ব্রিটিশরাজ থেকে পাকিস্তান শাসন ও এরপর স্বাধীন বাংলাদেশ- এই তিন যুগের প্রশাসনিক বিবর্তন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ বেশি মানুষ পাননি। যে কয়জন এই সুযোগ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে ফারুক চৌধুরী অন্যতম। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি, তখনকার সিলেট ও বর্তমানে ভারতের আসামের করিমগঞ্জে ফারুক চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, ও মা ছিলেন গৃহিণী। ১৯৫৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৬ বছরের পেশাদার জীবনে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা এই কূটনীতিবিদ ক্ষমতার পালাবদল দেখেছেন ভেতর থেকে, সাক্ষী হয়েছেন বাংলাদেশের জন্য মাহাত্মপূর্ণ্য অনেক ঘটনার।
সুলেখক ফারুক চৌধুরী তার জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘জীবনের বালুকাবেলায়‘ নামের আত্মজীবনী। নাম নির্ধারণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশনী থেকে, ২০১৪ সালে। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। বরাবরের মতোই প্রথমার প্রকাশনার মান অনেক ভালো ছিল। বইয়ের বাঁধাই, ছাপা, কাগজের মান- কোনো কিছু নিয়েই অভিযোগ করবার সুযোগ নেই। বইটির প্রথম প্রকাশের পর পেরিয়ে গেছে আটটি বছর, বের হয়েছে অষ্টম মুদ্রণ, তারপরও বইয়ে কিছু বানান ভুল ও মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গিয়েছে, যেটা বেশ বেমানান। আশা করা যায় পরবর্তী মুদ্রণগুলোতে তারা এই প্রমাদগুলো ঠিক করে ফেলবে।
বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ফারুক চৌধুরীর শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে তদানীন্তন সিলেট ও বর্তমান ভারতের আসামে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন স্কুলছাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ থেকে শুরু করে ভারতভাগের রাজনৈতিক অস্থিরতা- সবই প্রত্যক্ষ করেছেন। স্কুলজীবন শেষে ১৯৪৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। তখনকার দিনে ঢাকা কলেজের স্থায়ী কোনো হোস্টেল ছিল না, কলেজের আশেপাশের কিছু বাড়ি ভাড়া নিয়ে অস্থায়ী হোস্টেল বানিয়ে ছাত্রদের রাখা হতো। আগামসি লেনের সেরকমই এক হোস্টেলে ছিল তার নিবাস। সেই সময় আবার ফারুক চৌধুরীর মামা ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও কলেজজীবন থেকেই লেখকের ইচ্ছা ছিল সিভিল সার্ভিসে যোগদানের।
কলেজজীবন শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে, ১৯৫২ সালে। তার সংযুক্ত হল ছিল- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। বাবার কল্যাণে খেলাধুলার প্রতি ছোটবেলা থেকেই তার সীমাহীন আগ্রহ ছিল। তিনি তার হলের ক্রিকেট ও টেনিস দলের অধিনায়ক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, শামসুজ্জোহা প্রমুখ কৃতবিদ্য মানুষকে। এই গুণী মানুষদের ও বিদ্বান সহপাঠীদের সহচর্যে ফারুক চৌধুরীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে প্রাণোচ্ছলতা ও জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে।
১৯৫৫ সালে স্নাতক পাশের পর সুপিরিয়র সার্ভিসের (তখনকার সময়ে সিভিল সার্ভিসকে সুপিরিয়র সার্ভিস বলা হতো) নির্বাচনী পরীক্ষায় বসেন। সেই সময় সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ছিল ২১-২৪ বছর। প্রাথমিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার বৈতরণী পার করে ১৯৫৬ সালে লেখক ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। করাচিতে যোগদানের পর তিনি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন ফ্লেচার স্কুল অফ ল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি, বোস্টন ও ওয়াশিংটনের ফরেন সার্ভিস ইনিস্টিটিউট থেকে। লেখক তখনকার পররাষ্ট্রনীতি ও যেভাবে নবীন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, তার কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন কর্মকর্তাদের নিজ দেশ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা না দিয়েই বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো মোটেই বাঞ্চনীয় নয়। প্রায় তিন বছরের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে তিনি প্রথম পদায়ন লাভ করেন ইতালির রোমে।
১৯৫৬ সালে চাকরিতে যোগদানের পর পাকিস্তান আমল পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি ইতালির রোম, চীনের পিকিং (বর্তমানে বেইজিং), নেদারল্যান্ডের হেগ, আলজেরিয়া ও ইসলামাবাদে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের চীন ভ্রমণের সফরসঙ্গী ছিলেন। সেই সময়ে বেশ কাছে থেকে তিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়াকে দেখেছেন এবং তার আচার-আচরণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ১৯৬২-৬৫ সাল পর্যন্ত চীনে কর্মরত সময়ের সাথে ১৯৭০ সালের ভ্রমণে দেখা চীনের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকার অবস্থা ও তখনকার যুদ্ধকালীন প্রশাসনিক অবস্থা তার লেখায় উঠে এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রাচারপ্রধান (চিফ অব প্রটোকল) এবং প্রশাসনিক মহাপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। সেই সময়ে পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন আবুল ফতেহ। তারা দুজনে মিলেই বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্র কাঠামোর ভিত গড়ে তুলেছিলেন। এই সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর বেশ কাছে থেকে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কেমন চেয়েছিলেন ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে তিনি আগ্রহী ছিলেন এই নিয়ে আলোচনা করেছেন।
১৯৭২-৭৬ সাল পর্যন্ত ফারুক চৌধুরী লন্ডনে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে নিযুক্ত করা হয়।
ফারুক চৌধুরী তিন দফায় ভিন্ন ভিন্ন সামরিক শাসনের অধীনে কাজের বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের আমলের পর জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমল। এবং তিন দফাতেই তার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় আমলাদের কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় স্বজনপ্রীতি ও চাটুকারিতা- এই নিয়েও আলোচনা করেছেন। এরশাদের প্রহসনের নির্বাচন, সার্ক গঠনের আদ্যোপান্ত, বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষীয় চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে তার লেখায়।
সুদীর্ঘ ৩৬ বছরের কূটনৈতিক জীবনে কাজ করেছেন ইতালি, চীন, নেদারল্যান্ড, আলজেরিয়া, ভারত, বেলজিয়াম, এবং পাকিস্তানে। সেই সময়ে উক্ত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়ন ও বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় ছিলেন সদা তৎপর। সার্কের একদম প্রথম থেকে সংগঠক হিসেবে কাজ করে সংস্থাটি গড়ে উঠতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। সান্নিধ্য লাভ করেছেন নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও তাদের ধ্যান-ধারণার। একজন কূটনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছেন দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। তার লেখায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাথে উল্লেখিত হয়েছে অন্যান্য দেশের পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিসহ আরো নানা ছোটখাট বিষয়। সুলেখনীর গুণে যেকোনো ঘটনা বা বর্ণনাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রায় ৫২৫ পৃষ্ঠার বইটি পড়তে গিয়ে বিরক্তি আসার কোনো সুযোগই নেই।
১৯৯২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ফারুক চৌধুরী যোগদান করেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের উপদেষ্টা হিসেবে। সংযুক্ত ছিলেন ব্র্যাকের অনানুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক, ডেল্টা-ব্র্যাক হাউজিংসহ বিভিন্ন প্রকল্পে। ব্র্যাকের প্রতিনিধি হিসেবে সফর করেছেন কানাডা, পেরু, আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও ইরানে। প্রত্যক্ষ্য করেছেন সেসব স্থানে ব্র্যাকের বহুবিধ কার্যক্রম ও একটি দেশীয় সংস্থাকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এত কাজের মাঝেও লেখালেখি থামাননি। নিয়মিত কলাম লিখেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই।
কর্মমুখর এই মানুষটি শত ব্যস্ততার মধ্যেও চালিয়ে গেছেন লেখালেখি, সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিবর্তন প্রশাসনের একদম ভেতর থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তার স্মৃতিচারণকে অনন্য করে তুলেছে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আগ্রহী যে কারো জন্য বইটি অত্যন্ত উপাদেয় পাঠ্য হবে।
ফারুক চৌধুরী ২০১৭ সালের ১৭ মে মৃত্যুবরণ করেন। কূটনীতি, উন্নয়নকর্ম, লেখালেখি সবক্ষেত্রেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাওয়া এই মানুষটি নিজের কর্মের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকবেন দীর্ঘদিন।