Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্যান’স ল্যাবিরিন্থ: গিয়ের্মো দেল তোরোর সর্বশ্রেষ্ঠ নির্মাণ

সিনেমার ইতিহাসের শুরু হতে আজ অবধি, জর্জ মেলিয়েসের অ্যা ট্রিপ টু দ্য মুন থেকে শুরু করে হালের লর্ড অফ দ্য রিংস কিংবা এলিস ইন ওয়ান্ডাল্যান্ডের মতো সিনেমাগুলো আমাদেরকে নতুন নতুন দুনিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। একধরনের স্যুডো রিয়ালিজম রিক্রিয়েশানের মাধ্যমে সেসব সিনেমা আমাদের বাস্তবিক পৃথিবীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।

যেমন ধরা যেতে পারে, জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার কিংবা আইরিশ অ্যানিমেটেড ফিচার সং অফ দ্য সী; সিনেমা দুটির প্লটের যোজন যোজন ব্যবধান থাকলেও আদতে তার সুর একই – উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অধীনে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

১৯৪৪ সালের ফ্যালানজিস্ট স্পেন। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একদল গেরিলা তখনও লড়ে যাচ্ছিলো পাহাড়ে পাহাড়ে। চরম কর্তৃত্ববাদী সেই সময়কে দশ বছর বয়সী এক মেয়ের চোখে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন গিয়ের্মো দেল তোরো। ২০০৬ সালে মুক্তি পাবার পর থেকে বিশ্ব-সিনেমার ইতিহাসে নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছে প্যান’স ল্যাবিরিন্থ

প্যান’স ল্যাবিরিন্থ সিনেমার পোস্টার; Credit: Esperanto Filmoj and Warner Bros.

ফোকলোর সাহিত্য এবং চরিত্রদের সাথে স্বপ্নময় এবং একই সাথে ভীষণ নিষ্ঠুর এক যাত্রায় আমাদের সঙ্গী করে নেন গিয়ের্মো দেল তোরো। প্রথম শটের ঘুমপাড়ানি গান এবং ঘন শ্বাস-প্রশ্বাসে যে টেনশন তৈরি করেন, ন্যারেটর সেই টেনশন থেকে আমাদের মুক্তি দেন গল্পের সূত্রপাত করে।

সিনেমার প্রোটাগোনিস্ট অর্থাৎ প্রধান চরিত্র ওফেলিয়া, দর্জি বাবার মৃত্যুর পর তার মা কারমেন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কাপতান ভিদালের সাথে, যিনি ফ্যাসিস্ট ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কোর রেজিমের একজন অনুগত দাস। শহর থেকে দূরে একটি ক্যাম্পের অফিসার ইন কমান্ড তিনি। ওফেলিয়া এবং তার সন্তানসম্ভবা মা সেই ক্যাম্পে চলে আসে।

দুটি জগত সমান্তরালে ধরা দেয় আমাদের সামনে। বাস্তব পৃথিবী, যেখানে মা কারমেন যুদ্ধ করছেন নিজের সাথে, ভিদালের সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। আবার, ভিদাল এবং তার কোম্পানি পাহাড়ে থাকা রিপাবলিক বিপ্লবীদের দমন করতে ব্যস্ত। ফ্যাসিস্ট রেজিমের অনুগত সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবীদের চর ঢুকে পড়ে। কাপতানের প্রধান গৃহপরিচালিকা মারসিডিজ এবং কোম্পানির ডাক্তার নানা তথ্য, রেশমের খাবার, ওষুধ ইত্যাদি পাচার করতে থাকে।

মার্সেডিজ এবং ওফেলিয়া; Credit: Esperanto Filmoj and Warner Bros.

অন্যদিকে, ওফেলিয়া বৃহদাকার ব্যাঙের পেট থেকে চমৎকার উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে একটি চাবি বের করে আনে, খুব অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় শিশুখেকো বিবর্ণ দানবের কাছ থেকে। শেষে ভাইকে নিয়ে যায় চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসেবে, ল্যাবিরিন্থের কেন্দ্রে। সেখানে ফন এবং ভিদাল দুজনই উপস্থিত হয় এবং ভাইকে নিয়ে সিনেমার শেষ ক্লাইম্যাক্স দেখতে পাই আমরা।

প্যান’স ল্যাবিরিন্থের কাহিনী বুননে খানিকটা স্ববিরোধীতা লক্ষ্য করি আমরা। রূপকথার গল্পগুলো বলা হচ্ছে বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে। সমান্তরালে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের বিভৎসতা তখন ভিন্ন কথা বলে। ওফেলিয়ার ফ্যান্টাসির জগৎটিও আমাদের পরিচিত শান্ত, সুন্দর, আরামদায়ক রূপকথা নয়। আর-রেটেড সিনেমাটির ন্যারেটিভকে আমরা দুভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।

ফোকলোর সাহিত্যের বিচারে শিশুদের বাস্তবজীবনের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তি গড়ে দেয় রূপকথা বা মিথের গল্পগুলো। ওফেলিয়া যে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে তার বাবার বাসা ছেড়ে, তার ভয়াবহতা বোঝাতে দেল তোরো তার ক্যামেরা বার বার তাক করেছেন কাপতান ভিদালের অমানুষিক নির্যাতন এবং ভীত সন্ত্রস্ত কর্মচারী বা সৈন্যদের হাতে ধরা পড়া নিরপরাধ বা দোষী মানুষদের দিকে। কথা বলার দায়ে মদের বোতল দিকে মাথায় ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে কাউকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করেন না ভিদাল, ক্ষমা প্রদর্শন তার কাছে মানবিক দুর্বলতা! ওফেলিয়া সেসব ঘটনা দেখেনি ঠিকই, কিন্তু সে বাড়িতে তার অবস্থা দর্শক খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন।

আইকনিক ঘড়ি হাতে ভিদাল; Credit: Esperanto Filmoj and Warner Bros.

আমেরিকান স্কলার এবং লোকগাঁথা বিশেষজ্ঞ জ্যাক সাইপ দি জার্নাল অফ আমেরিকান ফোকলোর এ লেখেন –

রূপকথার মগ্ন পাঠক ওফেলিয়া নিজেকে আবিষ্কার করে তার গল্পগুলোর মাঝে, হয়ে ওঠে তেমনই এক চরিত্র। তার মাধ্যমে সে তার জীবনের বিভিন্ন নিয়ামক– তার মা, কাপতান ভিদাল, স্পেনের গৃহযুদ্ধের সাথে মোকাবেলা করতে পারে। এই গল্পগুলোই তাকে শক্তি জোগায় বাস্তবের চরিত্রগুলোকে রুখে দাঁড়াতে।

অর্থাৎ, রূপকথার ন্যারেটিভ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় ওফেলিয়া বাস্তব দুনিয়ার সাথে লড়াই করবার যোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু দেখা যায়, তার ফ্যান্টাসির সেই জগৎটিও বেশ বিভৎস এবং পরীক্ষাসঙ্কুল। বিশালাকৃতির ব্যাঙ, পেল ম্যান বা শিশুভাইকে হত্যা করতে চাওয়া ফন বাস্তব পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা এবং বন্ধুর পথেরই প্রতিনিধিত্ব করে যেন। একই পারিপার্শ্বিকতায় শুধুমাত্র চরিত্রের পরিবর্তন দেখা যায় দুটি জগতে।

পেল ম্যান; Credit: Esperanto Filmoj and Warner Bros.

অন্যদিকে, পরিচালক গিয়ের্মো দেল তোরো সিনেমাটিকে দাঁড় করান অন্য মার্জিনে। যদিও ত্রিশের দশকের শেষ হতে ফিল্ম বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গ্রান্ড ন্যারেটিভ তৈরিতে পরিচালকের বয়ান ধরে আগানোকে খুবই দুর্বল ধরা হয়। তবু, দেল তোরোর নিজের ইন্টারপ্রিটেশানকেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।

তিনি বলেছিলেন, ওফেলিয়ার জগৎ এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধ একই দুনিয়ার ঘটনা এবং দুটোই সমান বাস্তব। তা না হলে কেন ওফেলিয়া দুধে ভেজানো ম্যান্ড্রিকের মূলের বাটিতে রক্ত দিতে গিয়ে ধরা পড়বে? আবার, ওফেলিয়ার নতুন ঘরে যখন তাকে বন্দী করা হলো এবং প্রহরীকের আদেশ করা হলো যেন কোনোরকম পালিয়ে যাবার আভাস পেলেই ওয়েলিয়াকে গুলি করতে- ফনের দেয়া চকের মাধ্যমেই সে বন্দীশালা থেকে ছাড়া পায় ওফেলিয়া। অর্থাৎ, এখানে দ্বিতীয় জগৎ বা কল্পনার জগৎ বলে কিছু নেই।

দেল তোরো মূলত কর্তৃত্ববাদীতার বনামে অবাধ্যতার গল্প বলতে চেয়েছেন। চূড়ান্ত কর্তব্যপরায়ণ কাপতান ভিদালের সাথে ওফেলিয়ার প্রথম সাক্ষাতেই ওফেলিয়া নানাভাবে বিব্রত করা শুরু করে তাকে, অর্থাৎ অনুগামী সিস্টেমকে। কাপতানের সাথে হাত মেলাতে বাম হাত বাড়িয়ে দেয়া তার প্রথম কিস্তি। মা কারমেনের অনুরোধ ছিলো, কাপতানকে বাবা ডাকতে, কিন্তু পুরো সিনেমা জুড়েই ওফেলিয়া তাকে বাবা ডাকতে পারেনি, চায়নি সে।

নতুন কিছুকে আবিষ্কার করতে ওফেলিয়ার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, গ্রান্ড ডিনারে না আসা, ফনের নিষেধ সত্ত্বেও পেল ম্যানের সামনে থেকে খাবার খাওয়া প্রভৃতি ওফেলিয়ার অবাধ্যগত আচরণের প্রকাশ করে। পরিচারিকা মার্সিডিজ এবং ডাক্তার সাহেবও এই দলের। ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিপক্ষে যারা যুদ্ধ করছে, তারা অবস্থান করছে অবাধ্যতার চূড়ান্ত সীমায়।

ফন এবং ওফেলিয়া; Credit: Esperanto Filmoj and Warner Bros.

কিন্তু ওফেলিয়াকে যে চরিত্রটি তার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে পরিচালনা করছে, অর্থাৎ ফন– সে ঠিক কোন দলের? আমরা দেখতে পাই, ওফেলিয়া তাকে অমান্য করায় সে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। আবার শেষ বেলায় সে দাবী করে বসে ছোট ভাইয়ের নিষ্পাপ রক্ত। সে দাবী করে, ওফেলিয়ার ফিরে যাবার একটিই পথ। তা হলো, ফনের অন্ধ আনুগত্য। কাপতান ভিদালে সাথে খুব বেশি মিল পাওয়া যায় ফনের।

ফিল্ম মেকিংয়ের ক্ষেত্রে গিয়ের্মো দেল তোরো যেসব কৌশল অনুসরণ করেছেন, তাতে দুই জগৎকে ভিন্নভাবে না দেখে বরং একই রিয়েলিটির অংশ বলে প্রমাণ করার প্রবণতা দেখা যায়। দেল তোরো ক্যামেরাকে স্বতস্ফূর্তভাবে দুই দুনিয়ার মাঝেই আনা-নেওয়া করেন। গাছ কিংবা দেয়ালের ছায়ায় ওয়াইপ কাট ব্যবহার করে ঘটনাগুলোর মেলবন্ধন করেন তিনি।

ক্যামেরার বাইরে অবাধ্যগত আচরণ প্রকটভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক নিজেই। রূপকথার সমসাময়িক যে ধারা অর্থাৎ, গল্পগুলোকে খুব সুন্দর, স্বপ্নময় হতে হবে, ‘অতঃপর সকলে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ টাইপ হতে হবে– দেল তোরো সে ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। দুটি জগতকে তিনি তাই মোটা দাগে আলাদা করে দেননি। কোনো জগতকে অপরটি হতে শ্রেষ্ঠ- সেই ইঙ্গিত করেননি।

গিয়ের্মো দেল তোরো; Credit: Wikimedia

সিনেমাটি বানাতে দেল তোরো প্রচলিত অনেক গল্প, উপন্যাস এবং ফিল্মের সাহায্য নিয়েছেন। স্নো হোয়াইট, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড, দ্য উইজার্ড অফ ওজ এবং বিখ্যাত স্প্যানিশ উপন্যাস ডন কুহোটে এর মাঝে অন্যতম। ফ্রান্সিস্কো গয়ার আঁকা স্যাটার্ন ডিভাওরিং হিস সান নামের একটি ছবি হতে দেল তোরো পেল ম্যান চরিত্রটির অনুপ্রেরণা পান।

প্যান’স ল্যাবিরিন্থের আগে দেল তোরো ক্রোনাস এবং দ্য ডেভিল’স ব্যাকবোনে এর মতো সিনেমা তৈরি করে পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট নাম কামিয়ে নিয়েছিলেন। বিশেষত শিশু এবং অপার্থিব চরিত্রের চিত্রায়নে বেশ পারদর্শিতা দেল তোরোর। তিনটি অস্কারসহ শতাধিক পুরষ্কার জিতে নেয় সিনেমাটি। দেল তোরোর জীবনের তো বটেই, বিশ্ব-সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী সিনেমা প্যান’স ল্যাবিরিন্থ।

ফিচার ছবি: Esperanto Filmoj and Warner Bros.

Related Articles