট অব দ্য এইপস (১৯৬৮) বা দ্য ওমেগা ম্যান (১৯৭১) সিনেমাগুলোতেও একই ধরনের ট্রোপ দেখা গেছে। তবে ম্যাড ম্যাক্স এবং এর সিক্যুয়েলগুলোতে এই দৃশ্যকল্প ব্যবহার করা হয়েছে যথার্থভাবে। আর অস্ট্রেলিয়ান মরুভূমির বিরান পতিত এলাকা সাহায্য করেছে সর্বব্যাপী বিরাজমান নিষ্ঠুরতা, নৈরাজ্য, অনিশ্চয়তা এবং ভয়ের আবহ সৃষ্টি করতে।
আমাদের শিল্প-সাহিত্যে বার বার বলা হয়েছে- সভ্যতার সমাপ্তি হবে বর্বরতার সূচনা বিন্দু। এই দর্শন ম্যাড ম্যাক্সের গল্পের অন্যতম বড় প্রভাবক। আমরা এখানে দেখতে পাই সভ্যতার পতন সৃষ্টি করেছে মাৎস্যন্যায়ের পরিস্থিতি। সবলের সীমাহীন অত্যাচারে দুর্বল অতিষ্ঠ। এমতাবস্থায় দুর্বলের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় ম্যাক্স। এই ফর্মুলাও পুরাতন, কিন্তু সেটাকে ক্লিশে মনে হয় না মিলারের সৃজনশীলতা আর স্টাইলের কারণে। এক্ষেত্রে ম্যাক্সের মধ্যে স্ট্যালোন বা শোয়ার্জনেগার অভিনীত চরিত্রসমূহের মতো নায়কোচিত মনোভাব দেখা যায়নি। সে একটি বাস্তবিক চরিত্র, যার বিবর্তন ঘটেছে সময়ের সাথে। আর অ্যাকশন ফিল্ম তখনই সবচেয়ে ভালো প্রভাব ফেলে, যখন মূল চরিত্রকে অতিমানবের পরিবর্তে রক্ত-মাংসের মানুষের রূপ দেওয়া হয়।
ম্যাড ম্যাক্সের সূচনা একটি চেইস সিকোয়েন্সের মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে এই ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। অন্য সহকর্মীদের সাথে মিলে ম্যাক্স আর তার পার্টনার গুস (স্টিভ বিসলি) ধাওয়া করে দস্যু নাইটরাইডারকে (ভিন্স গিল)। ধাওয়ার একপর্যায়ে নাইটরাইডারের ভবলীলা সাঙ্গ হলে তার দলের নেতা টোকাটার (হিউ কিটস-বার্ন) প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। গুসের পর তারা নজর দেয় ম্যাক্সের দিকে। ম্যাক্সের স্ত্রী জেসি (জোয়ান স্যামুয়েল) আর দুধের শিশু পরিণত হয় তাদের লক্ষ্যবস্তুতে। ফলস্বরূপ, পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেবে বলে মনস্থির করা ম্যাক্স আবারও আইনের শরণ নেয় নিজের সকল ক্রোধ সঙ্গী করে।
সময়ের সাথে ম্যাক্সের যে পরিবর্তন, তা অনুভব করা যায় পুরো ট্রিলজি দেখলে। প্রথম সিনেমায় আমরা ম্যাক্স এবং তার পরিবারের মাঝে কোমল, আন্তরিক ভালোবাসার দৃশ্যায়ন অবলোকন করি। ঘাত-প্রতিঘাত শেষে যখন তাকে আবার আমরা দ্য রোড ওয়ারিয়র রূপে আবিষ্কার করি, তখন আমরা তার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পারি। তৃতীয় সিনেমায় ইস্টউডের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ যখন তাকে ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, তখন তার পরিবর্তন আরো প্রকট হয়। এগুলোর মধ্যে দ্য রোড ওয়ারিয়র একদম সোজাসাপ্টা অ্যাকশন ফিল্ম। এতে আছে বিপদজনক স্ট্যান্টে ভরা একের পর এক চেইসের দৃশ্য। একজন সাধারণ দর্শক যখন ম্যাড ম্যাক্সের কথা বলে, তখন এ ধরনের দৃশ্যাবলীর কথাই তার মনে পড়ে। অন্যদিকে, তৃতীয় সিনেমা হলো অ্যাকশন ফিল্মের হলিউডি তরিকার সাথে মিলারের অস্ট্রেলীয় মননের মিশ্রণ। সিরিজের অন্য সিনেমার তুলনায় এটি অধিকতর প্লট-আশ্রয়ী। এখানে ম্যাক্সকে দেখা যায় একটি বৃত্তাকার ক্যারেক্টার আর্কে, যা তাকে বার্টারটাউনে নিয়ে আসে দুবার। প্রথমবার আবেদনকারী হিসেবে, এবং পরেরবার প্রতিশোধ নিতে।
আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগে প্রথম কিস্তি মুক্তি পেলেও সিনেমাগুলোর আবেদন এখনও অটুট। তার কারণটাও সরল। মিলার জানেন কীভাবে অ্যাকশন এবং চেইস সিকোয়েন্সগুলো সাজাতে হয়। তার বিখ্যাত সাসটেইনড কাটগুলোও প্রগাঢ়তা আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেকে তার ফর্মুলা ব্যবহার করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও তিনি এখনও সফলতা পাচ্ছেন। তৃতীয় কিস্তির ব্লাস্টার আর ম্যাক্সের মধ্যকার মরণপণ লড়াইয়ের কথা বার বার আলোচনায় আসলেও, সব সিনেমাতেই উল্লেখযোগ্য কিছু অ্যাকশন সিকোয়েন্স আছে, যা মিলারের ভক্ত আর সাধারণ দর্শক, উভয়কেই মুগ্ধ করে। অ্যাকশন ভক্তদের কাছে মিলারের ক্লাসিক ম্যাড ম্যাক্স ট্রিলজি তাই হলি গ্রেইলের মতোই আরাধ্য। তাই পাঠক দেখে নিতে পারেন এই ক্লাসিক ট্রিলজি, যা মেল গিবসনকে এনে দিয়েছিলে বৈশ্বিক তারকাখ্যাতি।