‘মে ফ্লাওয়ার’ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের খণ্ডকালীন প্রবাস জীবনের ডায়েরি। লেখক এর আগে তার পিএইচডি ডিগ্রি চলাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ এবং ‘যশোহা বৃক্ষের দেশে’ বইয়ে আমেরিকার ভ্রমণ কাহিনী তুলে ধরেছেন৷ ‘মে ফ্লাওয়ার’ আমেরিকা ভ্রমণের আরেকটি অধ্যায়।
এই বইয়ের রচনাকাল খুব সম্ভবত ইংরেজি ১৯৯০ সাল। একদা আকস্মিকভাবেই আমেরিকা দূতাবাস থেকে হুমায়ূন আহমেদের ডাক পড়ল সে দেশের আইওয়া সিটিতে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে। ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধি হিসেবে সে মঞ্চে দু’বার উপস্থিত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলাদেশের পক্ষে হুমায়ূনই প্রথম। কিন্তু, হুমায়ূনের বয়ানেই শুনুন,
“দেশের বাইরে বেড়াতে যাবার সুযোগে আনন্দিত হন না— এমন মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। আমি সেই খুব-অল্পদের একজন। বাইরে যাবার সামান্য সম্ভাবনাতেই আমি আতঙ্কগ্রস্ত হই। আতঙ্কগ্রস্ত হবার কারণ আছে— এখন পর্যন্ত আমি কোনো বিদেশ যাত্রা নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারিনি।”
এহেন হুমায়ূন নিতান্তই অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয়েছিলেন তিন মাসের প্রবাসযাপনে। আমেরিকার যে ডরমেটরিতে তার থাকার কথা হয়েছিল, তার নাম ‘মে ফ্লাওয়ার’। বাংলাদেশ ছাড়বার পূর্বেই কাকলী প্রকাশনীর কর্ণধার হুমায়ূনের কাছ থেকে এ নামে একটি বই ছাপবার জবান আদায় করে নেন। তার সেই খণ্ডকালীন আমেরিকাযাত্রার দিনলিপিই সংকলিত হয়েছে ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামে। ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামটির অবশ্য অন্য ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে— যে জাহাজে করে ইউরোপ থেকে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা প্রথম আমেরিকা যাত্রা করেন, সেই জাহাজের নাম ছিল ‘মে ফ্লাওয়ার’।
বিশ্বের নানা প্রান্তের ৪৫ জন লেখকের সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন। বিদেশী কবি-সাহিত্যিকদের সাথে কাটানো সময়, তাদের লেখালেখি, আচরণ ইত্যাদি অত্যন্ত সরস বর্ণনে এ লেখায় উঠে এসেছে। বহু লেখক-ঔপন্যাসিক তাদের মাতৃভাষা পরিহার করে অন্য ভাষা ধার করে লিখছেন- কখনো শখে, কখনো বা বাধ্য হয়ে, এ ঘটনা হুমায়ূনকে দুঃখিত করেছে এবং বাংলা ভাষা নিয়ে জাগিয়েছে গর্ব। লেখক-সম্মেলন পরিদর্শন শেষে তিনি জানাচ্ছেন,
“সিকাট টাইপ রাইটার নিয়ে বসলেন। তিনি টেগালগ ভাষায় লেখেন ঠিকই, কিন্তু ব্যবহার করেন ইংরেজি অক্ষর। কারণ টেগালগ ভাষায় নিজস্ব বর্ণমালা নেই। একই ব্যাপার তোহারির বেলাতেও।….কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা আরো গভীর…নাইজেরিয়ার নাট্যকার ওলে সোয়েঙ্কা লেখেন ইংরেজি ভাষায়, কোনো আফ্রিকান ভাষায় নয়। শ্রীলঙ্কার কবি জেন কখনো সিংহলি বা তামিল ভাষায় লেখেননি, লিখেছেন ইংরেজিতে….।
বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে আমি মহা ভাগ্যবান। অন্যের ভাষায় আমাকে লিখতে হচ্ছে না, অন্যের হরফ ব্যবহার করেও আমাকে লিখতে হচ্ছে না। আমার আছে প্রিয় বর্ণমালা। এই বর্ণমালা রক্ত ও ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর বুকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে…।”
বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে আমেরিকান ও বাঙালি, তথা প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সংস্কৃতির সংঘাত, তাদের সমাজব্যবস্থা, পরিবার, জীবনচর্যা নিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। হুমায়ূনের মনে হয়েছে,
“এই দেশের শরীরের গঠন চমৎকার, কিন্তু তার আত্মা কোথায়?”
আমেরিকার ‘ভঙ্গুর পারিবারিক-সামাজিক ব্যবস্থা’ নিয়ে বেশ খোলামেলা সমালোচনা করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তার বক্তব্যকে যথার্থতা দিতে চেষ্টা করেছেন। তিনি যা উল্লেখ করেছেন, তার সবটুকুই যে অগ্রাহ্যকর, তা নয়; তবে কোথাও কোথাও সেই সমালোচনা গৎবাঁধা, একপেশে আবেগপ্রসূত এবং অতি সরলীকৃত বলে মনে হয়েছে। আমেরিকান সংস্কৃতিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাঙন, বস্তুকেন্দ্রিক ভোগবাদী জীবনের কথা তিনি যখন বর্ণনা করেন, তখন তা স্বীকার করতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সেই তিনিই যখন লেখেন,
“একটি মেয়ের জীবনের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা হলো সে চিয়ার লিডার হবে। ফুটবল খেলার মাঠে স্কার্ট উচিয়ে নাচবে, তার সুগঠিত পদযুগল দেখে দর্শকেরা বিমোহিত হবে…”
কিংবা
“আসছে একশো বছরেও এই আমেরিকায় কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হবে না, অতি সুসভ্য এই দেশ তা হতে দেবে না…“
সবরকম তথ্য-উপাত্ত হাতে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তখন তা মানতে একটু কষ্ট হয় বৈকি!
বিমানবন্দরে বিড়ম্বনা, আমেরিকার কোনো কোনো বড়কর্তার বাংলাদেশ সম্পর্কিত মনোভঙ্গি, হীন রসিকতা এবং তার সাথে আমেরিকা প্রবাসী শেকড় ভোলা কোনো কোনো বাঙালির উন্নাসিক আচরণ, বাংলা ভুলে যাওয়া, বাংলা সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করা তাকে কুপিত করেছে, আবার নিউ জার্সি’তে ‘বাংলাদেশ সমিতি’র কার্যক্রম তার মনে জাগিয়েছে আত্মশ্লাঘার গভীর পরশ,
“বাংলাদেশ আর কিছু পারুক না পারুক একদল পাগল ছেলে তৈরি করে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না..।”
এছাড়া প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের সাথে ট্রেন ভ্রমণের একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় এ বইতে। হুমায়ূনের যাত্রা শুরু হয়েছে আইওয়া সিটি থেকে এবং শেষ হয়েছে নিউ জার্সিতে, অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার মাধ্যমে। সেখানে এক মিউজিয়ামে চন্দ্রশিলা স্পর্শ করার অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে,
“….এরা আমাকে এবং আমার মতো আরো অসংখ্য মানুষকে রোমাঞ্চ ও আবেগে অভিভূত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। ধরা-ছোঁয়ার বাইরের যে চাঁদ, তাকে নিয়ে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। এই শতক শেষ হবার আগেই তারা যাত্রা করবে মঙ্গলের দিকে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে আবারো অভিভূত করবে। আমেরিকা আমি পছন্দ করি না, তবু চন্দ্রশিলায় হাত রেখে মনে মনে বললাম— তোমাদের জয় হোক…।”
অর্থাৎ, হুমায়ূনের ভাষায় ‘দেশটার আত্মা নেই’, কিন্তু অনেকের আত্মাকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে দেবার বেলায়ও এর জুড়ি মেলা ভার! পুরো বইটিই হুমায়ূনের চিরাচরিত হালকা চালে লেখা। বইয়ে বেশ মজার কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ আছে, যা পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখবে। বইটাও পরিসরেও বেশ ছোট, মাত্র ৬৪ পাতার; অবসরে পড়ে ফেলার মতোই।