
বর্তমান কালের তিন খান শাহরুখ-সালমান-আমির যদি হন সুপারস্টার, তাহলে অমিতাভ বচ্চন হচ্ছেন মেগাস্টার আর দিলীপ কুমার হচ্ছেন টেরাস্টার। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বলিউড শাসন করা নন্দিত ত্রিমুর্তি ছিলেন দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ এবং রাজ কাপুর।

দিলীপ কুমার; Source: Adgully.com
পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারের প্রাণকেন্দ্র কিস্সা খাওয়ানি বাজারের ইতিহাসে ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল এক অগ্নিকাণ্ডে বাজারের অধিকাংশ এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর আগে বা পরে এরকম অগ্নিকাণ্ড আর কখনো হয়নি। ডিসেম্বর মাসের এই সময়ে খুব ঠাণ্ডা পড়ে পেশোয়ারে। একদিকে আগুন, অন্যদিকে তুষারপাতও হচ্ছিলো। সেই পরস্পরবিরোধী পরিবেশে পেশোয়ারের কিস্সা খাওয়ানি বাজারে এক পাঠান মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন হিন্দি সিনেমার ইতিহাসের সর্বকালের সেরা সুপারস্টার দিলীপ কুমার। দিলীপ কুমারের প্রকৃত নাম হচ্ছে ইউসুফ খান।
ফ্রন্টিয়ার মেল: পেশোয়ার টু বোম্বে
যেহেতু দিলীপ কুমারের পিতা ছিলেন একজন ফল ব্যবসায়ী, ব্যবসার কাজে তিনি বোম্বে আসতেন। পেশোয়ার থেকে সরাসরি বোম্বে আসার ট্রেন ছিলো ফ্রন্টিয়ার মেল নামে। পেশোয়ারের বাগানে উৎপাদিত ফল বোম্বে নগরীতে বিক্রি করলে লাভ বেশি হতে পারে। এজন্য তিনি বোম্বেতে ব্যবসাকার্য প্রসারের ভালো একটি সুযোগ খুঁজছিলেন। সেই ফ্রন্টিয়ার মেলে চেপে দিলীপ কুমার প্রথম বোম্বে নগরীতে আসেন। সেদিনের সেই ট্রেন যাত্রার কথা দিলীপ কুমার সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি। সময়টা ১৯৩৫ এর দিকে হবে। বিভিন্ন স্টেশনে যখন ট্রেন থামতো, তার পিতার বন্ধুরা বিভিন্ন খাবার-দাবার নিয়ে স্বাগত জানাতে আসতেন।
উপমহাদেশের আকাশে বাতাসে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তখন ছড়িয়ে পড়েছে। চাওয়ালা হাঁকডাক দিতো ‘হিন্দুু চা, হিন্দু পানি’, ‘মুসলমান চা, মুসলমান পানি’ বলে। বোম্বে নগরীর কোলাবা এলাকার নাগদেবী স্ট্রিটে এসে দিলীপ কুমারের পরিবার বসতি নিলো।

তিন প্রজন্মের তিন সুপারস্টার; Source: Janubaba.com
দিলীপ কুমার ১৯৩৭ সালে বোম্বের আনজুমান ইসলাম হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিছুদিন পর বোম্বে থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে দেওলালিতে তার পুরো পরিবার স্থানান্তরিত হয়। কয়েক বছর পর তারা আবার বোম্বেতে ফিরে আসেন। দিলীপ কুমার তখন বোম্বের বিখ্যাত খালসা কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে পড়ার সময় তার পরিচয় হয় হিন্দি সিনেমার আরেক কিংবদন্তী রাজকাপুরের সাথে। রাজকাপুরের সাথে তার এই বন্ধুত্ব আজীবন স্থায়ী থাকে। বলে রাখা ভালো, রাজকাপুরের দাদা দেওয়ান বশেশ্বর নাথ কাপুর পেশোয়ারে দিলীপ কুমারদের প্রতিবেশী ছিলেন।
দিলীপ কুমার ছিলেন একজন উৎসুক পাঠক। ইংরেজি ও উর্দু সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন তিনি। কিন্তুু কখনোই সিরিয়াস ধরনের মেধাবী ছাত্র তিনি ছিলেন না। তার পিতা চাইতেন, তিনি যাতে একজন OBE (Order of the British Empire) হতে পারেন, মানে যাতে ব্রিটিশের একজন অনুগত চাকরিজীবী হতে পারেন।
কিন্তুু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। পিতা চাইলেন ছেলে যাতে ব্রিটিশের চাকুরে হয়। কিন্তুু নিয়তির খেলা ছিলো অন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজলো। পিতা সারোয়ার খান যুদ্ধের সময়ে পেশোয়ারের বাগান থেকে সস্তায় ফলমূল আর আনতে পারলেন না। যুদ্ধকালীন ট্রেনগুলো শুধু অস্ত্র আর গোলাবারুদ সাপ্লাইয়ের কাজে ব্যবহৃত হতো। ফলের ব্যবসায় নামলো ধস। অভাবে পড়ে তার মন মেজাজ বিগড়ে যেত। একদিন দিলীপ কুমার পিতার সাথে রাগারাগি করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন। মাত্র ৪০ রুপি পকেটে নিয়ে বোম্বে থেকে ১৭০ কি.মি. দূূূূরে পুনে নগরীতে পাড়ি জমালেন দিলীপ।

পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সাথে রাজ কাপুর, দেব আনন্দ ও দিলীপ কুমার; Source: Times of India
জীবনের কঠিন রঙ্গমঞ্চে পুনে শহরে দিলীপ কুমারের পরিচিত কেউ ছিলো না। দুরন্ত এক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন। এক রেস্টুরেন্টে কাজ যোগাড় করে দিলীপ কুমার তার সততা ও বুদ্ধির দ্বারা বেশ সুনাম অর্জন করেন। পুনেতে তার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো আনন্দ আর কাজের মাঝে। কিন্তুু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় রেস্টুরেন্টের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। ম্যানেজার তাকে বললেন সেখান থেকে চলে যেতে। ততদিনে দিলীপ কুমারের হাতে বেশকিছু নগদ টাকা জমেছে। পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য মনটাও আনচান করতে লাগলো তার। ৫,০০০ রুপি নিয়ে তিনি বোম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সময়ের ব্যবধানে বাবা-ছেলের অভিমান দূর হলো। পরিবারের সবার মাঝে আবার আনন্দ ফিরে এলো। দিলীপ কুমারের পিতা ছেলেকে তার ফলের ব্যবসা বুঝিয়ে দিলেন কিছুটা।
লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন
বোম্বে টকিজ তখন হিন্দি চলচ্চিত্র প্রযোজনার একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠান। এর সবকিছু দেখাশোনা করতেন মিস দেবিকা রানী। দিলীপ কুমার তখন পর্যন্ত কোনো সিনেমাই দেখেননি। এক পরিচিতজনের সাথে তিনি একবার বোম্বে টকিজের অফিসে যান। দেবিকা রানী প্রথম দেখাতেই দিলীপ কুমারকে পছন্দ করে ফেলেন। মাসিক ১,২৫০ রুপি বেতনে তিনি বেতনভুক্ত অভিনেতা হিসেবে নির্বাচিত হন বোম্বে টকিজের। দিলীপ কুমার তার আত্মজীবনীতে জানান, সালটা ছিলো ১৯৪২, আর দিনটি ছিলো শুক্রবার। কোন মাসের কত তারিখ সেটি অবশ্য তিনি মনে রাখতে পারেননি।
পরের দিন দিলীপ কুমার বোম্বে টকিজের অফিসে গেলেন। দেবিকা রানী তাকে বিখ্যাত অভিনেতা অশোক কুমারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঠিক সেই মুহুর্তে বলিউডের শো-ম্যান খ্যাত রাজ কাপুরও উপস্থিত। খালসা কলেজে পড়ার সময় থেকে দিলীপ আর রাজের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। রাজকাপুর তো দিলীপ কুমারকে দেখেই টিপ্পনী কাটলেন, “আরে, তুমি এখানে। তোমার বাবা কি জানে, তুমি অভিনয়ে নামছো?”

পরিবারের কাছে গোপন করে এসেছিলেন বলিউডে; Source: Sify.com
রাজ কাপুর জানতেন দিলীপ কুমারের পরিবারের রক্ষণশীলতার কথা। দিলীপ-রাজের ঘনিষ্ট সম্পর্ক দেখে দেবিকা রানী খুশি হলেন । দিলীপ কুমারও খুশি হলেন তার পরিচিত লোক পেয়ে। প্রথম দু’মাস দিলীপের কাজ ছিলো শুধু শ্যুটিং স্পটে উপস্থিত হয়ে ছবির কাজ দেখা। অশোক কুমার তখন সুপারস্টার। পরিচালক জ্ঞান মুখার্জী তাকে নিয়ে কিসমত (১৯৪৩) মুভিটি বানাচ্ছিলেন। দিলীপ কুমার তার অভিনয় দেখতে লাগলেন শুটিং স্পটে নিয়মিত হাজির হয়ে। বাসায় গেলে মা যখন জিজ্ঞেস করতেন চাকরির ব্যাপারে, তিনি তখন বলতেন, একটি কোম্পানিতে কাজ করছি। কোম্পানির পরিস্থিতি অনেক ভালো। কী কাজ করতে হয়, সে ব্যাপারে এড়িয়ে চলতেন সবাইকে।
ইউসুফ খান থেকে দিলীপ কুমার
সেই মুহুর্তে একটা বিরাট ব্যাপার ঘটে গেলো। বোম্বে টকিজের মালিক দেবিকা রানী ঘোষণা দিলেন, খুব শিগগিরই তিনি এই নবাগত পাঠান যুবককে নিয়ে একটি সিনেমা বানাবেন। দিলীপ কুমারকে একদিন তিনি ডেকে পাঠালেন। তখন পর্যন্ত দিলীপ কুমারের নাম ছিলো ইউসুফ খান। দেবিকা রানী তাকে বললেন,
“দেখো ইউসুফ, যেহেতু আমরা খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছি, পর্দায় তোমার নামটা পরিবর্তন করতে চাই আমি। ইউসুফ খানের বদলে দিলীপ কুমার নামটাই আমার পছন্দ।”
দিলীপ কুমার বাড়িতে গিয়ে একা একা চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে নাম পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন না। পরের দিন আবার শশধর মুখার্জীর সাথে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ আলোচনা করলেন তিনি। শশধর মুখার্জী তার নাম পরিবর্তনের পক্ষে মত দিলেন। তিনি দিলীপ কুমারকে বললেন, দেখো, সুপারস্টার অশোক কুমারের প্রকৃত নাম কিন্তুু কুমুদলাল কাঞ্জিলাল গাঙ্গুলী। অশোক কুমার নামেই সবাই তাকে চেনে। তাই, আমি বলছি তোমার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটা ঠিক আছে।

বৈজয়ন্তীমালার সাথে; Source: Pinterest
অবশ্য অনেকেই দিলীপ কুমারের এই নাম পরিবর্তন নিয়ে অনেক কথা বলেন। কেউ কেউ বলেন, দেশ স্বাধীনের সেই উত্তাল সময়গুলোতে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক খুব খারাপ ছিলো। হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে মুসলমান অভিনেতাকে দর্শকরা গ্রহণ করবে না বলেই এই নাম পরিবর্তন। কিন্তুু বাস্তব সত্য হলো, নাম পরিবর্তনের ঘটনাটি ১৯৪৩ সালের কথা । তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক চরম তিক্ত হয়েছে আরও কিছুদিন পরে। সবাই তখন ছিলো বৃটিশের প্রজা। আর দিলীপ কুমার তার আত্মজীবনীতে এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। তাই ধারণা করা যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই এই নামকরণের প্রক্রিয়াটি ঘটেছিল।
রূপালী পর্দার জীবন
১৯৪৪ সালে দিলীপ কুমারের প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পায়। তারপর ‘প্রতিমা’ (১৯৪৫) এবং ‘মিলন’ (১৯৪৭) সিনেমা দুটি মুক্তি পায়। তবে ১৯৪৭ সালের শেষদিকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জুগনু’ই হচ্ছে তার প্রথম হিট ছবি। অভিনেত্রী কামিনী কুশলের সাথে দিলীপ কুমারের সার্থক জুটি গড়ে উঠে সে সময়। ‘নদীয়া কে পাড়’ (১৯৪৮) এবং ‘শবনম’ (১৯৪৯) নামে পরপর দু’বছরে দুটি সুপারহিট সিনেমা তৈরি হয় দিলীপ কুমার আর কামিনী কুশলকে নিয়ে। অশোক কুমারের পর হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে উঠেন দিলীপ কুমার। এরপর পুরো পরিবারকে নিয়ে বোম্বের বেভারলি হিলস খ্যাত অভিজাত এলাকা বান্দ্রায় বসবাস করা শুরু করেন তিনি।

শশী কাপুর ও দিলীপ কুমার; Source: Pinterest
১৯৫৫ সালে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে ‘ট্রাজেডি কিং’ উপাধিতে ভূষিত হন। তারপর দিলীপ কুমার অভিনীত প্রায় প্রতিটি সিনেমা, যেমন- নয়াদৌড় (১৯৫৭), মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতি (১৯৫৮), পয়গাম (১৯৫৯), কোহিনুর (১৯৬০) সুপার-ডুপার হিট হয়। হিন্দি সিনেমার স্বর্ণালী যুগের বিখ্যাত নায়িকা নার্গিস, মধুবালা, নিম্মি, বৈজয়ন্তীমালা, মীনা কুমারী, ওয়াহিদা রেহমান- সবাই দিলীপ কুমারের বিপরীতে অভিনয় করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দিলীপ কুমারের কোনো বিকল্প ছিলো না। দিলীপ কুমারের সৌভাগ্য বলতে হবে যে, হিন্দি সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম সেরা কয়েকজন পরিচালককে তিনি পাশে পেয়েছিলেন। পরিচালক কমরুদ্দিন আসিফের অনবদ্য সৃষ্টি মুঘল-ই-আজম (১৯৬০) হিন্দি সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ছবির একটি। সম্রাট আকবরের চরিত্রে রাজকাপুরের বাবা পৃথ্বিরাজ কাপুর ও সম্রাট জাহাঙ্গীর ওরফে প্রিন্স সেলিমের চরিত্রে দিলীপ কুমার দুর্দান্ত অভিনয় করেন। পরিচালক আসিফ ছিলেন খ্যাপাটে ধরনের মানুষ। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানকে দিয়ে তিনি গান করালেন ২৫ হাজার রুপি দিয়ে, যখন লতা মুঙ্গেশকরের মতো শিল্পী পেতেন গান প্রতি তিনশো রুপি করে।

মুঘল-ই-আজম সিনেমায়; Source: IMDb
১৯৬২ সালে বৃটিশ পরিচালক ডেভিড লিয়েন দিলীপ কুমারকে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া সিনেমায় শেরিফ আলীর ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু দিলীপ কুমার তাকে না করে দেন। এই চরিত্রে পরে অভিনয় করেন মিশরীয় অভিনেতা ওমর শরীফ। দিলীপ কুমারের নিজের প্রযোজিত ছবি ‘গঙ্গা যমুনা’ (১৯৬১) খুব বিখ্যাত একটি ছবি। নিজের ভাই নাসির খানকে এই ছবিতে অভিষিক্ত করেন তিনি। সেটাতে তিনি নিজেও করেন দুর্দান্ত অভিনয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দিলীপ কুমার বলিউডে এমনই দাপুটে অভিনেতা ছিলেন যে, ৮ বার তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। আর ১৯ বার তিনি এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন! তার এই দুটি রেকর্ড আজও অম্লান।
সত্তর দশকে ত্রিমুর্তি দিলীপ-দেব-রাজের দাপট কমে যায় রাজেশ খান্না ও পরবর্তীতে অমিতাভ বচ্চনের আগমনে। অবশ্য বয়সও হয়ে গিয়েছিল তাদের। তথাপি ওয়াহিদা রেহমানের সাথে দিল দিয়া দরদ লিয়া (১৯৬৬), রাম আউর শ্যাম (১৯৬৭) বক্স অফিসে তুমুল ব্যবসা করে। অমিতাভ বচ্চনের সাথে অভিনীত তার শক্তি (১৯৮২) সিনেমাটিও হিট হয়। তারপর তিনি বিধাতা (১৯৮২), দুনিয়া (১৯৮৪), মশাল (১৯৮৪), কর্ম (১৯৮৬) ও সওদাগর (১৯৯১) সিনেমায় অভিনয় করেন। ১৯৯৮ সালে কিলা সিনেমায় সর্বশেষ অভিনয় করেন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় দিলীপ কুমারের রূপালী পর্দার বর্ণাঢ্য জীবন।

দিলীপ কুমার, মহেশ গাদভি, সায়রা বানু ও কল্যাণজী; Source: gadhvi.net
টালমাটাল ব্যক্তিজীবন
মুঘল-ই-আজম সিনেমার সহশিল্পী মধুবালার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দিলীপ কুমারের, ছবিটি মুক্তির আগেই। কিন্তুু দিলীপ কুমার যখন দেখলেন, মধুবালার পিতা আতাউল্লা খান ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা চিন্তা করেই এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চান, তখনই তিনি বেঁকে বসলেন। আতাউল্লা খান এমনও প্রস্তাব দেন যে, বিয়ের পর যেন দিলীপ কুমার আর কারও প্রোডাকশন হাউজে কাজ না করেন। আতাউল্লা খান নিজেই ছিলেন একজন প্রযোজক। পিতার একান্ত অনুগত কন্যা মধুবালা যখন নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না, আহত দিলীপ কুমার এ সম্পর্ক ভেঙে দেন.

‘অমর’ সিনেমায় মধুবালা-দিলীপ; Source: Twitter
অনেকদিন একা থেকে ১৯৬৬ সালের ১১ অক্টোবর সহশিল্পী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন দিলীপ কুমার, ৪৪ বছর বয়সে। সায়রা বানু দিলীপ কুমার থেকে ২২ বছরের ছোট। এই দম্পতির কোনো সন্তান হয়নি। কোনো কোনো সিনে পত্রিকা গুজব ছড়িয়েছিলো যে, দিলীপ কুমার সন্তান জন্মদানে অক্ষম। দিলীপ কুমার অবশ্য আত্মজীবনীতে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সায়রা বানু একবার গর্ভধারণ করেছিলেন। আট মাসের সময় উচ্চ রক্তচাপ ও গর্ভকালীন জটিলতায় ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যায়। তারপর আর সায়রা বানু সন্তান নেওয়ার মতো অবস্থায় ফিরে আসেননি। দিলীপ কুমারের জীবনে একটি বড় রকমের কেলেঙ্কারি ঘটে ১৯৮২ সালে। পত্র-পত্রিকায় খবর ছড়িয়ে পড়ে, আসমা রেহমান নামে এক নারীকে বিয়ে করেছেন তিনি। সায়রা বানু এ খবর শুনে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। দিলীপ কুমার অবশ্য বিয়ে করার কথা অস্বীকার করেননি। আত্মজীবনীতে তিনি তার ভক্ত ও সায়রা বানুর কাছে ভুল স্বীকার করেছেন এ নিয়ে। অবশ্য অল্পদিনের মধ্যে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। হয়তো দিলীপ কুমার আরও কয়েকজনকে নিয়ে ওই নারীর সাথে সব মিটমাট করে ফেলেন, আত্মজীবনীতে এরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
দিলীপ কুমার ১৯৮০ সালে বোম্বে নগরীর শেরিফ নির্বাচিত হন। কংগ্রেস পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। জওহরলাল নেহেরুর খুব কাছের বন্ধু ছিলেন তিনি। ২০০০-০৬ সাল মেয়াদে তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন । ১৯৮৮ সালে দিলীপ কুমার তার জন্মভূমি পাকিস্তানে যান। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ঘোষণা করেন। সেটাই ত্রিশের দশকের পর তার প্রথমবার পাকিস্তান যাওয়া। পেশোয়ারের কিসসা খাওয়ানির পৈত্রিক ভিটা পরিদর্শন করেন তিনি। জনগণ উল্লাসভরে তাকে অভ্যর্থনা জানান।

বলিউডে সম্মানের সবচেয়ে উঁচু আসনে এখন তিনিই; Source: Pinkvilla
১৯৯৮ সালে তিনি শেষবারের মতো পাকিস্তান যান। সেবার পাকিস্তান সরকার তাকে তাদের সর্বোচ্চ বেসামরিক সন্মান ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত করে। তবে এবার একটু বিপত্তি ঘটে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে দিলীপ কুমারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন পাকিস্তানে না যেতে। দিলীপ কুমার তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে পরামর্শ চান। বাজপেয়ী তাকে অনুমতি দেন পাকিস্তান যাওয়ার। বার্ধ্যক্যের ভারে নুয়ে পড়া দিলীপ কুমারের বয়স এবার হলো ৯৫ বছর। সায়রা বানুর সাথেই আছেন তিনি। সিনেমা যতদিন পৃথিবীতে থাকবে, ততদিন উপমহাদেশের সর্বকালের সেরা সুপারস্টার দিলীপ কুমার স্বরণীয় হয়ে থাকবেন পরম শ্রদ্ধার সাথে।
সংযুক্তি: ৭ জুলাই, ২০২১ তারিখে ৯৮ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমার।
তথ্যসূত্র:
1. Bose, Mihir; Bollywood: A History; 2008, Roli Books Pvt. Ltd.; New Delhi, India.
2. Kumar, Dilip; The Substance and the Shadow: An Autobiography; 2014; Hay House Publishers, India.
ফিচার ইমেজ: Upperstall.com