‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ বইটি মূলত প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ড্যান্সার ‘আরতি দাস’ বা ‘মিস শেফালি’র জীবনগল্পের আখ্যান। লালমুখো ফিরিঙ্গিরা বিতাড়িত হবার কিয়ৎকাল পরে, পঞ্চাশের দশকে কলকাতার শীর্ষস্থানীয় বাসিন্দাদের নানা বিচিত্র আমোদপ্রমোদের মধ্যে অন্যতম হয়ে দাঁড়ায় এই ক্যাবারে ড্যান্স।
পরিতাপের বিষয়, বাংলা মুলুকের ক্যাবারে ড্যান্সের আলো-ঝলমলে মঞ্চে ব্রাত্য থাকত এদেশীয় নারীরা। এই চকচকে মঞ্চে শ্বেতাঙ্গ নারীদের ছিল একচেটিয়া আধিপত্য। তবে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর সেই আধিপত্যে আসে ছেদ। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা আসেন বিদেশীদের জায়গায়। কিন্তু অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এলে কী হবে, বাঙালিরা আসতে পারেনি তখনও। এক অলিখিত নিয়ম হয়েই দাঁড়ায়- শ্যামবর্ণা কেউ ক্যাবারে ড্যান্সার হতে পারবে না।
ঠিক সেখানেই ব্যতিক্রম সৃষ্টি করেন আরতি দাস। এক বাংলা থেকে দেশভাগের ডামাডোলের বাহনে চেপে চলে আসেন মানচিত্রের আরেক বাংলায়। নতুন আবাসে কায়ক্লেশে জীবন চলতে না চলতে ভাগ্যের সন্ধানে নেমে আসেন রাস্তায়। পাকেচক্রে চলে আসেন এই আলো ঝলমলে জগতে। ‘আরতি দাস’ নামকে সাপের খোলসের মতন পাল্টে ফেলতে হয়। তার নতুন নাম হয়- মিস শেফালি। কারো ভাষায়- শেফু, কারো ভাষায়-শেফা, কারো ভাষায়- ফালি অথবা কারো ভাষায়- শ্যাফালি।
মিস শেফালি যদি শুধুমাত্র ক্যাবারে ড্যান্স নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, তাহলে তাকে নিয়ে এত কিছু লেখার হয়তো থাকত না। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের সেই সোনালি যুগের কলকাতার বহু রথী-মহারথীর সাথে তার হয়েছে নৈকট্য। সে তালিকায় আছেন সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনসহ আরো অনেকেই। পাঁচতারকা হোটেল দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তাকে কাজ করতে হয়েছে যাত্রার মঞ্চেও।
এই দীর্ঘ চলার পথে যাদের সাথে সম্পর্ক হয়েছে বা হয়নি, তাদের সাথে সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন তিনি খোলাখুলি উজার করে দিয়েছেন ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ বইয়ে। সে কারণেই বইটি শেষপর্যন্ত আর বইয়ের মলাটে আটকে থাকেনি। কোনো এক মানুষের শেষরাতের নিভু নিভু আঁধারে দেওয়া সাদাসিধে, নিষ্পাপ স্বীকারোক্তির এক স্মারক হয়ে উঠেছে এ বই।
ক্যাবারে ড্যান্স-কালো বেড়াল-কলকাতা
বইয়ের মূল অংশে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমেই জানতে হবে- ক্যাবারে কী? ফরাসি ‘Cabaret’ থেকে ‘ক্যাবারে’ শব্দের উৎপত্তি। এ শব্দের অর্থ ছোট রেস্তোরাঁ বা নাইট ক্লাব। এমনিতেই ফরাসিরা বেশ আরামপ্রিয়। তারা ভাবল, আড্ডা দিতে দিতে খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি যদি সামান্য নাচগানও চলে, খারাপ কী! লাইন ধরে টিকেট কেটে নাচগান দেখার চেয়ে আরামে-স্বস্তিতে দেখাই তো সার্থকতা। সেই চিন্তা থেকেই প্যারিসের বিখ্যাত মমাঁর্তেতে প্রথম ক্যাবারে খোলা হয় ১৮৮১ সালে; ক্যাবারে আর্টিস্টিক নামে। যদিও এ নাম পরে পরিবর্তন করে ‘ল্য শা নোয়ার’ করা হয়, যার অর্থ কালো বেড়াল। আস্তে আস্তে ক্যাবারের এই নতুন ধারণা মানুষের বেশ মনে ধরে।
পরবর্তী সময়ে ক্যাবারে ড্যান্সের তুমুল জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। জার্মানিতে, লন্ডনে, ভিয়েনায়, আমেরিকায়; সবখানে এই যৌনগন্ধী, প্রাপ্তবয়স্ক নাচের মডেল প্রবেশ করতে শুরু করে। সে হাওয়ার আঁচ লাগে কলকাতাতেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাখঢাক না রেখেই ‘ক্যাবারে ড্যান্স’ হয়ে ওঠে নব্য বিত্তশালীদের আমোদের অন্যতম মাধ্যম। জব চার্নকের কলকাতায় তখন দামী হোটেল বলতে ফিরপোজ। যে হোটেল সম্পর্কে জিওফ্রে মুরহাউস তার ‘ক্যালকাটা’ বইয়ে লিখেছিলেন-
ফিরপোজ, যেখানে সবচেয়ে ধনী লোকেরা খায়!
সেই ফিরপোজের একতলার লিডো রুম এবং দোতলার ব্যাঙ্কোয়েটে প্রথম শুরু হয় ক্যাবারে ড্যান্সের চল। গ্রান্ড হোটেলেও জোরেশোরে শুরু হয় ক্যাবারে ড্যান্সের ঐতিহ্য। কলকাতায় সে সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কিছু অ্যাক্রোব্যাটিক নাচিয়ে ছিলেন। তারাই এই দুই হোটেলের ‘ক্যাবারে ড্যান্সার’ হিসেবে নাচ করতেন।
এ ঘটনার বছর দশেক পরে এগোলে দেখা যাবে, ফিরপোজের সেই বিখ্যাত ড্যান্স ফ্লোরে হঠাৎ একদিন ঢুকে পড়েছেন বারো বছরের কোনো এক অখ্যাত আরতি দাস। সমাজের ‘মহীরূহ’ সম্প্রদায়কে আমোদ দেয়ার জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে এসেছে মেয়েটি। শুরু করেছে এক অসাধ্যসাধনের গল্প। এ গল্পে প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, বিশ্বাস আছে, বিশ্বাসঘাতকতা আছে, আলো ঝলমলে মঞ্চ থেকে শ্মশানের নীরবতাও আছে। সেই জমজমাট অতিনাটকীয় গল্পকে আশ্রয় করে লতায়-পাতায় বেড়ে ওঠে ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’নামা।
ওরে ঝড় নেমে আয়!
এই বইটি ‘আত্মজীবনী’মূলক হলেও, বইটি আরতি দাস নিজে লেখেননি। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় লেখক ও সাংবাদিক শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়ের অনুলিখনে এই বইয়ের আত্মপ্রকাশ। ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ পড়তে পড়তেই জানা গেল, লেখক শীর্ষ বন্দোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন ২০২১ সালের ১৭ মে, সোমবার।
শীর্ষ বন্দোপাধ্যায় কাজ করেছেন বেশ কিছু বাংলা সংবাদপত্রে। কাজ করেছেন টেলিভিশন চ্যানেলেও। জার্মান রেডিওর বাংলা বিভাগেও কর্মরত ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লিখছিলেন বইও। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘শার্দূল সুন্দরী’, যা বেশ জনপ্রিয় হয় পাঠকমহলে। ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ তার আরেক অনবদ্য সৃষ্টি। তিনি সবমিলিয়ে মোট চৌদ্দটি বই লিখেছেন। সেসব বইয়ের মধ্যে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতার শিল্পীদের ভূমিকার উপর ভিত্তি করে লেখা একটি উপন্যাসও- ইথারসেনা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সরব থাকতেন তিনি। মৃত্যুর দিনেও সামাজিক মাধ্যমে লিখেছিলেন- “ওরে ঝড় নেমে আয়”। সে রাতেই অন্তিম যাত্রা। বয়স পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই পৃথিবী ছেড়ে গেলেন প্রতিভাবান এই ব্যক্তি। লেখার এ অংশে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি তাই।
কাঁটাতার-ক্যাবারে-কলঙ্ক
এ বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক বোধহয় ঝরঝরে শব্দদলের উপস্থিতি। শব্দের গাঁথুনি এতটাই চমৎকার, হাত থেকে নামানো যাবে না। ‘একটানে শেষ করা’ শ্রেণীর বইয়ে অনায়াসে স্থান পেয়েছে তাই ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’। সেই সাথে আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ, আরতি দাসের জীবনের ঘটনা-পরিক্রমাগুলো বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে পর্যায়ক্রমে এনেছেন লেখক। এতে করে সুবিধা হয়েছে, পাঠক যখন বইটি পড়বেন, চোখের সামনে এই মানুষের পুরো জীবন-প্রবাহ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে।
আরতির জন্ম বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে হলেও দেশভাগের টালমাটাল সময়ে বাবা-মায়ের সাথে তাকে চলে আসতে হয় কলকাতায়। আহিরীটোলার এক এঁদো গুদামঘরের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে পরিবারের চারজন সদস্য মিলে শুরু হয় নতুন জীবন। আধপেটা খেয়ে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে থাকতে আরতি বুঝতে পারে, এভাবে চলতে পারে না। চলা ঠিক না।
সে কাজের সন্ধানে নামে। চাঁদনি চকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এক পরিবারে কাজ করা শুরু করে সে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের যে স্বভাব, মজলিশি মানুষ তারা। সারা মাসই পার্টিতে, হুল্লোড়ে, মদ্যপানে আকণ্ঠ ডুবে থাকে তারা। সাথে থাকে উচ্চস্বরে গান-নাচ। এদের নাচ দেখতে দেখতে পর্দার আড়াল থেকে আরতিও নাচত। গান শুনলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরো দেহ নড়তে শুরু করত তার। নেচে কখনো ক্লান্তিও হতো না। এভাবেই পর্দার আড়ালে নাচানাচির মাঝখানে একদিন এক সাহেবের চোখে পড়ে যায় আরতি। সেই সাহেবের নাম ভিভিয়ান। এই ভিভিয়ান যেন দেবদূত হয়ে নেমে আসে তার জীবনে। সে আরতিকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় ফিরপোজের কর্তাব্যক্তিদের সাথে। একবার ট্রায়ালের পরেই নির্বাচিত হন আরতি। জীবন পাল্টে যায় তখনই। সাথে নামটাও। কাপুর সাহেব নামের এক ব্যক্তি তার নাচ দেখে বলেছিলেন,
ইউ আর লাইক আ লিটল ফ্লাওয়ার।
এই লিটল ফ্লাওয়ার নিয়ে ভাবতে ভাবতে ‘শেফালি’ ফুলের নাম চলে আসে সামনে। আরতির নাম হয়ে যায়- মিস শেফালি। নতুন নাম, নতুন পরিচয়, সাথে বিশাল বড় অট্টালিকার মতো বাড়ি আর মাসিক সাতশো টাকা বেতন! পঞ্চাশের দশকে সাতশো টাকা নেহায়েত মুখের কথা নয়। মুদ্রার উল্টো পিঠে চলে আসে আরতি অথবা মিস শেফালির জীবন। ফিরপোজে শুরু হয় শেফালির নতুন যাত্রা। প্রথমদিন নাচের জন্যে যখন তাকে দেয়া হয়েছিল ছোট পোশাক, সেই পোশাক পরে আয়নায় নিজেকে দেখে কেঁদেছিল সে। কিন্তু সেটাই প্রথমবার এবং শেষবারও। ‘নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়া বারণ’; সেটা শেফালি বুঝেছিল খুব অল্প বয়সেই।
নাচের ‘ন’ও না জেনে ফিরপোজের বিখ্যাত লিডো রুমে ভরা মজলিশের সামনে স্বল্পবসনা হয়ে প্রথমবার দাঁড়ানোর অনুভূতি শেফালির আগে কোনো বাঙালি মেয়ের হয়নি। শেফালির সে সময়ের অনুভূতি হয়তো পেটের মধ্যে প্রজাপতির ছটফট। মিউজিক বাজল, শেফালি বুঝল, এই শুরু। প্রথম বাঙালি মেয়ের ক্যাবারে ড্যান্স। যখন শেষ হলো মিউজিক, তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল লিডো রুম। সেই সাথে শেফালিও মুহূর্তের মধ্যে জেনে ফেলল, বায়োস্কোপ শুরু হয়ে গিয়েছে।
মাসে মাসে সে টাকা পাঠাতো বাবা-মায়ের কাছে। আত্মীয়স্বজনেরা শেফালির বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখা নিয়ে লজ্জা পেত। বলতো-
যাদের মেয়ে এভাবে খোলামেলা হয়ে মানুষের সামনে হোটেলে নাচে, তাদের সাথে কথা বলতে আমাদের রুচিতে আটকায়।
অনেকটা ‘একঘরে’ করেই শেফালির পরিবারকে রাখা হয় বহুকাল। তবে শেফালির বাবা-মা একসময়ে এসে এগুলো গায়ে মাখা বন্ধ করলেন। মেয়ের টাকায় জমি কিনলেন। বাড়ি বানালেন। সেখানেও আছে আরেক গল্প। ক্রমশ প্রকাশ্য।
সত্যজিৎ রায়-উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন
বইয়ের একটা অংশ ছিল এরকম-
সত্যজিৎবাবু তেড়ে উঠলেন, কাট কাট! হচ্ছে না, একেবারে হচ্ছে না! আমি তো ঘাবড়ে গেলাম! এক লাইনের ডায়লগে কী ভুল করলাম! সত্যজিৎবাবু বাঘের মতো ফ্লোরে লাফ দিয়ে পড়ে বললেন, তোমাকে ডায়লগ লেখা যে কাগজটা দিয়েছি, সেটা দেখি!
সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমার ছোট এক রোলের জন্যে তিনি ডেকেছিলেন আরতিকে। বিশপ লেফ্রয় রোডের সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত বাড়িতে যান আরতি। সত্যজিৎ রায়ের সাথে কথা বলেই তিনি বুঝতে পারেন, আপাদমস্তক এক ভদ্রলোকের সাথেই কথা বলছেন তিনি। সিনেমাতেও তাকে গাইড করা হয় দারুণভাবে।
এই সিনেমার পরে সত্যজিৎ রায়ের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক হয় আরতির। যে সমাজে ‘ক্যাবারে ড্যান্সার’দের দেহ পসারিণীর মর্যাদা দেওয়া হয়, সেখানে সত্যজিৎ রায় যে আরতিকে একজন ‘আর্টিস্ট’ এর মর্যাদা দিচ্ছেন, বিষয়টি আরতিকে সন্তুষ্টি দিয়েছে সারাজীবনই। সত্যজিৎ রায়ের সাথে তিনি পরবর্তী সময়ে কাজ করেছেন ‘সীমাবদ্ধ’ সিনেমাতেও। সত্যজিৎ রায়ের সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল বহুদিন।
উত্তম কুমারের সাথে দেখা পাকেচক্রে। তখন ‘প্রিন্সেস’ এর ক্যাবারে ড্যান্সার মিস শেফালি। সেসময়ে একবার তার নাচ দেখতে আসেন মহানায়ক। তাকে একটু বাজিয়ে দেখানোর জন্যে আরতি তাকে জোর করে স্টেজে উঠিয়ে নিয়ে হাওয়াইয়ান ড্যান্সে নাচানোর জন্য জোর-জবরদস্তি শুরু করেন। প্রচুর পরিশ্রমের সে নাচে উত্তম কুমার শেফালির সাথে পা মেলাতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছিলেন বারবার। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, সেই উত্তম কুমারই ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েন আরতির প্রতি। ঘনিষ্ঠভাবে পেতেও চান একবার। কিন্তু আরতি প্রতিবাদ করেন। এর পরই ঘটনাক্রমে দুজনের সম্পর্ক বদলে দাদা-ছোটবোনের সম্পর্ক হয়ে যায়। উত্তম কুমারের বাড়িতে যেমন ছিল আরতির অবাধ আসা-যাওয়া। আরতির বাড়িতেও উত্তম কুমারের ছিল অবারিতদ্বার।
এ বইয়ের বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে আছে উত্তম কুমারের কথা। আরতি তাকে যেভাবে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন, সেটাই উঠে এসেছে। এবং বইয়ের সেই বিশেষ অংশটুকু পড়লে ‘বাংলার মহানায়ক’ নামক মানুষটির ভেতরের ‘বালির বাঁধ’-এর সন্ধান পাওয়া যাবে ভালোভাবেই। পারিবারিক জীবনে বিপর্যস্ত এই মানুষটি জনসমুদ্রের মধ্যেও ছিলেন কতটা একা, জানা যাবে তা-ও। ‘জনতার মাঝে নির্জনতা’র মতন তাকে কীভাবে কাটাতে হয়েছে ভীষণ অবরুদ্ধ এক জীবন, সেটাও বাদ যায়নি আরতির বয়ান থেকে।
সুচিত্রা সেনের সাথে আরতির পরিচয় পার্লারে। সুচিত্রা সেন কথা কম বলতেন, অন্যের কথা বেশি শুনতেন। তাছাড়া তিনি একেক জায়গায় একেক অবতারে থাকতেন। সময় বুঝে, অবস্থান বুঝে নিজের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। পার্লারে যখন আরতির সাথে কথা হতো, দুই বান্ধবীর মতো কথা বলতেন দুজন। সেই সুচিত্রা সেনই আবার সিনেমার সেটে গেলে একেবারে ভিন্ন মানুষ। তার ভয়ে তটস্থ থাকত গোটা সিনেমা ইউনিট। নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে যে দক্ষতায় ‘মহানায়িকা’ আলাদা করে রাখতেন কর্মজীবন থেকে, তা রীতিমতো মুগ্ধ করত আরতিকে।
শুধু এরাই নন, আরো অনেকের স্মৃতিচারণ আছে এ বইয়ে। বলিউডের ‘বিগ বি’ অমিতাভ বচ্চনে কথাও আছে। বিভিন্ন শিল্পীর সাথে বিভিন্ন তিক্ততার গল্পও আছে। সব বিষয়েই তিনি ছিলেন অকপট। নিঃশঙ্কচিত্ত।
প্রণয়-বিচ্ছেদ-পুনরাবৃত্তি
‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ থেকে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় লক্ষ্য করা যায়। আর তা হচ্ছে আরতি দাসের প্রেমজনিত টানাপোড়েন। তিনি বারবার প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু কোনো প্রেমই পূর্ণতা পায়নি। অথবা, আরতি সেগুলোকে পূর্ণতা দিতে চাননি। আবার সবাই যে প্রেমের জন্যও এসেছিল, তা-ও না। কেউ কেউ শুধু শরীরের জন্যও এসেছিল। এই শেষ দলের মানুষদের উপেক্ষা করে বইটিতে আমরা পাই প্রথম দলের গুটিকয়েক মানুষের টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতিচারণ, যারা ভালোবেসেছিল শেফালিকে, শেফালিও ভালোবেসেছিল যাদের।
মখমলের গালিচা থেকে স্যাঁতসেঁতে মেঝে
গ্রান্ড ওবেরয়, ফিরপোজ, হোটেল হিন্দুস্থান… ঝাঁ চকচকে সব পাঁচতারকা হোটেলে সম্রাজ্ঞীর হালে দিন কাটিয়েছেন আরতি। যখন যা খুশি খেতে পেরেছেন, করতে পেরেছেন। বিলাস-ব্যসনের চূড়ান্ত করেছেন। একাত্তর সালে তিনি মাসে আয় করতেন বাইশ হাজার টাকা। সেই মানুষটিই উত্তম কুমারের ‘বুড়োদা’ তরুণ কুমারের জোরজবরদস্তির মুখে পড়ে আসেন থিয়েটারে। থিয়েটারে এসেই তিনি ফেঁসে যান। আর বের হওয়া হয় না সেখান থেকে।
আরতি ভেবেছিলেন, থিয়েটারে হয়তো তিনি আরো জনপ্রিয়তা পাবেন। খানিকটা জনপ্রিয়তার লোভেই এখানে আসা। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং বলা যেতে পারে, থিয়েটারের মঞ্চে তাকে ক্যাবারে ড্যান্সের জন্যই ডাকা হতো বারবার। অভিনয়ের জন্যে ডাকা হয়নি কখনোই৷ বাংলা থিয়েটারের দর্শক পড়ে যাচ্ছিল তখন। সে সময়ে নিজেদের ব্যবসাকে বাঁচানোর জন্যেই সমসাময়িক কিছু থিয়েটার মালিক নিয়েছিলেন এই অভিনব পদ্ধতি। এতে কাজও হয়েছিল। ‘মিস শেফালি’কে তো সবাই এক নামেই চিনত। তার ড্যান্স দেখার জন্যে লরি-ট্রাক ভর্তি করে মানুষ আসত। থিয়েটারে মানুষের জোয়ার হতো প্রচণ্ড। সেটা কি নাটকের উৎকর্ষের কারণে নাকি যৌনতার সুড়সুড়িতে, সে প্রসঙ্গ তোলা অবান্তর।
এই ‘থিয়েটার করতে’ এসেই আটকে গেলেন তিনি। আর ফেরা হলো না সেই আলো ঝলমলে হোটেলের ড্যান্স ফ্লোরে। শরীরেও দেখা দিল নানাবিধ জটিলতা। একসময়ে ডাক্তারের পরামর্শে থেমেই যেতে হলো প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ড্যান্সারকে।
অতঃপর প্রস্থান
আরতি মাসে মাসে বাবাকে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়ে বাবা জমি কিনেছেন, বাড়ি বানিয়েছেন। সবই জানতেন আরতি। যখন নাচ ছেড়ে দিলেন তিনি, ভাবলেন- অনেক তো বাউণ্ডুলেপনা করলাম, এবার ঘরের পথেই ফিরি। ফিরলেন। ততদিনে বাবা-মা মারা গিয়েছেন। ভাই বিয়ে করেছে। ভাইয়ের সংসার সেই বাড়িতে।
ভাই-ভাইয়ের বৌ প্রসন্ন হলেন না আরতির আগমনে। তাদের নানাবিধ মানসিক অত্যাচারে সেখানে বেশিদিন থাকা হলো না তার। অশান্তি ভালো লাগছিল না। তাই পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এলেন সেখান থেকে। আশ্রয় নিলেন যশোর রোড সাতগাছিয়ায় বাপুজি কলোনির এক ফ্ল্যাটে। জ্যাঠতুতো বোনের মেয়ে বুলা রইলো সাথে। তবে ভাই ও ভাইয়ের বৌয়ের এহেন ব্যবহার কখনোই মানতে পারেননি আরতি। সেটাই লিখেছেন বইয়ের এক অংশে,
কিন্তু এত করেও আমি ওদের মন পাইনি। আমার যদি জীবনে একটা কোনো দুঃখ থেকে থাকে, তা হলে সেটা এটাই যে, আমার নিজের লোকেরা আমাকে বুঝতে চেষ্টা করেনি।
এভাবেই কেটেছে বহুদিন। এভাবেই যেতে যেতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিডনিজনিত জটিলতায় জ্বলেপুড়ে ফুরিয়ে গিয়েছেন আরতি। যেন সন্ধ্যারাতে টুপ করে কুয়াশায় মিলিয়ে গিয়েছে শীতল কুয়াশা মাখানো এক টুকরো শেফালির গোছা।
‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ বইটিতে পাঠক কোনো ক্যাবারে ড্যান্সারকে দেখতে পাবেন না। পাবেন না কোনো অভিনেত্রীকেও। দেখা মিলবে এক সাধারণ বাঙালি মেয়ের। পেটে অন্নসংস্থানের তাগিদ যাকে মাত্র বারো বছর বয়সেই নামিয়ে দিয়েছিল অজানার পথে। যে কিশোরীটি লাজলজ্জা খুইয়ে ক্যাবারে ড্যান্সের পেশায় নেমেছিল শুধু বাবা-মায়ের কথা ভেবে। নিজের দেহকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করা যথার্থ হলো কিনা, সেই আলোচনা চাইলে করা যেতেই পারে। কিন্তু কোনো একটি বাঙালি মেয়ে রূঢ় সমীকরণের কোন পর্যায়ে গেলে অর্থ উপার্জনের জন্য এতটা মরিয়া হতে পারে, প্রাসঙ্গিক থাকবে সেটিও।