
Beware the quiet man. For while others speak, he watches. And while others act, he plans. And when they finally rest… he strikes.
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যখন নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ভেদ করে সন্ত্রাসীদের হাইজ্যাক করা যাত্রীবাহী প্লেন ঢুকে পড়ে, তখন সারা বিশ্ব তো বটেই, হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারাও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সবাই না।
টিভির পর্দায় অবিশ্বাস্য সেই হামলার দৃশ্য দেখে হোয়াইট হাউজের অধিকাংশ কর্মকর্তার মনের মধ্যে আতঙ্ক, অনিশ্চিয়তা এবং ধোঁয়াশার মিশ্র অনুভূতির জন্ম নিলেও একজন ব্যক্তি সেই ঘটনার মধ্যেই দেখতে পেয়েছিলেন নতুন এক সম্ভাবনা – তার পছন্দ অনুযায়ী নতুন বিশ্বব্যস্থা হড়ে তোলার এক সুবর্ণ সুযোগ। ব্যক্তিটি আর কেউ নন, সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত বায়োগ্রাফিকাল চলচ্চিত্র Vice এর প্রধান চরিত্র, তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি।
৯/১১ এর পরবর্তী পরিস্থিতিতে সবাই যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল, ঠিক তখনই চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহৃত উপরের উক্তিটির মতো সারা জীবন ধরে অনেকটা নিভৃতে থেকে কাজ করে যাওয়া, নিচু স্বরে মেপে মেপে কথা বলা ডিক চেনি শুরু করেন তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

সিনেমার কাহিনী অনুযায়ী, আজকের যে আমেরিকাকে আমরা চিনি, সেই আমেরিকাকে গড়ে তোলার পেছনে যদি এককভাবে কোনো ব্যক্তি দায়ী থাকেন, তিনি হলেন ডিক চেনি। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানী তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি, বন্দীদের উপর নির্যাতন, মিথ্যা অভিযোগে ইরাক আক্রমণ, এমনকি হালের আইএসের উত্থানের পেছনেও সিনেমাতে ডিক চেনির ভূমিকাকে পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়।
ভাইস সিনেমাটির কাহিনীকার এবং পরিচালক অ্যাডাম ম্যাককে। অ্যাডাম ম্যাককে একসময় হালকা ধাঁচের কমেডি মুভি নির্মাণ করতেন, যেগুলো কখনোই খুব একটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন্তু ২০১৫ সালে হঠাৎ করেই তিনি আলোচনায় উঠে আসেন, যখন তিনি ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনের কারণ নিয়ে কমেডি-ড্রামা ঘরানার মুভি ‘দ্য বিগ শর্ট’ নির্মাণ করেন। ভাইস সিনেমাটিকে বলা যায় দ্য বিগ শর্টেরই ধারাবাহিকতা। দুই সিনেমার কাহিনী সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু এদের জঁনরা, চিত্রনাট্য এবং পরিচালনার ধরনে এত মিল যে, ম্যাককের সিগনেচার খুব সহজেই ধরা পড়ে।
দ্য বিগ শর্টের মতোই ভাইস চলচ্চিত্রটির কাহিনীও একজন ন্যারেটর পেছন থেকে বর্ণনা করে। কিন্তু ভাইসের বর্ণনাকারী অনেক বেশি রহস্যময়। সিনেমার শুরুতে অঙ্গীকার করা হলেও শেষপর্যন্ত তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। বরং কাহিনী যতই এগোতে থাকে, ততই পরিষ্কার হয়ে উঠতে থাকে, চরিত্রটি নিছকই কাল্পনিক। অ্যাডাম ম্যাককে তার নিজস্ব স্টাইলে সিনেমাটি উপস্থাপনের স্বার্থেই চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন। এই বর্ণনাগুলোর কারণে সিনেমাটিকে মাঝে মাঝে ডকুমেন্টারি বলে ভ্রম হলেও মাত্র ২ ঘন্টা ১৫ মিনিটের ব্যাপ্তিতে ডিক চেনির মতো ব্যক্তির বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে হয়তো এর বিকল্প ছিল না।

ভাইস সিনেমায় ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির চরিত্রে অভিনয় করেছেন ক্রিশ্চিয়ান বেল। চরিত্রের স্বার্থে প্রতি বছর নিজের ওজন অবিশ্বাস্য পরিমাণে বাড়ানো-কমানোর ব্যাপারে বেল অনেক আগেই নিজেকে জীবন্ত কিংবদন্তীর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এই সিনেমা তাকে সেই রেকর্ড আরো সমৃদ্ধ করার আরেকটি সুযোগ করে দিয়েছে। বিশালদেহী ডিক চেনির মতো সাজার জন্য বেল এবার নিজের ওজন বাড়িয়েছেন ২০ কেজি! তার মেকআপ এতটাই চমৎকার হয়েছে, পাশাপাশি চেনি এবং বেলের চরিত্রের ছবি রেখে দিলে চেনিকে ভালোভাবে না চেনা দর্শকদের পক্ষে বোঝা একটু কঠিনই হবে কোনটা আসল চেনি, আর কোনটা বেল।
তবে শুধু দৈহিক গঠন আর মেকআপই না, এই সিনেমাতে ক্রিশ্চিয়ান বেলের অভিনয়ও ছিল অসাধারণ। তার তাকানোর ভঙ্গি, ধীরে ধীরে কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটা-চলার ভঙ্গির সাথে ইউটিউবে পাওয়া আসল ডিক চেনির পার্থক্য খুবই কম। নিঃসন্দেহে এটি ক্রিশ্চিয়ান বেলের অভিনয় জীবনের সেরা পারফর্মেন্সগুলোর মধ্যে একটি। যোগ্য প্রার্থী হিসেবেই সিনেমাটির জন্য তিনি অস্কারের মনোনয়ন পেয়েছেন। বেল ছাড়াও সিনেমার অন্যান্য চরিত্রগুলোর অভিনয় এবং মেকআপও অসাধারণ হয়েছে। বিশেষ করে চেনির স্ত্রী লিনের চরিত্রে এমি অ্যাডামস এবং প্রেসিডেন্ট বুশের চরিত্রে স্যাম রকওয়েল অসাধারণ অভিনয় করেছেন।

‘ভাইস’ সিনেমাটিতে অ্যাডাম ম্যাককে ডিক চেনির চরিত্রকে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। সিনেমাটি শুরুই হয় যুবক বয়সের ডিক চেনির মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর দৃশ্য দেখানোর মধ্য দিয়ে। এরপর ৯/১১ এর হামলার দৃশ্য দেখানোর পর সিনেমা আবার ফিরে যায় ১৯৬৩ সালে, যখন সদ্য বিবাহিত, কলেজ থেকে ঝরে পড়া চেনি তার নিজের শহরে কর্মরত ছিলেন একজন লাইন্সম্যান হিসেবে। মদ্যপ অবস্থায় পুনরায় বারে মারামারি করে জেলে গেলে তার স্ত্রী লিন চেনি তাকে শেষবারের মতো আল্টিমেটাম দেন, ডিক চেনি যদি কথা দিতে পারে সে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, তবেই তিনি তার সংসার করবেন।
এরপর সিনেমা একলাফে চলে যায় ১৯৬৯ সালে। ততদিনে ডিক চেনি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। পলিটিক্যাল সায়েন্সে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স শেষ করে তিনি যোগ দিয়েছেন হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সহকারী হিসেবে। সেখানে তিনি দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন এবং শীঘ্রই হোয়াইট হাউজের চীফ অফ স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত হন। যেহেতু দুজনেরই চিন্তাধারা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা খুব কাছাকাছি ছিল, তাই ধীরে ধীরে তার এক সময়ের বস রামসফেল্ডের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে।

ক্লিনটন ক্ষমতায় আসার পর ডিক চেনি রাজনীতি থেকে বিরতি নিয়ে হ্যালিবার্টন তেল কোম্পানীর সিইও হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০০ সালের নির্বাচনের পূর্বে যখন জর্জ বুশ তাকে প্রস্তাব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার রানিং মেট হওয়ার জন্য, তখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার নতুন সম্ভাবনা দেখতে পান তিনি। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদটি এমনিতে শুধুই নাম সর্বস্ব একটি পদ। কিন্তু সিনেমার কাহিনী অনুযায়ী জর্জ বুশের অযোগ্যতাকে পুঁজি করে চেনি হয়ে ওঠেন আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তিনি এমনভাবে তার পছন্দের লোকদেরকে বসান যে, বাস্তবে প্রেসিডেন্টের পরিবর্তে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো তারই ইচ্ছা অনুযায়ী।
অ্যাডাম ম্যাককের চেনির চরিত্র নিয়ে বাস্তবে খুব বেশি বিতর্ক নেই। ডিক চেনি যে আসলেই পর্দার আড়ালে থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক আগেই উঠে এসেছে। অ্যাডাম ম্যাককে সেগুলোকেই একত্রিত করে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু সেটি তিনি করেছেন অনেকটাই সাদামাটাভাবে। তার সিনেমাটিকে অনেক সমালোচকই তাই তুলনা করেছেন উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের সাথে, যেটি প্রচুর তথ্যে ঠাঁসা, কিন্তু তাতে গল্পের আমেজ নেই। সেদিক থেকে সিনেমাটি ঠিক প্রচলিত অর্থে স্বার্থক সিনেমা হয়ে উঠতে পারেনি।

ভাইস মুভিটি আইএমডিবিতে দর্শকদের কাছ থেকে মোটামুটি ভালো রেটিং (এই মুহূর্তে 7.1) পেলেও সমালোচকদের কাছ থেকে এটি মিশ্র রিভিউ পেয়েছে। রটেন টম্যাটোজ ওয়েবসাইট অনুযায়ী এটি ৬৬% ফ্রেশ। সেখানে ২৯৯ জন সমালোচক একে ৬.৭ রেটিং দিয়েছেন। অন্যদিকে মেটাক্রিটিক সাইটে এর রেটিং ৬৭। অনেক বিখ্যাত সমালোচকই একে ৫ এর মধ্যে মাত্র ২ বা ৩ দিয়েছেন। রজার ইবার্ট ওয়েবসাইটের এডিটর ব্রায়ান ট্যালেরিকো একে ৫ এর মধ্যে মাত্র ১.৪ দিয়েছেন। তার মতে, এই সিনেমাতে শুধু ঘটনাগুলোই দেখানো হয়েছে, কিন্তু ঘটনাগুলো কেন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে, সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। শেক্সপিয়রের ভাষায় এককথায় তার মন্তব্য, সিনেমাটি Full of sound and fury, signifying nothing।
ভাইস সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট আটটি বিভাগে অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে। সমালোচকদের কাছ থেকে মিশ্র রিভিউ পাওয়া এরকম একটি চলচ্চিত্রের পক্ষে বেস্ট পিকচার অ্যাওয়ার্ড জেতার সম্ভাবনা যদিও কম, বাকি ক্যাটাগরিগুলোর বেশ কয়েকটিতে এর অস্কার জেতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিশেষ করে যখন অনেক সমালোচকই একে লিবারেল প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেওয়ার পরেই মেকআপ-হেয়ারস্টাইল এবং ক্রিশ্চিয়ান বেলের অসাধারণ অভিনয়ের জন্য এর বেশ প্রশংসা করেছেন।