![](https://archive.roar.media/wp-content/uploads/2023/10/article-1-unknown-facts-about-man-vs-wild-tv-show.jpg)
ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড, টিভি শো-র ইতিহাসে এক কালচারাল ফেনোমেননের নাম। একটি শো বেশিদিন দর্শকপ্রিয়তা ধরে রাখতে না, জনপ্রিয়তায় পড়ে ভাটা, দর্শক হারায় আগ্রহ। এসব তত্ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর বেয়ার গ্রিলস তার দুঃসাহসী কর্মকাণ্ড দেখিয়ে বুদ করে রেখেছেন ছেলে-বুড়ো সকলকে। দেখিয়েছেন কীভাবে সাপ, ব্যাঙ, পোকা-মাকড় খেয়ে ভয়ংকর বিপৎসংকুল পরিবেশে টিকে থাকতে হয়। কীভাবে মরুভূমির চোরাবালিতে আটকে গেলে করতে হবে প্রাণোদ্ধার, কীভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ফিরতে হবে আপন বাসস্থানে। ডিসকভারি চ্যানেলের তুমুল জনপ্রিয় এই শো-র পর্দার পেছনের অজানা কিছু দিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/wp3452526.jpg)
১.
ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড শো সম্পর্কে জানার আগে জেনে নেওয়া যাক শো-র প্রাণকেন্দ্র বেয়ার গ্রিলস সম্পর্কে। তার আসল নাম এডওয়ার্ড মাইকেল গ্রিলস। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন আয়ারল্যান্ডে জন্ম নেন তিনি। তার মাতামহ-প্রমাতামহ তাদের জমানায় খুব ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন। খেলেছেন ইংল্যান্ডের বহু স্থানীয় ও আঞ্চলিক দলে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/3f685b59de9afee56c272a40b56e672c-bear-grylls-baby-bears-973x1024.jpg)
তার পিতা মাইকেল গ্রিলস ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর রয়্যাল ইয়ার্ডস স্কোয়ারডন স্যাইলর। এজন্য ছোটবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পেয়েছিলেন এডওয়ার্ড গ্রিলস। ওইসময়েই স্কাই ডাইভিংয়ে হাতেখড়ি তার। কিন্তু তার নামের সাথে বিয়ার যুক্ত হয়েছিল কীভাবে? এডওয়ার্ড মাইকেল গ্রিলসের বড়বোন লারা ফসেট তার জন্মের সপ্তাহ-দশেক দিনের মধ্যেই তাকে বেয়ার নামে ডাকা শুরু করেছিলেন।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/1537473802114261442.jpg)
২.
বেয়ার গ্রিলসের ঝুলিতে বেশ ভারী ভারী সেনাপদক রয়েছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ’21 SAS Regiment’ এর একজন প্যারাট্রুপার ছিলেন তিনি। জাম্বিয়ায় প্যারাসুট ট্রেনিংয়ের সময় মারাত্মকভাবে আহত হলে ভেঙে যায় তার মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়। চিকিৎসক সাফ জানিয়ে দেন, তিনি আর কোনোদিন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। কিন্তু ভাগ্য সহায় থাকলে ঠেকায় কে? মাত্র দেড় বছরের মাথায় ভারতের পশ্চিম বাংলা, এবং সিকিম ভ্রমণে আসেন তিনি, এভারেস্টে চড়ার প্রস্তুতি নিতে। সকলকে অবাক করে ১৯৯৮ সালের ১৬ মে দুর্গম এভারেস্ট জয় করেন তিনি। ২০০৪ সালে বেয়ারকে রয়্যাল ন্যাভাল রিসার্ভের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সম্মান প্রদান করা হয়। ২০১৩ তাকে বানানো হয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল অব রয়্যাল মেরিন রিজার্ভ। ২০২১ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্নেল উপাধিতে ভূষিত হন তিনি।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/dd2a118253048f6f7f40b9984865b469-818x1024.jpg)
৩.
বেয়ার গ্রিলসকে ছাড়া কোনোভাবেই ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড শো কল্পনা করা যায় না। ডিসকভারি চ্যানেল ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ‘দ্য রকিজ’ নামে পাইলট এপিসোড রিলিজ দিলেও পরবর্তী এপিসোড এয়ার হতে সময় লেগে যায় অনেক। দীর্ঘ ৮ মাস পর আসে দ্বিতীয় এপিসোড। এরপর ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর সপ্তম সিজন পর্যন্ত ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের মোট ৭৩টি এপিসোড রিলিজ হয়েছে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/Untitled-1024x576.jpg)
৪.
শো-তে দেখানো হয়, বেয়ার গ্রিলসকে অপরিচিত এক স্থানে ছেড়ে দেওয়ার পর সে তার নিজস্ব সার্ভাইভাল টেকনিক ব্যবহার করে ওই জায়গা থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু বিষয়টা পুরোপুরি সঠিক নয়। একেকটি এপিসোড বানাতে তাদের সময় লাগত ১০-১২ দিন। সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হতো ঠিকঠাক জায়গা খোঁজার পেছনে। পুরো দল নেমে যেত সে কাজে। জায়গা ঠিক করার পর সেটাকে আবার বেয়ারের জন্য আলাদাভাবে সাজাতে হতো। অনুসরণ করতে হতো বেশকতক সেফটি রেগুলেশন। যে কারণে বিহাইন্ড দ্য সিনে নিয়োগ দেওয়া হতো অনেক সারভাইভাল এক্সপার্টকে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/2023-10-25_123651.jpg)
৫.
বেয়ার গ্রিলসের দুঃসাহসী এই অ্যাডভেঞ্চারকে আমরা ডিসকভারি চ্যানেলের ‘Man Vs Wild’ টিভি শো নামেই জানি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে এটি পরিচিত ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড নামে। কিন্তু এই শো নির্মিত হওয়া দেশ যুক্তরাজ্যে একে ‘Born Survivor’ নামে ডাকা হয়। এর পাশাপাশি অনেক দেশে আবার এটি ‘Ultimate Survival’ নামেও প্রচারিত হয়।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/1698227777865-1024x682.jpg)
৬.
এই শো অন্য সকল শো থেকে ব্যতিক্রম হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে বেয়ার গ্রিলসের অদ্ভুত সকল জীবজন্তু ভক্ষণ। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এ যাবৎকালে বেয়ারের খাওয়া সবচেয়ে জঘন্য খাবার কোনটি? ছোটখাট পোকামাকড়, বিচ্ছু, পচা মাংস, ভালুকের মল, বিষধর সাপ, নাকি নিজের মূত্র? বেয়ার গ্রিলসের ভাষায়, ছাগলের অণ্ডকোষ ছিল তার খাওয়া সবচেয়ে বাজে খাবার। যেটা খেয়ে তার মতো লোক বমি পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু আরবদেশের বহু যাযাবর জাতি-গোষ্ঠী সেই খাবার প্রতিদিন তৃপ্তি মিটিয়েই উদরপূর্তি করে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/1698227626484-819x1024.jpg)
৭.
প্রচণ্ড সাহসী বেয়ার গ্রিলসকে একবাক্যে সবাই বাহাদুর মানবে। সে নিজেকে প্রমাণও করেছে বহুবার। কিন্তু সে-ও মানুষ, তারও ভয়-ভীতির অনুভূতি বিদ্যমান। তিনি যে জিনিসকে সবচেয়ে বেশি ভয় পান, তা হলো উচ্চতা। যদিও অন স্ক্রিনে বহুবার আমরা তাকে এই ভয়কে মোকাবিলা করতে দেখেছি।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/Conference-Approved-Photo-Climbing-1024x683.jpg)
৮.
টেলিভিশনে আমরা যা যা দেখি, তা কি পুরোপুরি সত্য? অভিযানে বেয়ার কি সত্যি সত্যি তার প্রাণকে এভাবে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়? শো-র বিহাইন্ড দ্য সিনের কিছু দৃশ্যের ফলে সত্য উঠে আসে সবার সামনে। সকলেই ভাবত বেয়ারের সাথে এই অভিযানে যায় শুধু একজন চিত্রগ্রাহক। কিন্তু আসল কাহিনি হলো, পুরাদস্তুর এক দলকে নিয়ে তিনি রওয়ানা হন প্রতিটি অভিযানে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/ed8c753a17c83289a0349e8558357df2.jpg)
স্থান হিসেবে এমন জায়গা বাছা হয়, যা মানবসভ্যতা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এমনও শোনা যায় যে, কিছু এপিসোডে বেয়ার হোটেলে এসে রাত কাটিয়েছিল। এমনকি এক এপিসোডে নকল ভালুকের স্যুটও ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে প্রচারিত হওয়া এক পর্ব ছিল আগ্নেয়গিরি সম্পর্কিত। ওই এপিসোডের কিছু দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য আগ্নেয়গিরির ধোয়া দেখাতে নকল কিছু ধোঁয়া ব্যবহার করেছিল ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড টিম।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/uLAy5W.jpg)
৯.
উপর্যুক্ত কারণসমূহে জনরোষানলের মুখে পড়ে পুরো দল। এসব বিতর্কের অবসান ঘটাতে ডিসকভারি চ্যানেল অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘Disclamer‘ যুক্ত করে দিয়েছিল। বেয়ার গ্রিলস এই অভিযান একা পরিচালনা করেন না, পুরো একটা বিশেষজ্ঞ দল তার সঙ্গে থাকে, সেসব বিষয় উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল ডিসক্লেমারে। এছাড়াও চতুর্থ সিজনে তারা অনেক বিহাইন্ড দ্য সিন রিলিজ করেছিল অনলাইনে। সেখানে খোলাসা করা হয় বিভিন্ন ক্রু এবং কাস্টকে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/2023-10-25_124444.jpg)
১০.
একবার ২০১৫ সালে প্রকাশিত হিন্দুস্থান টাইমসের এক আর্টিকেলকে ভুলভাবে প্রচার করার ফলে, অনেকে ভেবেছিল বেয়ার ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু সে কাহিনি সত্য নয়। ওই আর্টিকেলে বেয়ার গ্রিলস তার দার্জিলিং ভ্রমণের কাহিনি ব্যক্ত করেছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী এই ভ্রমণে তাকে অনেক সাহায্য করেছিল। কিন্তু কোথাও তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাপোষণ করেননি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়মানুযায়ী, ভারত, নেপাল এবং তিব্বত ছাড়া আর কোনো জায়গার মানুষের ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/indian_army_soldiers_ap_16276661933302_b.jpg)
১১.
অবসর কাটানোর জন্য অদ্ভুত এক জায়গা বেছে নিয়েছেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী এই লোক। ২০০১ সালে ৯৫ হাজার ইউরো দিয়ে সেন্ট টুডওয়াল’স ওয়েস্টের দ্বীপের ২০ একর জায়গা কিনে নেন তিনি। মানবসভ্যতা থেকে যার দূরত্ব ৫ মাইলের মতো। দ্বীপের চারপাশে শুধু অথৈ জলরাশি। নেই বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা। শুধু আছে একটা বাতিঘর এবং থাকার জন্য বাড়ি। নিজে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মাঝেমধ্যে এখানে অবকাশ যাপন করতে আসেন তিনি। আসা-যাওয়ার জন্য রয়েছে উচ্চগতিসম্পন্ন স্পিডবোট।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/10/1698227683842-1024x1024.jpg)
১২.
২০১২ সালের ডিসকভারির সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল বেয়ার গ্রিলসের। তবে ডিসকভারি চ্যানেল এত সহজে ছাড়তে চায়নি তাকে। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড শেষ হবার পর ডিসকভারির সাথে মিলে Worst Case Scenario, Get Out Alive, Escape from Hell, The Island, Running Wild with Bear Grylls ইত্যাদি শো উপহার দিয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালে তার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় নেটফ্লিক্স, যেখানে ‘You vs Wild’ নামে একটি নতুন শো রিলিজ করা হয় এই অনলাইন স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম থেকে।